সপ্তাহকাল টানা ভারি বর্ষণ এবং পাহাড়ি ঢলে দেশের উত্তরাঞ্চল,উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্বের পার্বত্য অববাহিকার কিছু স্থানে স্বল্পমেয়াদী বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিস্থিতির ক্রম অবনতি ঘটছে। শহরের পথঘাট-সড়ক পানিতে ঢেউ খেলছে। অফিস-আদালত,স্কুল-কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্য কেন্দ্র, বাসাবাড়ি সবকিছু পানিমগ্ন। অতিভারী বর্ষণের কারণে কোমর পানিতে প্রায় স্তব্ধ হয়ে পড়েছে স্বাভাবিক জীবন যাত্রা। কক্সবাজারসহ পার্বত্য জেলাগুলোতে পাহাড় ধ্বস এবং মাটি চাপায় প্রতিদিন বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। বন্যা ও জলাবদ্ধতায় লক্ষ লক্ষ মানুষ পানি বন্দী। রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় কয়েকটি এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বিদ্যুৎ সরবরাহ। পার্বত্য ৪ জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহে বন্ধের মেয়াদ আরও দুই দিন বৃদ্ধি করা হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চট্টগ্রাম ও বান্দরবানে সেনা নামানো হয়েছে।
সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদের নির্দেশে গতকাল মঙ্গলবার সেনা মোতায়েন শুরু হয়। এদিকে আবহাওয়া দফতর তাদের পূর্বাভাসে বলেছে,চট্টগ্রাম বিভাগে আরও দু’দিন অতিভারী বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে। এ অঞ্চলের প্রধান নদী মুহুরী, ফেনী, হালদা, কর্ণফুলী, সাঙ্গু ও মাতামুহুরীর পানি বাড়ছে। এতে ফেনী, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও বান্দরবান জেলার নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি অব্যাহত রয়েছে। বান্দরবান ও কক্সবাজারে বন্যা পরিস্থিতির গুরুতর অবনতি ঘটেছে। তুমুল বৃষ্টি,পাহাড়ি ঢল ও জোয়ারের পানিতে কক্সবাজারে নতুন করে বহু এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত জেলার সাতটি উপজেলার কমপক্ষে ৪৫টি ইউনিয়নের সাড়ে চার লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক বন্ধ হয়ে গেছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, বন্যা কবলিত এলাকাগুলোয় তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, অতিভারি বর্ষণ কমে আসলেও স্বল্প মেয়াদী এই বন্যা পরিস্থিতি সপ্তাহজুড়ে চলতে পারে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সহকারী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান জানিয়েছেন, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পার্বত্য অববাহিকা ও তৎসংলগ্ন উজানে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। অতিভারী বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমে আসলে এ অঞ্চলের প্রধান নদী সমূহের পানির সমতল ধীর গতিতে হ্রাস পেতে পারে। ফলে ফেনী, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও বান্দরবান জেলার নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। আগামী শুক্রবার নাগাদ ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীসমূহের পানির সমতল বৃদ্ধি পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। অন্যদিকে গঙ্গা-পদ্মা নদীসমুহের পানির সমতল স্থিতিশীল আছে, যা অব্যাহত থাকতে পারে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সব প্রধান নদীসমূহের পানি বাড়ছে। গতকাল সাঙ্গু নদীর পানি বান্দরবানে বিপদসীমার ৪১৩ সেন্টি মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ২৪ ঘণ্টায় বিপদসীমার ওপর ১৩০ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। মাতামুহুরী নদীর পানি লামায় বিপদসীমার ৩১৮ সেন্টি মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সাঙ্গু নদীর পানি চট্টগ্রামের দোহাজারীতে বিপদসীমার ৫৫ সেন্টি মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এখানে একদিনেই ৪৭ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে। আবহাওয়া সংস্থাসমুহের তথ্য অনুযায়ী, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। ফলে এ অঞ্চলের প্রধান নদ-নদীসমূহ-সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, খোয়াই, সারিগোয়াইন, ঝালুখালি, ভোগাই-কংশ, সোমেশ্বরী, যদুকাটার পানি সময় বিশেষে দ্রুত বাড়তে পারে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে,সিলেটে নদ-নদীর পানি বাড়লেও বন্যার আশঙ্কা ক্ষীণ।
বৃষ্টি কবে কমবে: এদিকে বাংলাদেশ ওয়েদার অবজারভেশন টিম জানিয়েছে, আগামী দুই দিন তুমুল বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম বিভাগের প্রায় সকল নিচু এলাকা প্লাবিত হতে পারে। এবং শহরের অধিকাংশ স্থানে জলাবদ্ধতা তৈরি হতে পারে। যদিও অনেক এলাকায় ইতোমধ্যে স্বল্প মেয়াদী বন্যা ও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। সেই সাথে পাহাড়ি অঞ্চলে পাহাড় ধ্বসের ঝুঁকি যথেষ্ট পরিমাণে বেড়েছে। আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশ আবহাওয়ার বিভিন্ন মডেল বিশ্লেষণ করে বলেন, আগামী ২ দিনে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার রাজ্যে অতিভারি বৃষ্টির প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।এই বৃষ্টিপাতের পুরোটাই গঙ্গা-পদ্মা নদী দিয়ে প্রবাহিত হবে। ফলে আশংকা করা যাচ্ছে যে ফারাক্কা বাঁধের সকল গেট খুলে দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। যার কারণে পদ্মানদীর চর এলাকাগুলো বন্যার পানিতে প্লাবিত হবে। অগ্রিম প্রস্তুতি নিয়ে রাখলে চর এলাকার মানুষদের সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, আবহাওয়ার পূর্বাভাস মডেলগুলোর পূর্বাভাস অনুসারে চট্টগ্রাম বিভাগে আগামীকালের পর থেকে ভারি বৃষ্টিপাত উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী বিভাগে শুক্রবারের পর এবং ঢাকা বিভাগে আজকের পর থেকে বৃষ্টিপাত কমতে থাকবে। তিনি বলেন,চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোর বন্যা পরিস্থিতি আগামী ২৪ ঘণ্টায় আরও অবনতি ঘটার প্রবল আশংকা করা যাচ্ছে।