১২ নভেম্বর সত্তরের বন্যা-উত্তর ত্রাণ পুনর্বাসন জেলে কৃষি, বিশ্বগ্রাম হাউজিং, সমবায় সমিতি গঠন অবস্থান অগ্রগতি নিয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যাকালীন আসরে বসতাম। স্থান চর আলেকজান্ডার বাজার, থানা রামগতি, জেলা নোয়াখালী। বর্তমানে লক্ষ্মীপুর। আসরলিপির মধ্যে ৭ মার্চ ভাষণের পরবর্তী দিনগুলো মুক্তির রাজনৈতিক ক্ষুরধারা নিয়েও আলোচনা হতো। পুনর্বাসন উৎপাদন মুক্তি একাকার হয়ে গেল। ২৬ মার্চ ভাসা ভাসা কাটা কাটা শব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণা শুনতে পেয়েই উপস্থিত স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সমবায়ী জনতা তাৎক্ষণিক আমিসহ ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিয়ে মিছিল বের হলো। বাজারের চতুর্দিক থেকে লোক সমাগম হতে লাগল। ইতিমধ্যে সরকারের রিলিফ কমিশনার সিএসপি আবদুর রব চৌধুরীর নিজ বাড়ি সেবা গ্রাম থেকে মিছিলে এসে অগ্রভাগে থেকে বাজার প্রদক্ষিণ করা হলো।
২৮ মার্চ হঠাৎ বহদ্দার হাট নদী-স্টিমার ঘাট থেকে একদল কৃষক জেলে হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে সকাল ৯-১০টা, স্কুল মাঠে এসে জানান দিল স্টিমারে ভর্তি পাকিস্তানি বাহিনী, প্রায় কাছে এসে গেছে। ভয় বিহ্বল কিন্তু সাহসী জনতাকে গাইড করা হলো। লাঠিসোঁটা, সেল, মরিচের গুঁড়া, নিয়ে প্রতিরোধ করতে হবে, যাতে স্টিমার তীরে না ভিড়তে পারে। যার যা আছে যে যেভাবে ছিল তাই নিয়েই মেজর লতিফ তাজল ওসি আজিউল্ল্যা মিয়া, আমিসহ শত শত লোক বহদ্দার হাট ঘাটের দিকে ছুটে যাচ্ছি আর যাচ্ছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘাট পাড়ে এক নৌকা বোঝাই লোক ও মাঝিসহ জানাল, এরা চট্টগ্রাম থেকে যুদ্ধ ঘোষণা শুনে যে যার মতো দেশ গ্রামে ভোলা-বরিশাল-লক্ষ্মীপুর-নোয়াখালীর লোকেরা চলে আসা ঢলের এক অংশ। প্রায় ৪০০-৫০০ যাত্রী বহদ্দারহাট নামলে অস্থানীয় এদের আমরা চর আলেকজান্ডার প্রাইমারি স্কুলে থাকার জায়গা ও দুই-তিন দিন পর্যন্ত খানাপিনার ব্যবস্থা করা হলো।
অন্যপক্ষে শান্তি কমিটি রাজাকার বাহিনী সংগঠিত হতে লাগল। মুসলিম লীগের রামগতি থানা সেক্রেটারি আইয়ুব খান আমলের টি কে (তমগায়ে খেদমত) উপাধিধারী চর আলেকজান্ডার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও থানা শান্তি কমিটির সেক্রেটারি মো. নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে কিছু টাউট, লুটপাটকারী, খারাপ প্রকৃতির লোক রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিচ্ছে। ভিন্ন স্রোতে চর রমিজ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজাদ মিয়া আরেক টি কে খেতাবপ্রাপ্ত রাগগতি থানা মুসলিম লীগ সভাপতি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
২৭ মার্চ আলেকজান্ডার বিকালেই হাইস্কুল মাঠে সংগ্রামী জনতার মুক্তির জাগরণী সমাগম হয়। থানা আওয়ামী লীগ সেক্রেটারি অজিউল্ল্যা মিয়া, ইপিআর থেকে চাকরি ছাড়া মোল্লা বাড়ির মেজর লতিফ নামে পরিচিত অবসর নেওয়া পুলিশ কর্মকর্তা, পণ্ডিত বাড়ির তাজল মিয়া, তাজল ওসি নামে স্থানীয় ভাবে সুপরিচিত প্রমুখ পাকিস্তানি হানাদারদের প্রতিরোধ কৌশল, প্রশিক্ষণ, অগোছাল কিন্তু জরুরি পরিকল্পনার সবই এ সমাগমে স্থান পায়। সভায় যুবকদের প্রশিক্ষণ এবং যুদ্ধকালীন খাদ্য নিরাপত্তার প্রয়োজনেই উৎপাদন চাষাবাদ ধারাবাহিকতা রাখার গুরুত্ব দেওয়া হয়। লাঠি, সেল, শুলকি, মরিচের গুঁড়া প্রস্তুত রাখার কথাও বলেন। রাতে যুদ্ধে প্রস্তুতির সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন কর্মকাণ্ড চলমান রাখার তাগিদে গোলাম হোসেন লাহাড়ির বাজার ঘরে চর কালকিনিসহ সারা থানায় শীতকালীন সবজি, আলু, বাদাম, সোয়াবিনসহ ইরি চাষ অগ্রগতি, বিশ্বগ্রাম ২৫ একর করে দুটি ব্লকে ২০০ পরিবারের জন্য জমির প্রাপ্যতা অগ্রগতি জানালেন কেন্দ্রীয় সমবায় সভাপতি আবদুর রব খন্দকার। সমবায়ের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আমার প্রশ্নে হাজি আলী হোসেন উত্তরে জানালেন, বিশ্বগ্রামে অজিউল্ল্যাহ মিয়া পরিবারদের জমি, গভর্নর হাউজে চাকরিরত চর আবদুল্ল্যাহ ভুইয়া বাড়ির ইয়াছিন ভুইয়াদের ৩ ভাইর (৭০-এর ১২ নভেম্বর জলোচ্ছ্বাসে তাদের পিতাসহ অনেকেই মারা যান) জমিপ্রাপ্ত হয়ে নক্সা অনুযায়ী ঘর ভিটি তৈরির কাজ চলছে। দুটি টিউবওয়েল, লেট্রিন ও আশ্রয়ের জন্য তাঁবু স্থাপন, চর আবদুল্লাহ থেকে আমিসহ হাজীরহাট বাজার থেকে মসজিদের জন্য ভাঙাচোরা সামগ্রী সংগ্রহ হয়েছে ইত্যাদি….। ছেলেমেয়ে পরিবারসহ জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে নেওয়া হাজি আলী হোসেনই আজিমপুর কলোনির (?) মতো যা পরবর্তী সময় বিশ্বব্যাংক কর্মচারীদের অর্থ সহায়তায় ‘বিশ্বগ্রাম’ নামে পরিচিত হয়, যার নমুনা নকশা দেখান এবং এর ডিজাইন রূপান্তর হয়ে বাস্তবায়ন হয়।
অন্যদিকে রামগতি থানার পূর্ব বর্ডারে সুধারাম থানার চর জব্বারের ভাটিরটেকে গুচ্ছগ্রাম করার লক্ষ্যে খাসজমি খোঁজ কাজ চলছিল। চর গাজী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা, হাতে লাঠি, খাসজমি খোঁজার উদ্যোক্তা মীর মোহাম্মদ মিয়া হতবিহ্বল হয়ে চর আলেকজান্ডার এসে জানালেন, ‘বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা জানার সঙ্গে সঙ্গে ভাটিরটেকে মিটিংরত জনসমাগমে অবস্থানরত স্বেচ্ছায় পাকিস্তান সরকার থেকে পদত্যাগী এক আমলা উচ্চস্বরে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে ভাটিরটেকের নাম এ মুহূর্ত থেকে ‘স্বাধীন গ্রাম’ ঘোষণা দিলেন। মুক্তিযুদ্ধ ও উৎপাদন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। নোয়াখালী জেলা প্রশাসক মনযূর-উল করীম সিএসপি প্রেরিত এক ম্যাজিস্ট্রেটের লাল জিপগাড়ি করে ‘জয় বাংলা’ প্রতিধ্বনি দিতে দিতে দ্রুত মাইজদী সদরে ফিরে যান।…। ‘স্বাধীন গ্রাম’ ২৬ মার্চের অন্যতম স্মারক। এই গ্রামকে ঘিরে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সরকারের আমলে (১৯৯৬) বিশাল আশ্রয়ণ প্রকল্প স্থাপিত হয়।
১২ নভেম্বর ১৯৭০, জলোচ্ছ্বাসে চর আবদুল্ল্যার অসহায় আশ্রয়হীনদের নিয়ে ‘বিশ্বগ্রাম’ (গুচ্ছগ্রাম) স্থাপন নিয়ে কাজ চলছিল। সে সময় বৃহত্তর রামগতি থানাব্যাপী কোনো ব্যাংক শাখা ছিল না। নোয়াখালী ব্যাংক থেকে টাকা সংগ্রহের আশায় রাতে মাইজদী শহরে অফিসার্স কলোনিতে অ্যাসিসট্যান্ট রেজিস্টার অব কো-অপারেটিভ সোসাইটিস (এআরসিএস) আবদুল গনি সাহেবের বাসায় ২৯-৩০ মার্চ অবস্থান করি। জেলা প্রশাসন রেস্ট হাউজ ইতিমধ্যে পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনী দখল করে নিয়েছে। শহরে টহল দিচ্ছে। সতর্ক নজরদারিতে পরিস্থিতি দেখছে। পাকিস্তানি সরকার টাকা অচল করে দেওয়ায় আমার কাছে দুই টাকা ছিল, গনি সাহেব থেকে ৫০ টাকা নিয়ে সোনাপুর চেউয়াখালী হয়ে বাইগ্যার দোনা খেয়া নদী পার হয়ে হাজীগঞ্জ টং দোকান পথে দীর্ঘ কাঁচা বালু ভাঙা রাস্তা পাড়ি দিয়ে ভয়ভীতির মধ্যে আলেকজান্ডার বাসায় পৌঁছি।
মুক্তিযুদ্ধকালীন কাজ বন্ধ থাকায় পরিস্থিতি বেগতিক হতে লাগল। আলেকজান্ডার বাজারের উত্তর পাশে আমরা যুবকদের ‘মিতালী’ সংঘে ইনফরমেশন সেন্টার খুলে ত্রাণ-পুনর্বাসনে আসা দেশি-বিদেশিদের বিধ্বস্ত এলাকা চিহ্নিত ও প্রয়োজনাদি সরবরাহ প্রদানে সহায়তা করতাম। ১০-১৫ দিনের মাথায় স্থানীয় ওয়াপদা রেস্ট হাউজে ক্যাম্প করে থাকা রাজাকারদের হিংস্র দুই-তিন জন রাস্তায় নজরদারি রাখল। যে-ই আমার অফিসের সহকারী ভোমা (রফিকুল ইসলাম) মিতালী কার্যালয়ে আসতেছিল পথে দাঁড় করিয়ে জিগ্যেস করে, ‘এই বেটা শা নোমান সাহেবের সেখানে কী করছ্? উনি কি গুটি চালাচালি করে? আয় এই কথা বলে ধাক্কাতে ধাক্কাতে রাস্তার পশ্চিম পাশের খাল পাড়ে নিয়ে হাঁটুপানিতে নামিয়ে গুলি করে স্রোত খালে ফেলে দিল। ভাসতে ভাসতে পাশ গ্রামে লাশ দেখা যায়। ভোমার বাবা হাবিব ব্যাপারী দূর পথ দিয়ে ঘুরে দৌড়াতে দৌড়াতে পেছন দিক থেকে আমাদের পুকুর পাড়ের বাসায় আব্বা-আম্মাকে জানান দিল, ‘তাড়াতাড়ি ভাইকে এখান থেকে সরাইয়া দেন। এখনই বাসা থেকে চলে যেতে বলেন। ওরা ভাইকে (আমাকে) মেরে ফেলবে আরো যেন কী বলল ও দৌড়ে চলে গেল।’ প্রায় সন্ধ্যা, তাড়াতাড়ি আমার স্ত্রী ও একমাত্র বোনকে নিয়ে পশ্চিমে আসলপাড়ায় নানি পাটোয়ারি বাড়ি গিয়ে রাতে রইলাম। পরদিন সকালে বহদ্দারহাট নৌকা ঘাটে গিয়ে পাল তোলা দাঁড় টানা নৌকায় মেঘনার পশ্চিম পাড়ে জন্মস্থান ভোলা মহকুমা দৌলত খাঁ থানার হাজীপুর গ্রামের জগাপাতা ঘাটে পৌঁছি। এক মাইল দক্ষিণে একই নানা-দাদা বাড়ি আশ্রয় নিই। যে মাটি কোলেপিঠে করে রেখেছিল শিশু কৈশোরে, সেই মাটি যৌবনে আবার আগলে রাখল পাকিস্তানি হায়েনাদের কাছ থেকে, মুক্তিযুদ্ধের ঘোর অমানিশার কিছু কাল।