আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, পৃথিবীর সুন্দর পরিবেশই প্রাণের ধারক, জীবন শক্তির জোগানদার। পৃথিবীর পরিবেশ ও মানুষের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। অনুকূল পরিবেশ উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতের বিকাশ ঘটায়। প্রতিকূল পরিবেশে জীবের ধ্বংস ও সর্বনাশ অবশ্যম্ভাবী। প্রকৃতির উপাদান বায়ু, পানি, মাটি বিজ্ঞানের অপব্যবহারে দূষিত হওয়ায় পৃথিবীতে উষ্ণতা বেড়ে মানব সভ্যতা পড়েছে হুমকির মুখে।
মানব সভ্যতার এক গুরুত্বপূর্ণ অন্যতম উপাদান পরিবেশ। এ পরিবেশ মানব সৃষ্ট কারণে ভারসাম্য বিঘ্ন বা নষ্ট হওয়াই পরিবেশ দূষণ। পৃথিবীর বায়ু, পানি, মাটি ও পরিবেশ বিষাক্ত হওয়ায় পৃথিবীর ভারসাম্য ধ্বংসের মূল কারণ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বাড়ছে। বায়ুমণ্ডলে অতিমাত্রায় কার্বন ড্রাইঅক্সাইড, মিথেন গ্যাস জমা হয়ে তাপ বিকিরণে বাধা দেয় এবং এই গ্যাস তাপ শোষণ করার ফলে ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগ চরম উত্তপ্ত হয়ে সূর্যরশ্মির চাপকে আটকে রেখে পৃথিবীকে উত্তপ্ত রাখার গ্যাসই গ্রিনহাউজ। কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন, নাইট্রোজেন, সালফার অক্সসাইড বায়ুমণ্ডল উত্তাপের জন্য দায়ী।
বিজ্ঞানীদের মতে, উষ্ণতা বৃদ্ধি এখনই থামাতে না পারলে ২০৩০ সালে আরো ০.৬ ডিগ্রি উষ্ণতা বাড়বে। শিল্পবিপ্লবের কারণে এই শতকের শেষে তাপমাত্রা ৩-৪ ডিগ্রি বাড়বে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ৯৮ ভাগ নিশ্চিত, ২০২৭ সালে উষ্ণতা বর্তমান সীমা অতিক্রম করবে। চলতি বছর তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। পৃথিবীতে ১৮৫০ সাল থেকে উষ্ণতা রেকর্ড শুরুর পর অষ্টম উষ্ণতার বছর ছিল ২০১৬। এ বছর ভারতে ৫১ ডিগ্রি তাপমাত্রায় পাকা রাস্তার ওপর কড়াই দিয়ে ডিম ভাজি করেছিলেন এক মহিলা। এ ঘটনা বিশ্ব জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। পৃথিবীতে প্রতি মিনিটে ২০ হেক্টর জমি বন্ধ্যা, ৪৫ হেক্টর উর্বর জমি বালুকাময় এবং প্রতিবছর ৭০ লাখ হেক্টর জমি মরুভূমি হচ্ছে। ১৭০০-১৯০০ সালে শিল্পবিপ্লবের আগের সময় পৃথিবীতে ১.১ ডিগ্রি করে উষ্ণ হয়েছিল। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ফলে ওজোন গ্যাস বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে।
যুক্তরাজ্যের আবহাওয়া অফিস প্রধান অ্যাডাম স্কেইপ বলেছেন, বর্তমানে উষ্ণতা দেড় ডিগ্রি বৃদ্ধির কাছাকাছি। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার সেক্রেটারি জেনারেল পেট্যোরি ডালাসের মতে, ১৯৭০-২০২১ সাল সময়ে ১১ হাজার ৭৭৮টি উষ্ণতাজনিত দুর্যোগে বিশ্বে ২০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং ৯০ ভাগ উন্নয়নশীল দেশের। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর নরম্যান মাইরিস বলেছেন, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বে ২০ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুতির শিকার হবেন। বিজ্ঞানীরা জোর দিয়ে বলেছেন, ২০২৩-২৭ সাল সময়ে উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি বাড়বে। তাই গ্রিনহাউজ গ্যাস কমিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই।
আইপিসিসি বলছে, প্রতি ১০ বছরে ৩.৫-১.৫ মিলিমিটার সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে ২১০০ সালে পানি ৩০-১০০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বন্যা প্লাবনসহ বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানব সভ্যতা ধ্বংস করে দিতে পারে। এশিয়ার ১৩০ কোটি অধিবাসী, হিমালয় পর্বতমালার হিমবাহ পানির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ২০৩৫ সালের মধ্যে হিমবাহ গলে এ অঞ্চলে বিপর্যয় নেমে আসবে। এমন অবস্থায় ২০৩০ সাল নাগাদ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতসহ উপকূলীয় এলাকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যেতে পারে।
বায়ুমণ্ডলে উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে পৃথিবীতে ক্ষতিগ্রস্ত ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম। দেশের দক্ষিণাংশে বঙ্গোপসাগর থাকায় মোট জনসংখ্যার ৬৭ ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জলবায়ুজনিত বিভিন্ন দুর্যোগে। আইপিসিসির মতে, ১৯৮৫-৯৮, ১৪ বছর সময়ে ০.৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা বেড়েছিল। ২০১৬ সালে এপ্রিলে ৪১.২ ডিগ্রি এবং চলতি মাসে ৪৩ ডিগ্রি ছিল। ১৯৯১-২০০০, ১০ বছরে ৯৩টি দুর্যোগে ২০ হাজার মানুষের মৃত্যু, কৃষি ও অবকাঠামোগত ক্ষতি হয় ৫.৯০ বিলিয়ন ডলার। ২০০৭ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে ৪ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। ১৯৯৩-৯৪ সালে ১০০ বর্গকিলোমিটার বসত ভূমি নদীগর্ভে বিলীন হলে ১২ লাখ মানুষ ভিটেমাটি হারায়। প্রতি বছর শত শত মানুষ বজ্রপাতে মারা যাচ্ছেন এবং অ্যাসিড বৃষ্টি হচ্ছে, বিভিন্ন প্রজাতির গাছ, মাছ, পশু-পাখি বিলুপ্ত হচ্ছে। সুন্দরবনের বড় বড় প্রজাতির গাছগুলোর আগা মরে যাচ্ছে। দেশের মোট আয়তনের ২৫ ভাগ বনভূমি থাকার কথা থাকলেও আছে মাত্র ৯ ভাগ। তাছাড়া নদী-নালা-খাল-বিল-পুকুর ভরাট হওয়ায় মাটির নিচে ও ওপরে তীব্র পানিসংকট। বিজ্ঞানীদের মতে, ২০৮০ সালে সমুদ্রের তলদেশের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে দেশের মোট আয়তনের এক-তৃতীয়াংশ সমুদ্রের পানিতে ডুবে যাবে এবং কোটি কোটি মানুষকে বাড়ি-ঘর ছেড়ে যেতে হবে। গবেষকদের মতে, জলবায়ুর আগ্রাসির তাণ্ডবে ক্যানসার, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, ব্রেইনস্ট্রোক, হিটস্ট্রোক, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ, কিডনি, চোখের রোগ, সর্দি, কাশিসহ ৬৩ ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এদেশের মানুষ। এজন্য পরিবেশ রক্ষাকে আমাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ ব্যাপারে বিশ্বনেতৃবৃন্দকে পালন করতে হবে ইতিবাচক ভূমিকা।
স্বর্তব্য যে, ১৯৭২ সালে ৫-১৬ জুন জাতিসংঘের সম্মেলনে পৃথিবীর পরিবেশ রক্ষায় ৫ জুনকে পরিবেশ দিবস করা হলে, ১৯৭৪ সালের ৫ জুন প্রথম দিবসটি পালন করা হয়। দিবসটি পালনের মূল লক্ষ্য বিশ্বকে দূষণমুক্ত রাখা ও উষ্ণতা কমিয়ে পৃথিবী রক্ষার ব্যবস্থায় সচেতনতাসহ বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ৫ জুন পরিবেশ দিবস পালন করা শুধু সেমিনার, বক্তব্য, রের্লি ইত্যাদিতে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়। প্রতিটি রাষ্ট্র জনগণকে উষ্ণতা বা পরিবেশ দূষণের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি, গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বৃক্ষরোপণসহ পরিবেশদূষণ মুক্ত রাখার পদক্ষেপ গ্রহণে সক্রিয় করে তুলতে হবে। পরিবেশ দিবসে পরিবেশ রক্ষায় নতুন করে অঙ্গীকার গ্রহণ করতে হবে। নতুবা দুর্যোগে বাংলাদেশের জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে।