একেবারে থেমে না গেলেও হারিয়ে গেছে বাংলা চলচ্চিত্রের সেই সোনালি সময়। সেই স্বর্ণালি দিন আবার ফিরে আসার প্রত্যাশায় যখন অনেকে আশায় বুক বাঁধছিলেন, তখন এক এক করে চলে যাচ্ছেন প্রথিতযশা অভিনেতা-অভিনেত্রীরা, চলচ্চিত্রাঙ্গনের প্রিয় মানুষেরা, প্রিয় তারকারা। ২০২২ সালে আমরা কিংবদন্তি গীতিকার, চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে হারিয়েছি। হারিয়েছি ঢাকাই সিনেমার জনপ্রিয় অভিনেত্রী শর্মিলী আহমেদকে। তার আগের বছর হারালাম শক্তিশালী অভিনেতা ও পরিচালক এ টি এম শামসুজ্জামান, বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরী, ঢাকাই সিনেমার একসময়ের জনপ্রিয় নায়ক ওয়াসিম, চলচ্চিত্র অভিনেতা শাহীনূর আলম শাহীন (শাহীন আলম) প্রমুখকে। এবার চলে গেলেন বাংলা চলচ্চিত্রের আরেক কিংবদন্তি অভিনেতা, সংসদ সদস্য ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেন পাঠান ফারুকও।
গতকাল সকালে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নায়ক ফারুকের মৃত্যু হয়েছে (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। মৃত্যুকালে তিনি রেখে গেছেন স্ত্রী ও দুই সন্তান। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, আজ মঙ্গলবার সকালে তার মরদেহ ঢাকায় আনা হবে। এরপর ঢাকায় সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন শেষে তাকে নিয়ে যাওয়া হবে গাজীপুরের কালীগঞ্জে। সেখানে বাবার কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হবে। কিংবদন্তি চিত্রনায়ক ফারুকের মৃত্যুর খবরে গতকাল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বর্তমান জনপ্রিয় নায়ক শাকিব খান। ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ‘যত দিন তিনি সুস্থ-সবল ছিলেন, তত দিন আমাকে স্নেহে আগলে রেখেছিলেন। আমার যে কোনো ভালো কাজ এবং ছবির পোস্টার কিংবা ট্রেলার রিলিজ দেখে তিনি নিজে থেকে অ্যাপ্রিসিয়েট করে গর্বিত হতেন। আমার কাছে শ্রদ্ধাভাজন এই মানুষটি ছিলেন চলচ্চিত্র অঙ্গনে প্রাজ্ঞজনদের একজন।’ নায়ক রাজ্জাকের পর তার মৃত্যুতে আমরা বাংলা চলচ্চিত্রের আরেক জন আদর্শ অভিভাবককে হারালাম।
অভিনেতা ফারুক ১৯৪৮ সালের ১৮ আগস্ট ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। এইচ আকবর পরিচালিত ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে ঢাকাই সিনেমায় তাঁর অভিষেক। প্রথম সিনেমায় তাঁর বিপরীতে ছিলেন কবরী। এরপর ১৯৭৩ সালে খান আতাউর রহমানের পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘আবার তোরা মানুষ হ’ এবং ১৯৭৪ সালে নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘আলোর মিছিল’ দুটি সিনেমায় পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। পাঁচ দশকের বেশি সময়ের ক্যারিয়ারে অভিনয় করেন বহু দর্শকপ্রিয় চলচ্চিত্রে। ফারুকের অভিনীত ‘মিয়াভাই’ চলচ্চিত্রের সাফল্যের পর তিনি চলচ্চিত্রাঙ্গনে ‘মিয়াভাই’ হিসেবে খ্যাতি পান। তবে তাঁর আসল নাম আকবর হোসেন পাঠান দুলু। ‘ফারুক’ নামটি মূলত ছিল চলচ্চিত্র অঙ্গনের। অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামান, পরিচালক এইচ আকবর ও ফারুক নামে এক বন্ধু মিলে তাঁকে এই নাম দিয়েছিলেন। তাছাড়া ছয় দফা আন্দোলনের পর তিনি ওয়ান্টেড ছিলেন। এই নামের কারণে তাকে কেউ ধরবে না বলে অনেকের পরামর্শে তিনি এই নাম গ্রহণ করেন। ফারুক অভিনীত অন্যান্য সিনেমার মধ্যে রয়েছে :প্রমোদ কর পরিচালিত ‘সুজন সখী’ (১৯৭৫), নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত ‘লাঠিয়াল’ (১৯৭৫), আব্দুস সামাদ পরিচালিত ‘সূর্যগ্রহণ’ (১৯৭৬), আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘নয়নমনি’ (১৯৭৬), তাহের চৌধুরী পরিচালিত ‘মাটির মায়া’ (১৯৭৬), আবদুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত ‘সারেং বৌ’ (১৯৭৬), আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ প্রভৃতি। তিনি মূলত গ্রামীণ পটভূমির চলচ্চিত্রে অভিনয় করেই আলাদা পরিচিতি লাভ করেন।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ নানা সম্মাননায় ভূষিত হন নন্দিত এই চিত্রনায়ক। অভিনয় থেকে অবসর নেওয়ার পর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ঢাকা-১৭ আসন থেকে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। তবে রাজনীতিতে তিনি নতুন নন। চলচ্চিত্রে আসার আগে তিনি রাজনীতিকই ছিলেন। আরো স্পষ্ট করে বললে, রাজনীতিই তাকে চলচ্চিত্রজগতের দিকে ঠেলে দিয়েছে। কীভাবে? ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলনে অংশগ্রহণের সময় তার নামে একের পর এক মামলা হয়। সেই ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘আমার নামে হয়রানিমূলক ৩৬টি মামলা হয়। এগুলো থেকে বাঁচার জন্য আমার কিছু বন্ধুবান্ধব বলে, চলচ্চিত্রে ঢুকে যাও। এরপরই চলচ্চিত্রে আসি।’ তিনি সংসদ সদস্য ছাড়াও আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকটি অঙ্গসংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি।
নায়ক ফারুকের মৃত্যুতে তার শূন্যস্থান কখনো পূরণ হওয়ার নয়। তবে আমাদের চলচ্চিত্রের বর্তমান সংকটের সমাধান করে আমরা এর কিছুটা ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারি। ফিরিয়ে আনতে পারি চলচ্চিত্রের সুদিন। এজন্য চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে অন্য দেশের ছবির অনুকরণ না করে মৌলিক দেশ চলচ্চিত্রের বিকাশ ঘটাতে হবে। এমন জীবনঘনিষ্ঠ ও সামাজিক ছবি বেশি পরিমাণে তৈরি করতে হবে, যাতে পরিবার-পরিজন নিয়ে একসঙ্গে দেখা যায়। অবশ্য বর্তমানে স্বাধীন ধারার কিছু চলচ্চিত্র আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছে। তবে মনে রাখতে হবে, চলচ্চিত্র একই সঙ্গে আর্ট ও ইন্ডাস্ট্রি। তাই জনগণের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে চলচ্চিত্রের সংযোগ থাকতে হবে। মানসম্পন্ন ছবির সংকটেই পেক্ষাগৃহ কমছে। সেই প্রেক্ষাপটে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মান ও কন্টেন্ট নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। সাম্প্রতিককালের কিছু ছবি প্রশংসিত হলেও সিনেমা হলে সেভাবে বড় আকারে ব্যাবসায়িক সফলতা পাচ্ছে না। এতে প্রেক্ষাগৃহের মালিকেরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। প্রযোজকদেরও অনেকে হতাশ। এই স্থবিরতায় শিল্পীদের অনেকে দুঃসময় অতিবাহিত করছেন। এই হতাশা কাটিয়ে উঠতে হবে। সময়োপযোগী গল্পের অভাব ও নির্মাণের দুর্বলতা দূর করতে হবে। আমরা নায়ক ফারুকের মৃত্যুতে যারপরনাই মর্মাহত ও শোকাহত। শোকসন্তপ্ত তার সহকর্মী, অনুরাগী ও ভক্তদের প্রতি জানাই গভীর সমবেদনা। নায়ক ফারুক বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম একজন সফল ও সেরা নায়ক হিসেবেই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।