জীবন ও জীবিকার তাগিদে নারীকে প্রতিনিয়ত ছুটতে হচ্ছে কর্মস্থলে, অফিসে, আদালতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। আর এ যাত্রা পথে অর্থ সাশ্রয় করতে তারা গণপরিবহন ব্যবহার করছেন। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্য মতে, গণপরিবহনে যাতায়াতকারী এই নারীর সংখ্যা ৮৪ শতাংশ। অথচ এ গণপরিবহনগুলো আজো নারীবান্ধব হয়ে উঠল না। তাই হয়তো গণপরিবহনে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হননি এমন নারীর সংখ্যা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
ব্রাকের তথ্য মতে, প্রতি ১০০ জন নারীর মধ্যে ৯৪ জন নারী কোনো না কোনোভাবে যৌননির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন। কখনো পুরুষ যাত্রীদের অশ্লীল চাহনি, কখনোবা বাসে ওঠানামার সময় হেলপারের অহেতুক শারীরিক স্পর্শের কবলে পড়ছেন তারা। এমনকি অধিকাংশ সময় বাসে পর্যাপ্ত জায়গা থাকা সত্ত্বেও নারীদের শরীর স্পর্শ করে বসে পুরুষ যাত্রীরা, নতুবা দাঁড়িয়ে থাকে তাদের গা ঘেঁষে। যা এক অস্বস্তিদায়ক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। হেনস্তার শিকার এসব নারী বেশির ভাগ সময়েই মুখ ফুটে প্রতিবাদ করতে পারেন না। নীরবেই সয়ে যায় সবটা। আবার প্রায়ই দেখা যায়, যাত্রাপথে যানবাহনের সংখ্যা কম থাকায়, বিশেষ করে সকালে ও বিকেলে যখন অফিস ও প্রতিষ্ঠানগামী যাত্রীর সংখ্যা বেশি থাকে, তখন অধিকাংশ বাসই নারীযাত্রীদের উঠাতে চায় না। যা ক্রমশই তাদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে।
২০০৮ সালের বাংলাদেশ আইন অনুসারে বাসে নারীযাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অথচ আজো এক যুগ পেরিয়ে গেলেও নারীরা তাদের আসনগুলোতে পরিপূর্ণ অধিকার পায়নি। অধিকাংশ সময়ই দেখা যায়, পুরুষরা দখল করে আছেন নারীদের আসন আর নারীরা ভিড় ঠেলে দাঁড়িয়ে থাকছেন। এতে করে গর্ভবতী মায়েদের ও পিরিয়ড চলাকালীন নারীদের শারীরিক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, অসুস্থ হয়ে পড়েন তারা। এছাড়াও বড় পরিতাপের বিষয়টি হলো, যাত্রাপথে গণপরিবহনে নারীধর্ষণ! এক্ষেত্রে দেখা যায় অভিভাবক থাকা সত্ত্বেও নিরাপদ নয় নারীরা।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে নারীবান্ধব গণপরিবহন নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। যদিও ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ সরকারের নারী ও শিশু মন্ত্রণালয় বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষত প্রতিটি বাসে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ২০২২ সালে ১০৮টি বাসে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করেন। যাতে করে নারীরা বাসে নিজেকে নিরাপদ মনে করে এবং যাত্রী বা সংশ্লিষ্ট বাস কর্মকর্তারা অনৈতিক কার্যকলাপে ভয় পায়। তবে এ প্রকল্পের অগ্রগতি যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক নয়।
তাই সরকার প্রদত্ত এই আইন ও কার্যক্রমগুলোর অনতিবিলম্বে বাস্তবায়ন জরুরি। সেই সঙ্গে বাসে হেলপার, সুপারভাইজার ও চালকদের নেমপ্লেটসহ পোশাক পরিধান নিশ্চিত করা দরকার এবং তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য সংক্রান্ত অনলাইন ডাটাবেজ তৈরি করা প্রয়োজন। যাতে করে প্রয়োজনীয় সময়ে অভিযোগকারী দ্রুত সেবা নিতে পারে। অতঃপর গণপরিবহনের সংখ্যা বৃদ্ধি করাও জরুরি। এর ফলে ভিড় এড়িয়ে নিরাপদে নারীরা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করতে পারবেন। প্রয়োজনে সর্বত্র নারীদের জন্য পৃথক গণপরিবহনও চালু করা যায়। রাজধানী ঢাকায় নারী বাস রয়েছে, তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই কম। এই বাসগুলোতে নারীরাই হোক এর চালক কন্ডাক্টর ও হেলপার। আর যাত্রীরাও হবে কেবল নারীরাই। এক্ষেত্রে নারী ড্রাইভারের সংখ্যা তৈরি করতে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। উপরন্তু যাত্রীদের মানসিকতারও পরিবর্তন আনা দরকার, নারীর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে তার প্রাপ্ত মর্যাদা তাকে দেওয়া দরকার। কেননা, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই গণপরিবহন হয়ে উঠবে নারীবান্ধব।