অবাধ তথ্যপ্রবাহ ও মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে আমাদের দেশের ৭১ শতাংশ শিক্ষার্থীর পড়াশোনার খরচের জোগান দেন অভিভাবকেরা। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে এই হার অনেক অভিভাবককে অসহায় করে তোলে। কারণ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গেলে ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী বাড়ি ছেড়ে হোস্টেলে গিয়ে প্রতি মাসে অভিভাবকের পাঠানো টাকার জন্য হা করে চেয়ে থাকে। অভিভাবকের ওপর নির্ভরশীল এসব শিক্ষার্থী অনেকেই বর্তমান চাকরির বাজারে অচল উচ্চশিক্ষা গ্রহণে রত। অথচ আমাদের দেশীয় চাকরির বাজারে হাজার হাজার টেকনিক্যাল পদ দখল করে আছেন ভারত, চীনসহ নানা দেশের নাগরিকেরা। সে কথা আমাদের শিক্ষার্থী বা অভিভাবকের অনেকেই ভালোভাবে জানেন না।
নির্ভরশীল এসব শিক্ষার্থী পাশ করার পর প্রায় সবাই শহরে থাকতে পছন্দ করেন। বড় চাকরি পেতে চান। অনেকে গ্রামে ফেরত যেতে অনীহা প্রকাশ করেন। এমনকি অনেকেই ভালো চাকরি পেলেও রাজধানী ঢাকা অথবা বিভাগীয় শহরের বাইরে চাকরি করতে যেতে চান না। কেউ কেউ একবার শহরে এসে আর গ্রামের বাড়ির দিকে ফিরে তাকাতে চান না। কারণ, আমাদের দেশে গ্রাম ও শহরের নাগরিক সুবিধাদির মধ্যে বিস্তর ফারাক বিদ্যমান। এই ফারাক দিনে দিনে আরও বেশি ঘনীভূত হচ্ছে। এখনো উচ্চশিক্ষা হোক বা বড় কোন রোগের চিকিৎসার প্রয়োজন হোক বা কোন চাকরির ইন্টারভিউ হোক, ঢাকা শহরে না গেলে তার উপায় বা বিকল্প কোনোটাই নেই। একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে, বিয়ের শাড়ি-গয়না কিনতে বা হাইকোর্টে মামলার হাজিরা দিতেও ঢাকায় আসতে হয়। মার্কেটের ছাদে গড়ে উঠেছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও সেগুলোর আবাসিক হল। এভাবে ঢাকা হয়েছে জনবহুল, গাড়িবহুল, শব্দবহুল, দূষণবহুল, মশকবহুল, জলজট-যানজটে নাকাল বিশ্বের ১ নম্বর বসবাসের অনুপোযুগী শহর।
আমাদের উচ্চশিক্ষায় এসে একশ্রেণির তরুণ চরম হতাশ। তাদের অচল শিক্ষায় দীক্ষা গ্রহণের সুযোগ দিয়ে মূলত ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের অপব্যবহার করা হচ্ছে। মনে পড়ে, প্রায় ৩০ বছর আগে জাপানের এক ল্যাবে বসে সেদিনের জাতীয় নির্বাচনে সেখানকার শিক্ষার্থী বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম—আজ তোমাদের ভোট হচ্ছে, তোমরা ভোট দিতে যাবে না? তারা আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে অনেকটা অনীহ ছিল। একজন উত্তরে বলেছিল, আমাদের দেশে নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এত আগ্রহ নেই। সাড়ে পাঁচ বছর সময়ে সেখানে আমি দেখিনি কোনো মাইকিং, কোনো জটলা বা কোনো বৃহৎ জনসভা। শিক্ষার্থীরা কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য কি না, সেটা তাদের কথা বা আচরণে বোঝার উপায় নেই। রাজনীতির কারণে তারা নিজেদের পড়াশোনা ও ক্লাস ফাঁকি দিতে পারে না।
শুধু একদিন এক প্রার্থী তার এক সঙ্গীকে নিয়ে বাসার দরজায় এসে ডাকবাক্সে একটি ছোট্ট লিফলেট দিয়ে গেছেন। সেটাও নিঃশব্দে! আরেক দিন এক প্রার্থী গেটের সামনে হ্যান্ডশেক করেছিলেন। তার হাতে সাদা গ্লাভস পরা ছিল। তারা আমাদের মতো চেহারার বিদেশিদের স্বকীয় কালচার বোঝেন। সেজন্য হ্যান্ডশেক করেন। কিন্তু সেই প্রার্থী যেহেতু সেদিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন, সেহেতু তার হাত থেকে কোনো সংক্রমণ যেন ভোটারদের শরীরে না ছোঁয়, সেজন্য প্যাকেট থেকে নতুন ওয়ানটাইম গ্লাভস পরে নিয়েছিলেন! সেটা করোনার বহু আগের কথা। যারা ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবেন না, তাদের জন্য ডাকযোগে আগেই ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। আমাদের দেশের মতো ভোট নিয়ে ওদের প্রার্থী বা ভোটার কারো মধ্যে এত মাতামাতি বা উত্তেজনা ছিল না।
পিএইচডির আগে পরিবেশবিজ্ঞানে মাস্টার্সের ছাত্র থাকাকালীন লক্ষ করতাম আমার কিছু ক্লাসমেট অনেকটা অগোছালোভাবে দ্রুতগতিতে ক্লাসে ঢুকত। লেকচার শুনতে শুনতে কেউ কেউ ঘুমিয়ে যেত। কিন্তু শিক্ষক তাদের কিছুই বলতেন না। একদিন লাঞ্চের সময় ক্লাসে ঘুমানো এক বন্ধুকে বললাম, ‘তুমি মাঝে মাঝে ক্লাসে ঘুমাও, রাতে ঘুম হয় না তোমার?’ সে উত্তরে বলেছিল, ‘বন্ধু, তুমি তো স্কলারশিপ পাও, সেজন্য বিষয়টা বুঝবে না। আমার জমানো টাকা দিয়ে সেমিস্টার ফি দিয়েছি। আগামী সেমিস্টার ফি দিতে হবে, তাই আমাকে রাতে কাজ করতে হয়। আমার বাবা-মা অথবা অভিভাবকেরা কোনো টাকা দেয় না।’ ওদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়ারা পরিবার থেকে টাকা নিতে লজ্জাবোধ করে। তারা সাধারণত নিজের উপার্জিত অর্থ দিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে। বেশির ভাগ শিক্ষার্থী আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শেষ করে চাকরি করে টাকা জমায়। তারপর অফিস থেকে ছুটি নিয়ে দুই বছরের মাস্টার্স পড়ে। ওদের দেশে সবাই মাস্টার্স পড়তে যায় না। শুধু যাদের চাকরিক্ষেত্রে প্রয়োজন অথবা একান্ত ইচ্ছা, তারাই বড় ডিগ্রি অর্জন করে। অথচ আমাদের দেশে তার উলটো। এখানে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শেষ করে চাকরি নেই। তাই বসে না থেকে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী মাস্টার্স পড়ে। মেয়েদের ঘরে বসিয়ে না রেখে পড়ানো হয়। সেটা প্রয়োজন হোক বা না হোক। ছেলেদের ক্ষেত্রে সমাজে এখনো এমএ পাশ জামাইয়ের ব্যাপক কদর রয়েছে।
আরেকটি বিষয় হলো, এ দেশে এক বছরের গবেষণাবিহীন টট্ কোর্সের মাস্টার্স ডিগ্রির প্রচলন রয়েছে। গবেষণাসহ কমপক্ষে দুই বছরের মাস্টার্স ডিগ্রি কোর্স প্রচলিত নয় আমাদের দেশের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমাদের কলেজগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য সেখানে সিনিয়র ও অভিজ্ঞ শিক্ষকের বড় অভাব। এভাবে চাকরির বাজারে অচল ও অসম্পূর্ণ শিক্ষায় দীক্ষা দিচ্ছি আমরা। কিছু কিছু বিষয়ে পড়ানো হয়, যেগুলোর জ্ঞান চাকরির বাজারে কাজে লাগে না। অধিকাংশ সরকারি কলেজে সেই সব বিষয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। তাদের গবেষণার জন্য ল্যাবে আসতে হয় না। এমনকি পরীক্ষা প্রদানের শর্তের জন্য ক্লাসে উপস্থিতির দরকারও হয় না।
একজন চাকরিদাতা সেদিন বড় আক্ষেপ করে বললেন, ‘আমি আমার আর্থিক প্রতিষ্ঠানে একটি বড় পদের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করেছি। দেখা গেল সেখানকার আবেদনকারীদের ৮০ শতাংশই এই জবের জন্য একাডেমিকভাবে আনফিট। তিনি আরও বললেন, ধরুন, মাগরিবের নামাজের জন্য চারজন উপস্থিত হয়েছেন। একজনকে ইমামতি করতে দায়িত্ব দিতে হবে। সেখানে যদি একজন অঙ্কের, একজন বাংলার, একজন আরবির ও একজন রসায়নের ডিগ্রিধারী হন, তাহলে ইমামতির ভার কাকে দিলে যৌক্তিক হবে বলে মনে করেন? নিশ্চয়ই আরবিতে ডিগ্রি থাকা ব্যক্তিকে ইমামতি করতে দেওয়াটা সঠিক হবে। তেমনি আজকাল চাকরির ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে এমন বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছি আমরা। আরেকটি বিষয় হলো, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমন প্রার্থী চাকরিতে যোগদান করতে আসেন, যিনি কোথাও কোনো লিখিত বা মৌখিক কোনো পরীক্ষাই দেননি। অথচ তার হাতে নিয়োগপত্র। এরা স্বজন বা মহারথীদের সুপারিশে নিয়োগপত্র পাওয়া প্রার্থী। তারা একাডেমিক অযোগ্যতা নিয়েও যোগদান করেন এবং অফিস ও প্রতিষ্ঠানের অনেক ক্ষতি সাধন করেন। এক্ষেত্রে ঘুষ-দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি—এসব আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এত কিছু দেখে বলা যেতে পারে, আমাদের দেশে চাকরির বাজারে অচল শিক্ষা ও দীক্ষার ব্যাপক প্রচলন দেশের সুস্থ ভবিষ্যেৎ গহিন অন্ধকারে তলিয়ে দিচ্ছে। ওপেন সিক্রেট এসব বিষয় কাউকে বলার উপায় নেই—আপনাকে শুধু বললাম।’
এত জটিল বক্তব্য শুনে মনে মনে ভাবলাম- আমরা কী পড়াই আর ওরা কী পড়ে। আমরা কী বলি আর ওরা কী অনুশীলন করতে বাধ্য হয়। আমরা শ্রেণিকক্ষে শুধু তত্ত্বীয় জ্ঞান দিই। আর চারদিকে প্রচলিত নিষ্ঠুর বাস্তবতায় এই জটিল পরিবেশ ওদেরকে চাকুরী পাবার ভাবনায় অস্থির করে তোলে। বিসিএসে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ররা পুলিশ হওয়ার জন্য ১ নম্বর পছন্দ দেয় কেন, সেটাও গভীর চিন্তার বিষয়। কারণ, ফাইন্যান্স ও ব্যাংকিং পাশ করে কেউ তো ডাক্তার হতে ১ নম্বর বা শেষ পছন্দক্রমও দিতে পারে না! ভাবলাম, চাকরির বাজারে অচল শিক্ষা ও রুটি-রুজি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এই দৃশ্যমান অচলায়তন ভাঙবে কবে, কীভাবে?