এবারের এসএসসি পরীক্ষা এপ্রিল মাসের ৩০ তারিখ রোজ রবিবার থেকে শুরু হবে। পরীক্ষার রুটিন প্রকাশ হওয়ার পর পরীক্ষার্থীদের সবচেয়ে বেশি যে মানসিক সমস্যা দেখা দেয় তা হলো অযথা ভয়। এ সময়ে অনেক পরীক্ষার্থী বাসায় এসে বলে, মা আমার পেটে প্রচণ্ড ব্যথা, আমার বমি লাগছে…মা, প্লিজ! আমি পরীক্ষা দিতে পারব না। পরীক্ষাভীতিতে আক্রান্তরা বলেন, আমি এটা পড়েছি! আমি এটার সব জানতাম… কিন্তু আমি সব ভুলে গেছি। আমি শুধু লিখতে পারিনি!
পরীক্ষাভীতি কী : পরীক্ষা দেওয়ার কথা শুনলে অনেকের মনেই একটু উদ্বেগ কাজ করে। অল্প উদ্বেগে পরীক্ষার ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। তবে এর পরিমাণ বেড়ে গেলে মাথা ভারভার লাগে, গলা মুখ শুকিয়ে আসে, বুক ধড়ফড় করে, তার মনে হয় সে কিছুই করতে পারবে না। তার দ্বারা কোনোভাবেই ভালো রেজাল্ট করা সম্ভব হবে না। পরীক্ষা নিয়ে এই অযথা দুশ্চিতাই হলো পরীক্ষাভীতি। এসব পরীক্ষার্থী অনেক মানসিক চাপের কারণে সবকিছু পড়াশোনা করার পর পরীক্ষার হলে কিছুই মনে করতে পারে না। এই উদ্বেগ শুধু পরীক্ষা নয়, এমনকি তার স্বাভাবিক জীবনযাপনের ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এসব পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই সাধারণত তাদের মনের মধ্যে সৃষ্টি হয় ভীষণ চাপ।
পরীক্ষাভীতির লক্ষণ : পরীক্ষাভীতির লক্ষণগুলো ছোটখাটো নার্ভাসনেস থেকে প্যানিক অ্যাটাক পর্যন্ত হতে পারে, যা পরীক্ষার রুটিন হওয়ার পর থেকেই জীবনের স্বাভাবিক শান্তি নষ্ট করে দিতে পারে।
ক). শারীরিক লক্ষণ : মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, ক্লান্তি, দুর্বলতা, ডায়রিয়া, অত্যধিক ঘাম, শ্বাসকষ্ট, দ্রুত হৃদস্পন্দন, মুখ ও গলা শুকিয়ে যাওয়া, অনিদ্রা, হালকা মাথাব্যথা এবং অজ্ঞান বোধ করা সবই ঘটতে পারে। পরীক্ষার উদ্বেগ প্যানিক অ্যাটাকের দিকে নিয়ে যেতে পারে, যা তীব্র ভয় সৃষ্টি করতে পারে। অনেক সময় এসব ব্যক্তি মনে করতে পারে যে তারা শ্বাস নিতে অক্ষম বা হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে।
খ). মানসিক লক্ষণ : পরীক্ষার কথা মনে হলেই রাগ, ভয়, অসহায়ত্ব এবং হতাশার অনুভূতিগুলো মানসিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে আসতে থাকে।
গ). আচরণগত/জ্ঞানগত লক্ষণ : এই সময় পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে অসুবিধা, পড়ালেখা ভুলে যাওয়া, নেতিবাচকভাবে চিন্তা করা এবং নিজেকে অন্যদের সঙ্গে তুলনা করা পরীক্ষাভীতির লক্ষণ হিসেবে আসতে পারে।
পরীক্ষাভীতি দূর করার উপায় : পরীক্ষা নিয়ে উদ্বেগের মাত্রা যা-ই হোক না কেন, নিজেকে শান্ত রেখে পরীক্ষার ভয়কে মোকাবিলা করার জন্য বেশকিছু পদ্ধতি আছে, যা মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির পাশাপাশি উচ্চতর গ্রেড পেতে সাহায্য করতে পারে—
ক). শেয়ার করুন : পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মন খুলে আপনার সমস্যা ও ভয়গুলো শেয়ার করুন। শেয়ার করার কারণে আপনার মনের চাপ অনেক কমে যাবে।
খ). ব্যায়াম সংক্রান্ত বিষয় : যে কোনো পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য শারীরিক স্বাস্থ্য বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত ব্যায়াম করা, গভীর শ্বাস নেওয়া ইত্যাদি মানসিক উন্নতিকে সাহায্য করে, যার ফলে কম উদ্বেগ হয় এবং একই সঙ্গে পরীক্ষায় আরো ভালো গ্রেড পাওয়া যায়।
গ). খাদ্যের ব্যাপারেও সচেতন থাকুন : পরীক্ষার সময় আপনার খাদ্যের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। আপনার পরীক্ষার প্রস্তুতিতে অত্যাবশ্যক পুষ্টির অভাব থাকলে তা আপনাকে বমি বমি ও ঘুম ঘুম ভাব এমনকি অতিরিক্ত মানসিক চাপ অনুভব করাবে।
ঘ). ভালো ঘুম : পরীক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত ঘুমও অত্যাবশ্যক। খুব কম বা খুব বেশি ঘুমানো আপনার মানসিক ক্ষমতাকে ব্যাহত করতে পারে।
ঙ). পারিবারিক সমর্থন : পড়াশোনার পাশাপাশি ছোট বিরতি নিন এবং আপনার পরিবারের সঙ্গে কিছু মানসম্পন্ন সময় কাটান; তাদের সঙ্গে আপনার অনুভূতি এবং মনের অবস্থা ভাগ করুন। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো একটি বড় স্ট্রেস ম্যানেজ করতে সহায়ক হতে পারে।
চ). অধ্যয়নের সময় নির্ধারণ করুন : একটি সময়সূচি তৈরি করলে আপনাকে আপনার অধ্যয়নের সময়কে সবচেয়ে বেশি কাজে লাগাতে সাহায্য করবে। আপনার পড়াশোনার জন্য একটি নমনীয় রুটিন তৈরি করে অনুশীলন করুন, যাতে আপনি প্রয়োজনীয় সময়ে সমন্বয় করতে পারেন।
ছ). মনোযোগী থাকুন : নিয়মিত মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন প্র্যাকটিস করে সব সময় মনোযোগী থাকার চেষ্টা করতে পারেন। ভিডিও দেখে বা কোনো সাইকোলজিস্টের সঙ্গে সেশন করে মাইন্ডফুলনেন্স শিখতে পারেন।
জ). স্মৃতিবিদ্যা ব্যবহার করুন : স্মৃতিবিদ্যা হলো মুখস্থ করার কৌশল। আপনি আপনার পাঠ মুখস্থ করার জন্য চার্ট, ছড়া বা বাক্যাংশ তৈরি করতে পারেন।
ঝ). নিয়মিত গভীর শ্বাসপ্রশ্বাসের অভ্যাস করুন : গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস হলো একটি সেরা ওষুধ, যা আপনার উদ্বেগ কমাতে পারে। প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ মিনিট চোখ বন্ধ করে শ্বাসপ্রশ্বাসের অভ্যাস করুন। এটি অবশ্যই আপনার মানসিক শক্তি বাড়াতে সহায়তা করতে পারে।
ঞ). প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করুন : যদি আপনার উদ্বেগ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়, তাহলে একজন মনোবিজ্ঞানী বা মনশ্চিকিত্সকের সঙ্গে পরামর্শ করুন।
পরীক্ষাভীতি কাটাতে নিম্নের আরো কিছু পদ্ধতিগুলো অনুশীলন করতে পারেন;
(ক) পরীক্ষার দিনের প্রস্তুতি : পরীক্ষার আগের রাতে পর্যাপ্ত ঘুম, স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে আপনার প্রয়োজনীয় জিনিস চেক করা, সঙ্গে পানির বোতল রাখা, সহপাঠীদের সঙ্গে তুলনা করে নিজের আত্মবিশ্বাসকে নষ্ট না করা, গভীর-দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে ও নিজেকে নিয়ে ইতিবাচক কথাবার্তা বলে উদ্বিগ্নতা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
(খ) পরীক্ষার হলে করণীয় : পরীক্ষার হলে গিয়ে উত্তরপত্রের প্রয়োজনীয় তথ্য পূরণ করতে হবে। লেখা শুরু করার আগে প্রশ্নপত্রটিকে পড়ে (১) সহজ (২) একটু কঠিন ও (৩) কঠিন—এই তিন ভাগে ভাগ করে সহজ বিষয়গুলো আগে হবে, এরপর একটু কঠিন এবং সবশেষে কঠিন বিষয়গুলোর উত্তর দিতে হবে। প্রতিটি প্রশ্নের জন্য সময় ভাগ করে উত্তর দিতে চেষ্টা হবে এবং সংশোধন/পুনঃ চেক করার জন্য কিছু সময় রাখতে হবে।
পরীক্ষাভীতি থাকলে তা একজন ছাত্রের রেজাল্টের ওপর অনেক বেশি প্রভাব পড়ে। তাই এই বিষয়টি যত দ্রুত চিকিৎসা নিয়ে সমাধান করা যায় ততই ভালো। পরীক্ষাভীতির সমস্যাটি একটি চিকিত্সাযোগ্য মানসিক সমস্যা। এই ভীতির চিকিৎসায় সাইকোলজিক্যাল বিশেষত কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি খুব ভালো কাজ করে। এই থেরাপিতে ক্লায়েন্টের পরীক্ষাসংক্রান্ত চিন্তা, কল্পনা ও আচরণ নিয়ে কাজ করা হয়। অনেক সময় মেডিসিনও লাগতে পারে। পরিবারের কারো পরীক্ষাভীতিজনিত সমস্যা থাকলে দ্রুত বিশেষজ্ঞ পরামর্শ নিতে হবে। এখন অনলাইনেও সহায়তা পাওয়া যায়।