বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার প্রথম, বিদ্যুৎ আবিষ্কার দ্বিতীয় এবং ইন্টারনেট আবিষ্কারের পর তৃতীয় ধাপে ব্যাপক শিল্পায়নের ফলে মানবসভ্যতার গতিপথে বিশাল পরিবর্তন সাধিত হয়। এসব শিল্পবিপ্লবের ভিত্তিমূলের সঙ্গে নতুন নতুন প্রযুক্তি যুক্ত হয়ে ব্যাপক পরিসরে দ্রুত বিকাশমান ডিজিটাল বিপ্লবকে বলা হচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব (বা ইন্ডাস্ট্রি ৪.০) হলো আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত উৎপাদন এবং শিল্পব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয়করণের একটি চলমান প্রক্রিয়া। স্বয়ংক্রিয়করণ, উন্নত যোগাযোগ এবং স্বপর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা এবং মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই সমস্যার বিশ্লেষণ এবং নিরূপণ করতে সক্ষম স্মার্ট মেশিন তৈরি করার জন্য বড় আকারে মেশিন-টু-মেশিন যোগাযোগ (এমটুএম) এবং ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি)-কে একসঙ্গে করা হয়েছে। উল্লিখিত বিষয়সমূহের বাইরেও আরও অনেক দ্রুত পরিবর্তনশীল বিষয়ের সম্পৃক্ততা ঘটতে যাচ্ছে। যান্ত্রিকতার চাপে অনেক সময় মানবিক উৎকর্ষসাধন বাধাগ্রস্ত হয়, এ বিষয়টিকে বিবেচনায় রেখে কল্পনাশক্তি সম্পৃক্ত এবং উদ্ভাবনমুখী ও মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন জ্ঞান ও গবেষণানির্ভর জনসম্পদ তৈরির প্রয়োজনীয় শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলন অত্যন্ত জরুরি।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য শুধু বিভিন্ন বিষয় ও আধুনিক বিজ্ঞানের বহুশাস্ত্রীয় ক্ষেত্র তৈরি নয়, এর সঙ্গে বায়োটেকনোলজি, ন্যানোটেকনোলজি, আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়গুলো পরিচালনার জন্য বিভিন্ন স্কিল ডেভেলপমেন্টে মানবিক দক্ষ জনবল, অবকাঠামো তৈরিও অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের হাত ধরে শিক্ষাব্যবস্থায় হলোগ্রাফিক টেকনোলজি সম্পৃক্ত করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। যার ফলে ভিজ্যুয়াল ইমেজের মাধ্যমে যে কোনো বিষয়কে জীবন্ত করে শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপনের জন্য আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এ টেকনোলজির সুবিধা হলো—যে কোনো জটিল মানবদেহের অপারেশন থেকে শুরু করে পরিবেশগত বিভিন্ন জটিল বিষয়, স্ট্রাকচারাল ডিজাইন, অটোমোটিভ ও অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রির বিভিন্ন ধারণাকে ত্রিমাত্রিক ছবির মাধ্যমে সহজে বোধগম্য করে শিক্ষার্থীদের ব্যাবহারিক জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। বর্তমানে ইলেকট্রিক কারের ব্যবহার বাড়ছে। এই ইলেকট্রিক কারের শক্তির জোগান দিচ্ছে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপকরণ ও প্রিডিকশন মডেল ব্যবহার করে এই লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির কার্যক্ষমতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা চলছে।
প্রকৃতিতে কার্বন নিঃসারণকে দুই ভাবে দেখা যেতে পারে। এর মধ্যে কার্বন নিঃসারণ প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়েছে। আবার প্রতিদিন জ্বালানি থেকে উদ্ভূত কার্বন নিঃসারণও হচ্ছে। এ কারণে কার্বন নিঃসারণের প্রভাবকে কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। তবে সমস্যা হচ্ছে যে, নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদনক্ষমতা আমরা সাধারণত যে জ্বালানি ব্যবহার করছি তাদের থেকে অনেক কম। এখানেও এক ধরনের চ্যালেঞ্জের বিষয়টি সম্পৃক্ত রয়েছে। এই ধরনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার ক্ষেত্রে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বহুমাত্রিক ধারণা প্রয়োগ করে শিক্ষা কারিকুলামে এগুলোকে যুক্ত করা দরকার। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিষয়সমূহ অতি দ্রুততার সঙ্গে কারিকুলামে সম্পৃক্ত করার ব্যবস্থা থাকতে হবে, যাতে করে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নিজেদের আরও দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারে। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের সরাসরি ও অনলাইন এই দুই পদ্ধতিতে পাঠদান করা হয়। কিন্তু অনলাইনে পাঠদানের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বহুমাত্রিক ধারণা প্রয়োগ করে সেগুলো সমাধান করে অধিকতর ফলপ্রসূ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। আমাদের সেসব সুবিধাগুলো কাজে লাগাতে হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিক্ষা ব্যবস্থার গুণমান সময়োপযোগী ও আধুনিকায়নের লক্ষ্যে শিক্ষাব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার ক্ষেত্রে মৌলিক ও বাস্তবধর্মী এবং অগ্রসরমাণ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানবিক অগ্রগতির বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কারণ উচ্চশিক্ষায় উন্নত ও উদার মানসিকতা শিক্ষাকে কল্যাণমুখী করে গড়ে তোলে। মানবিক উন্নয়ন ছাড়া প্রযুক্তির উন্নয়ন ও এর প্রভাব কখনো সাসটেইনেবল করা সম্ভব নয়। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আলোকে এথিকসের মতো বিষয়টিতে পরিবর্তন আনা দরকার, যাতে করে উচ্চশিক্ষায় চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাবকে ইতিবাচকভাবে মানবকল্যাণে ব্যবহার করা যায়। মানবিক অগ্রগতি বলতে মানুষের উদার চিন্তা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, সংস্কৃতিকে ধারণ, মানবিক মূল্যবোধ ও আচরণগত বৈশিষ্ট্যকে বোঝানো হয়েছে। সাধারণভাবে বিবেচনা করা হয়, প্রযুক্তির উৎকর্ষ ঘটলে মানুষের এই বৈশিষ্ট্যগুলো ইতিবাচকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠবে। কিন্তু এই জায়গাটিতে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বাস্তবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আরও বেশি কার্যকর হয়ে উঠবে, যদি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রত্যেকটি উপাদানের সঙ্গে মানবিক অগ্রগতি ও কল্যাণের বিষয়টিকে সম্পৃক্ত করা হয়। এখানে একধরনের ভারসাম্য দরকার। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রেও এই ভারসাম্যের বিষয়টিকে বিবেচনায় আনতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, কোনো নতুন উদ্ভাবনের সঙ্গে চিন্তার বৈচিত্র্যের সম্পর্ক রয়েছে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি শিল্পচর্চার মাধ্যমে চিন্তার চর্চা করে গেছেন। যে কোনো চিন্তার জন্ম হয় মানুষের কল্পনা করার শক্তি অর্জনের মাধ্যমে। এখন থেকে প্রায় ৫৫০ বছর আগে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি উদ্ভাবন, চারুকলা, ভাস্কর্য, স্থাপত্যবিদ্যা, বিজ্ঞান, সংগীত, গণিত, প্রকৌশলবিদ্যা, সাহিত্য, অ্যানাটমি, ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যা, উদ্ভিদবিজ্ঞান, ইতিহাস ও মানচিত্রাঙ্কন চর্চা করে গেছেন কলা ও বিজ্ঞানের সমন্বয় ঘটিয়ে। কলাবিদ্যার বিষয়টিকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপাদানগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত করে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণাকে আরও বেশি উদ্ভাবনমুখী ও সৃজনশীল করা সম্ভব। একজন মানুষের মধ্যে বহুমাত্রিকতা ও কয়েক জন মানুষের ভিন্ন ভিন্ন বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের সম্মিলিত প্রভাবে বহুমাত্রিকতা সৃষ্টিতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বহুমাত্রিকতার এই ধারণা উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা দরকার। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের জ্ঞান এখন কেবল শিক্ষার একটি শাখার জন্য প্রযোজ্য নয় বরং কলা, বিজ্ঞানসহ সব শাখায় এর ভূমিকা রয়েছে। আগে গবেষণা করার ক্ষেত্রে অনেক বেশি পরীক্ষানিরীক্ষা করতে হতো; কিন্তু এখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্সের বিভিন্ন মেথড প্রয়োগ করে আগে থেকেই জানা যায় কত কমসংখ্যক পরীক্ষানিরীক্ষা করে বেশি ফলাফল পাওয়া যায়। ক্যানসার গবেষণার সাম্প্রতিক সাফল্যে এই অ্যানালাইসিসগুলো অনেক বেশি কার্যকর হয়েছে। কোভিড-১৯-এর চিকিৎসার ক্ষেত্রেও এগুলোর ভূমিকা রয়েছে। শিক্ষা ও গবেষণার একটি মূল উপাদান হলো অপটিমাইজড কন্ডিশনগুলো বের করা, যাতে করে যে কোনো ধরনের নতুন উদ্ভাবনে তা এফিসিয়েন্ট ও কস্ট এফেক্টিভ হয়।
প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের মাধ্যমে মানবসভ্যতা ক্রমাগত বিকশিত হচ্ছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানকে একটি অটোমেশন পদ্ধতির মাধ্যমে অর্থাৎ পণ্যের উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল সংগ্রহ থেকে পণ্যের প্রস্তুত, গুণমান যাচাই, শিপিং, মার্কেটিং পর্যন্ত ডিজিটালাইজেশনের প্রভাব অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে মানবজাতির জীবনযাপন, কাজ এবং একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমরা একটি নতুন মাত্রা দেখতে পাচ্ছি। ফলে আগামী কয়েক বছর অর্থনীতি এবং শিল্পসহ সবক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়বে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উৎকর্ষসাধনেও বিভিন্ন ধরনের উদ্ভাবনে প্রকৌশল ও প্রযুক্তিগত সেক্টরে ইন্টিগ্রেটেড রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্টের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যে কোনো জাতির কর্মদক্ষতা, জ্ঞান, গবেষণা ও উদ্ভাবন হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে আগামী কয়েক বছর অর্থনীতি এবং শিল্পসহ সবক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়বে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উৎকর্ষসাধনে মেকাট্রনিকস, ন্যানোটেকনোলজি, নতুন নতুন ম্যাটেরিয়াল উদ্ভাবন এবং কম্পিউটার এইডেড ডিজাইনসহ বিভিন্ন ধরনের উদ্ভাবনের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে সমস্যাগুলো সমাধান করে দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।