চাঁদের আরও কাছে চলে গেছে ভারত। চন্দ্রযান ৩ চলতি মাসেই পৌঁছাবে উপগ্রহের মাটিতে। দেশটির ১৪০ কোটি মানুষের স্বপ্ন কি এ বার পূরণ হবে?
চাঁদ নিয়ে পৃথিবীর রোমান্টিসিজমের শেষ নেই। কত কবিতা, গানের ডালিতে সাজানো চন্দ্রকলার মহিমা। কিন্তু বাস্তবে প্রাণহীন সেই উপগ্রহ কেমন, তা জানার আগ্রহে মানুষ চাঁদকে ছুঁতে চেয়েছে বারবার।
ভারতের আগ্রহও কম নয়। তাই ফের দেশীয় চন্দ্রযান উড়ে গিয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটার উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে। ১৪ জুলাই দুপুর ২টা ৩৫ মিনিটে চাঁদের উদ্দেশে তৃতীয় অভিযান শুরু করে ভারত।
এই প্রথম কোনো দেশের মহাকাশযান চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছাবে। একেবারে অজানা জগতের দরজা খুলে যেতে পারে এই অভিযানে।
চাঁদে পৌঁছাতে ৪০ দিনের মতো সময় লাগবে চন্দ্রযান ৩-এর। এর আগে চন্দ্রযান ১-এর সময় লেগেছিল ৭৭ দিন, চন্দ্রযান ২ সময় নিয়েছিল ৪৮ দিন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম মনুষ্যবাহী চন্দ্রযান অ্যাপোলো-১১ মাত্র চার দিনেই চাঁদে পৌঁছেছিল।
চন্দ্রযানের অতীত
২০০৮ সালে ভারত মহাকাশে পাঠায় চন্দ্রযান ১। এটি চাঁদকে প্রদক্ষিণ করেছিল। দুই বছর ছিল সেই অভিযানের মেয়াদ। কিন্তু ১০ মাস পর যানের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ওই যানের মধ্যে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় সম্ভবত এই বিপত্তি।
চাঁদে অভিযানের পরবর্তী প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল আরও বড়। চাঁদের মাটি ছোঁবে ল্যান্ডার, টহল দেবে রোভার। ২০১৯-এ পাঠানো হয় চন্দ্রযান ২। কিন্তু সেবার চাঁদের মাটিতে মহাকাশযানের অবতরণের শেষ মুহূর্তে ঘটে বিপর্যয়!
২.১ কিলোমিটার উচ্চতায় থাকার সময় যানের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তবে প্রদক্ষিণকারী যানটি এখনো চাঁদের কক্ষে ঘুরপাক খাচ্ছে। তথ্য পাঠাচ্ছে পৃথিবীতে।
ত্রুটি শুধরে অভিযান
কাপ আর ঠোঁটের মধ্যে ব্যবধান থেকে গিয়েছিল দ্বিতীয় অভিযানে। তাই এ বার আরও সাবধান ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো। চন্দ্রযান ৩-এর পরিকল্পনা করা হয়েছে আরও নিখুঁতভাবে। কী ধরণের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?
কলকাতার এমপি বিড়লা তারামণ্ডলের সাবেক অধিকর্তা ড. দেবীপ্রসাদ দুয়ারী বলেন, ‘অবতরণকারী যান বিক্রমের মধ্যে অন্তত আটটি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র রাখা হয়েছে। চাঁদের মাটি থেকে যানের দূরত্ব, অবতরণের জায়গার মাটি এবড়োখেবড়ো কি না, তা আগে বোঝা যাবে। ভেলোসিমিটার দিয়ে যানের গতিবেগ মাপা হবে প্রতি মুহূর্তে। নামার সময় গতিবেগ হবে মাত্র দুই মিটার প্রতি সেকেন্ড।’
মহাকাশবিজ্ঞানী সন্দীপ সেনগুপ্তের বক্তব্য, ‘গতবার অবতরণের সময় ভুল সিগন্যালের জেরে বেশি গতিতে চাঁদের বুকে ল্যান্ডার নেমে এসেছিল। তার ফলে বিপর্যয় ঘটে। এবার গতিবেগ বেড়ে গেলেও যাতে যান অটুট থাকে, সেদিকে লক্ষ্য রাখা হয়েছে। চন্দ্রযান ২-এর থেকে বেশি মজবুত করা হয়েছে এবারের ল্যান্ডারের পায়াগুলোকে।’
মহাকাশযানের সঙ্গে যাতে সংযোগ বিচ্ছিন্ন না হয়, সেজন্য একাধিক সতর্কতা নেওয়া হয়েছে। অবতরণের সময়টিই বলা চলে ইসরোর অগ্নিপরীক্ষা। ড. দুয়ারীর ভাষায়, ‘হেলিকপ্টার ও টাওয়ার ক্রেন থেকে নিচে ফেলা হয়েছে ল্যান্ডারকে। চাঁদের মাটির কৃত্রিম প্রতিরূপ তৈরি করে সেখানে নামানো হয়েছে যানকে, যাতে কার্যক্ষেত্রে সমস্যা না হয়।’
অভিযানের লক্ষ্য
চাঁদ থেকে কোনো নমুনা নিয়ে ফিরবে না চন্দ্রযান ৩। সেখানেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবে। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছে ল্যান্ডার ‘বিক্রম’-এর পেটের ভিতর থেকে বেরোবে রোভার ‘প্রজ্ঞান’। এই যান ১৪ দিন চাঁদে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করবে, পরিকল্পনা এমনই।
নানা প্রশ্ন ঘিরে কৌতূহলের পারদ ক্রমশ চড়ছে। দক্ষিণ মেরুতে পানি কি রয়েছে বরফের আকারে? কোনো মহামূল্যবান ধাতুর যদি খোঁজ মেলে? আর সেই রূপকথার চরকা কাটা বুড়ি! কী মিলতে পারে রহস্যে ঘেরা চন্দ্রকলায়?
জ্যোতির্বিজ্ঞানী সোমক রায়চৌধুরী বলেন, ‘চাঁদের দক্ষিণ গোলার্ধে যে জায়গায় সূর্যের আলো পড়ে না, সেখানে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের ২০০ ডিগ্রি নিচে। এই অংশে বরফের আকারে জল থাকতে পারে। উত্তর গোলার্ধের মাটি ও পাথর পৃথিবীতে এনে গবেষণা করেছে তিনটি দেশ। কিন্তু দক্ষিণ গোলার্ধ অনেকটাই অচেনা। সেখানকার মাটিতে কী খনিজ পদার্থ আছে, বাতাস কী দিয়ে তৈরি, মাটির তলায় কত তাপমাত্রা ইত্যাদি নানা তথ্য মিলতে পারে।’
নেপথ্যে বাঙালি
চন্দ্রযান ৩-এর ক্যামেরার নকশা তৈরি করেছেন বাঙালি বিজ্ঞানী অনুজ নন্দী। তিনি উত্তর দিনাজপুর জেলার ইসলামপুরের বাসিন্দা। এই বিজ্ঞানী ইসরোতে কর্মরত প্রায় আট বছর। তার নকশায় তৈরি ক্যামেরার চোখে চাঁদের নতুন রূপে দেখবে বিশ্ববাসী।
বাঙালির এই উদ্ভাবনী মস্তিষ্কের নমুনা মিলেছে পশ্চিম বর্ধমানের দুর্গাপুরে। এক যুবক চন্দ্রযানের রেপ্লিকা তৈরি করেছেন। তাতে জুড়েছেন তিনটি সিলিন্ডার। সেটি উড়িয়ে তিনি তাক লাগিয়ে দিয়েছেন স্থানীয়দের।
পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়ার বস্ত্র ব্যবসায়ীরা তৈরি করে ফেলেছেন টি-শার্ট। এতে ছাপা হয়েছে চন্দ্রযানের স্কেচ। সঙ্গে বার্তা, ‘আমরা ভারতীয় হিসেবে গর্বিত’। দেশের অন্য জায়গা থেকেও বরাত আসছে এই টি-শার্টের। সোশ্যাল মিডিয়ায় এর ছবি ছড়িয়ে পড়ার পর অনলাইনেও দেদার বিক্রি হচ্ছে।
চীনের সঙ্গে দৌড়ে
শীতল যুদ্ধের সময় মহাকাশে অভিযানের দৌড়ে শামিল হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। এই দুই পরাশক্তি ছাড়া চীনও চাঁদে সফল অভিযান চালিয়েছে। ২০২০ সালে বেইজিংয়ের ল্যান্ডার চাঁদ স্পর্শ করে। তার তিন বছরের মধ্যে আরো উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্পে কি ভারত টেক্কা দেবে চীনকে?
ড. দুয়ারী বলেন, ‘প্রতিটি বিজ্ঞান গবেষণা স্বকীয়। তাছাড়া মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে সহযোগিতাই বেশি দেখা যায়। আমাদের চন্দ্রযানের রোভারে নাসার যন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখনো চোখে পড়ছে না, ভবিষ্যতে এই প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে।’
আমজনতার স্বপ্ন
কবি পূর্ণিমার চাঁদে ঝলসানো রুটি দেখেছিলেন।
দরিদ্র ভারতবাসীর কাছে সবচেয়ে কাঙ্খিত স্বপ্ন তো এটাই! তাদের জীবনে কী তাৎপর্য এই প্রকল্পের যার জন্য ব্যয় ৬১৫ কোটি টাকা?
সোমক রায়চৌধুরী বলেন, ‘বিরাট কোহলি ছক্কা মারলে সারা দেশ যেমন হইহই করে ওঠে, তেমনি একটা গুঞ্জন শোনা গিয়েছে সেদিন দুপুর আড়াইটার চন্দ্রযান ৩ উৎক্ষেপণের সময়। আমাদের দেশে এত বড় একটা কাণ্ড হচ্ছে, এটা গর্বের ব্যাপার। একইসঙ্গে বিজ্ঞানের জন্য, মানবতার জন্য এটা ভারতের একটা বড় অবদান হয়ে থাকবে। দেশবাসী হিসেবে এটাই আমাদের প্রাপ্তি।’