টানা ছয় দিনের ভারী বৃষ্টিপাত, পাহাড়ি ঢল, জলাবদ্ধতা ও প্লাবনে চট্টগ্রাম মহানগরীর ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। নগরীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ এলাকা ভারী বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেলে ঐসব এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। খাতুনগঞ্জে এ পরিস্থিতিতে দোকান-আড়তে পানি ঢুকে পণ্য বিনষ্টসহ সার্বিক অচলাবস্থায় প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সূত্রের দাবি। এছাড়া ৩ আগস্ট রাত থেকে টানা ছয় দিন বৃষ্টি, জোয়ারের পানিতে নগরীর অর্ধশত এলাকার ঘরবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট তলিয়ে গিয়ে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকারও বেশি হবে বলে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা প্রাথমিক হিসাবে মনে করছেন।
এবারের ভারী বৃষ্টি, জোয়ার ও জলাবদ্ধতায় নগরীর বাকলিয়া, চান্দগাঁও, বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, নাসিরাবাদ সিডিএ অ্যাভিনিউ, অক্সিজেন, চকবাজার, আগ্রাবাদ, হালিশহরসহ নগরীর বিস্তীর্ণ নিচু এলাকার প্রায় ২০০ কিলোমিটার ছোটবড় সড়ক এবং লেন-বাইলেন ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো মনে করছে। তবে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত হিসাব প্রণয়নে সেবা সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা সরেজমিন কাজ করছেন বলে তারা জানান।
এদিকে শিগিগর অন্য সংস্থাগুলোর সঙ্গে বসে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানে করণীয় নির্ধারণ করবেন বলে জানিয়েছেন মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ভারী বর্ষণ, জলাবদ্ধতা ও পাহাড়ি ঢলে মহানগরীর বিস্তীর্ণ নিচু অঞ্চলসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়া, সাতকানিয়া, চন্দনাইশ ও লোহাগাড়া উপজেলার সর্বমোট ৫ লাখ মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদের মধ্যে মহানগরীর ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দা রয়েছেন ২ লাখেরও বেশি। জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, পাহাড়ি ঢলে ১৮ হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্প চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
রেল পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, বৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল ও বন্যার কারণে চট্টগ্রাম-নাজিরহাট লাইনের ডেমো ট্রেন সার্ভিস এখনো বন্ধ রয়েছে। অন্যদিকে কালুরঘাট ব্রিজের সংস্কারকাজ ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়ায় তখন থেকে চট্টগ্রাম দোহাজারি লাইনের ডেমো ট্রেন চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেন সার্ভিস আবারও চালু করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদা অনুসারে শাটল ট্রেনগুলো চলছে। বৃষ্টি-বন্যায় রেল পূর্বাঞ্চলের তেমন কোনো ক্ষতি হয় নি বলেও তিনি জানান।
চট্টগ্রাম দোহাজারি-কক্সবাজার রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, সাতকানিয়া অংশের ২১ কিলোমিটারে এই রেল ট্র্যাকের তিন কিলোমিটার জায়গার ওপর দিয়ে বান্দরবান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি গড়িয়ে গেছে। এতে রেল ট্র্যাকের মাত্র ১ কিলোমিটার অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমি সরেজমিনে পরিদর্শন করেছি। ক্ষতি সামান্য। ঠিকাদাররা দ্রুত সারিয়ে নিতে পারবেন। রেল ট্র্যাকের পশ্চিম পাশের নালা খালগুলো আরো প্রশস্ত ও গভীর করা দরকার। এবার এগুলো দিয়ে দ্রুত পানি সরে যায়নি বলে এখনো জলাবদ্ধতা দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, প্রকল্পের কাজ ৮৭ শতাংশ সম্পন্ন। সেপ্টেম্বরে ট্রায়াল হবে। আশা করছি, আগামী অক্টোবরের মাঝামাঝি এই রেলপথ উদ্বোধন হবে।
খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের জেনারেল সেক্রেটারি সৈয়দ ছগির আহমদ বলেন, প্রথম ধাক্কায় বৃহস্পতিবার রাতে খাতুনগঞ্জের বেশ কিছু আড়ত ও দোকানপাটে জোয়ারের পানি ঢুকে পড়েছিল। তবে এবার খালের মুখের স্লুইস গেট প্রথমবারের মতো চালু করে পরদিন খালের মুখ আটকে দেওয়া হয়। এতে বাণিজ্যিক কেন্দ্র চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ উঁচু জোয়ারজনিত ক্ষতি থেকে রক্ষা পায়। আর ক্ষতির যে আর্থিক হিসাব তা সামগ্রিক। এ সময় ব্যবসা-বানিজ্য চলেনি। পণ্য আসেনি। পণ্য ডেলিভারিও হয়নি।
চট্টগ্রামে সামান্য বৃষ্টিতেই সড়কগুলো মরণফাঁদ
চট্টগ্রামে সামান্য বৃষ্টিতেই সড়কগুলো মরণফাঁদে পরিণত হয়। নগরীর অনেক রাস্তার পাশেই অরক্ষিত খাল এবং নালা রয়েছে। বৃষ্টির সময় খাল ও নালার সঙ্গে রাস্তা একাকার হয়ে গিয়ে ভয়ংকর বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এছাড়া অনেক জায়গায় ফুটপাতে ঢাকনাবিহীন ম্যানহোল আছে যেখানে অসাবধানতাবশত পড়ে গিয়ে প্রায়ই হতাহতের ঘটনা ঘটছে। জানা গেছে, চট্টগ্রামে গত সাত বছরে অরক্ষিত নালা ও খালে পড়ে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২০২১ সালে সর্বোচ্চ চার জন এভাবে মারা যায়। ঐ বছর ২৫ আগস্ট মুরাদপুরে খালে পড়ে নিখোঁজ হন সালেহ আহমেদ নামে এক ব্যক্তি। ৭ ডিসেম্বর ষোলশহর এলাকায় চশমা খালে পড়ে মারা যায় কামাল উদ্দিন নামে এক শিশু। নিখোঁজের তিন দিন পর তার লাশ উদ্ধার হয়। ২৭ সেপ্টেম্বর আগ্রাবাদ মোড়ে নালায় পড়ে আন্তর্জাতিক ইসলামিক ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী শেহেরিন মাহমুদ সাদিয়া মারা যান। ৩০ জুন ষোলশহরের চশমা খালে পড়ে অটোরিকশা আরোহী তিন জন নিখোঁজ হন। পরে চালক সুলতান ও যাত্রী খাদিজা বেগমের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ বছরও এ পর্যন্ত নালায় পড়ে দুজনের মৃত্যু হয়েছে।
লোহাগাড়ায় ২ হাজার কাঁচা ঘর বিধ্বস্ত
লোহাগাড়া (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, ভারী বর্ষণ ও ঢলে চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার ৯ ইউনিয়নে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। উপজেলার প্রায় ২ হাজার কাঁচা বাড়িঘর বিধ্বস্তসহ গ্রামীণ রাস্তাঘাট লন্ডভন্ড হয়েছে। বহু গ্রামীণ সংযোগ সড়কের কালভার্ট ধসে গ্রামীণ যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এছাড়া মাছের প্রজেক্ট, আবাদকৃত কৃষিজমি, বীজতলা ও পোলট্রি খামার তলিয়ে গিয়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে। অপরদিকে, উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে প্রায় শতকরা ৬০-৭০ পরিবারের বাড়িঘর বন্যার পানিতে তলিয়ে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংসের এসব চিহ্ন ফুটে উঠছে। উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের এসব তথ্য উপজেলার সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইউপি চেয়ারম্যানরা।
আনোয়ারায় ৪০ গ্রাম প্লাবিত
আনোয়ারা (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, টানা বৃষ্টি ও ঢলের পানিতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার রূপ দেখেছে দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষ। টানা ভারী বৃষ্টির কারণে প্লাবিত হয়েছে আনোয়ারার অন্তত ৪০টি গ্রাম। এদিকে বুধবার থেকে ভারী বৃষ্টি বন্ধ হলেও বৃহস্পতিবার ভোর থেকে ধীরগতিতে নামতে শুরু করেছে পানি। তবে শুক্রবার সকাল থেকে আবারও বৃষ্টি শুরু হয়। এদিকে প্লাবিত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বন্যার পানি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করলেও বেরিয়ে আসছে ক্ষতচিহ্ন। প্রায় সাত দিনের বৃষ্টি ও বন্যার পানিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে মত্স্যজীবীদের। এছাড়া স্রোতে ধসে পড়েছে বহু বাড়িঘর, ভেঙে গেছে গ্রামীণ সড়ক, ভেসে গেছে গবাদিপশু, পুকুরের মাছ। পানিতে ডুবে ও স্রোতে ভেসে মৃত্যু হয়েছে তিন জনের।
বান্দরবানে খাবার পানির সংকট
বান্দরবান প্রতিনিধি জানান,বান্দরবান জেলার বিভিন্ন সড়ক, অফিস, ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসছে ভয়াবহ বন্যার ক্ষতচিহ্ন। পাঁচ দিন পর বিদ্যুত্ ব্যবস্থা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলেও অনেক স্থানে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। মোবাইল নেটওয়ার্ক স্বাভাবিক হয়নি। দেখা দিয়েছে ব্যবহার ও খাবার পানির সংকট। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী অনুপম দে জানান, বিদ্যুত্ না থাকায় পানি সরবরাহের প্ল্যান্টগুলো চালু করা যাচ্ছে না। তবে খুব তাড়াতাড়ি পানি সরবরাহের চেষ্টা চলছে। বিদ্যুৎনা থাকায় ডিপ টিওবয়েল থেকে পানি তোলা যাচ্ছে না। নদীর পানি অস্বাভাবিক ঘোলা ও পলিমাটিযুক্ত থাকায় সে পানিও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। দুই দিন ধরে সেনাবাহিনী বিশুদ্ধকরণ যন্ত্রের সাহায্যে শহরের বিভিন্ন এলাকায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। রাতের আঁধারেও সেনাবাহিনী রান্না করা ও শুকনো খাবার বিতরণ চালিয়ে যাচ্ছে। শহরের অনেক ব্যবসায়ী এখনো তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালু করতে পারেননি। বন্যাদুর্গত মানুষ ও খেটে খাওয়া জনগণের অবস্থা খুবই নাজুক।