সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমা নেতাদের চীন সফর বেড়েছে। বিভিন্ন পশ্চিমা নেতা এমন এক সময় চীন সফর করছেন, যখন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট মাও জে ডংয়ের পরে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী নেতা হিসেবে নিজের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করেছেন। সর্বশেষ চীন সফরে যাওয়া নেতার নাম চার্লস মিশেল। ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট মিশেল বেইজিংয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, প্রধানমন্ত্রী লি খ্য ছিয়াং প্রমুখের সঙ্গে বৈঠক মিলিত হন। বৈঠকে ইইউ-চীন সম্পর্কের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
এর আগে বেইজিং অলিম্পিকের সময় ২০ জনেরও বেশি সরকার প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল প্রেসিডেন্ট শির। তবে এসব নেতার বেশির ভাগই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের না হওয়ায় গণতন্ত্র নিয়ে তেমন একটা আলোচনা হয়নি, বলা যায়। কিন্তু সিনিয়র ইউরোপীয় রাজনীতিক হিসেবে চার্লস মিশেল বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলবেন বলেই সফরের আগে মনে করা হয়েছিল। চীনের ক্রমবর্ধমান দৃঢ় ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানকে পশ্চিমারা কীভাবে দেখছে, এর প্রতি পশ্চিমা নেতাদের মনোভাবই-বা কী এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার প্রশ্নে বেইজিংয়ের সঙ্গে কী ধরনের নীতি-কৌশল গ্রহণ করা হবে—এসব নিয়ে আলোচনা হবে বলেই অনুমিত ছিল।
লক্ষণীয় বিষয়, মিশেল এমন একটা সময়ে চীন সফর করলেন, যখন ‘চীন-পশ্চিম বিভাজন’ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এমনকি কীভাবে বা কোন প্রক্রিয়ায় এই বিভাজনকে স্থিতাবস্থায় আনা যায়, সে বিষয়েও বিভিন্ন দিক থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে, ট্রান্স-আটলান্টিকের কথা বলা যেতে পারে। ইন্দোনেশিয়ার বালিতে সম্প্রতি আয়োজিত গ্রুপ অব টুয়েন্টি (জি-২০) শীর্ষ সম্মেলনে শির সঙ্গে বৈঠকে সমঝোতামূলক সুর তুলতে দেখা গেছে স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে। যদিও ওয়াশিংটন সাধারণত ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান সদস্যদের, বিশেষ করে ফ্রান্স এবং জার্মানির চেয়ে চীনের প্রতি অনেক বেশি অনমনীয় মনোভাব পোষণ করে আসছে। যেমন—অতিসম্প্রতি প্রকাশিত মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতি কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করা হয়। অক্টোবরে প্রকাশিত মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে বলা হয়, ‘আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে পুনর্নির্মাণ করার অভিপ্রায়কে সামনে রেখে চীন বেশ কিছু নীতিকৌশল নিয়ে এগিয়ে চলেছে। প্রতিযোগী এই দেশের এ ধরনের তৎপরতা ক্রমবর্ধমান। অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, সামরিক এবং প্রযুক্তিগত শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে দেশটি এক প্রকার মরিয়া।’
২২ নভেম্বর ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বক্তৃতায় চীনের সঙ্গে সংস্থাটির (ইইউ) সহযোগিতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৈদেশিক বিষয় ও নিরাপত্তা নীতির উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি জোসেপ বোরেল। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও বহুপাক্ষিকতাসহ বেশ কিছু বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে বোরেল উল্লেখ করেন, ‘চীন তার নীতিকৌশলে ক্রমশ দৃঢ় মনোভাবী হয়ে উঠছে। ক্রমবর্ধমান শক্তিশালী প্রতিযোগী হিসেবে বিকাশ লাভ করছে।’ তবে মজার ব্যাপার, তিনি এই বলে তার বক্তৃতা শেষ করেছিলেন—‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। কিন্তু দেশটির সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে কিছু ক্ষেত্রে আমরা একই অবস্থানে থাকব না; ঠিক যেমনভাবে চীনের সঙ্গেও সবক্ষেত্রে একমত হব না।’
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইইউ মিত্রদের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বরাবরই একটা বিষয়ে বেশ চাপ আছে—চীনের প্রতি কঠোর মনোভাব পোষণ করার বাধ্যবাধকতা! সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এই ধরনের মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপীয় নেতাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কেননা, এই বাধ্যবাধকতা মানতে গেলে নিশ্চিতভাবে পেছনে পড়ে যেতে হবে নিজেদের। তাই ইইউ নেতাদের তরফ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আসছে ‘পেছনে ঠেলে দেওয়া’ এই মনোভাবের প্রতি। যেমন—সম্প্রতি চীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ডাচদের অনেকটা সরাসরি উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ। ইইউ-চীন সম্পর্ক বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি কথা বলেন। সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ, জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলত্স সাম্প্রতিক চীন সফরের সময় রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার চেয়ে অর্থনৈতিক সহযোগিতার ওপর জোর দিয়েছিলেন। শলেসর সফর নিয়ে ঘরে-বাইরে বহু আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি চীনের মাটিতে পা রাখেন এবং শির সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন।
যাহোক, পশ্চিমা নেতাদের চীনের প্রতি ঐক্য গড়তে চেষ্টা সত্ত্বেও এটা অনুমান করা আদৌ অমূলক হবে না যে, আটলান্টিকের মধ্য দিয়ে একটি স্পষ্ট বিভাজক রেখা অতিক্রম করেছে। চীনের সঙ্গে অতি মাখামাখি নিয়ে স্পষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে খোদ ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে। এসব বিষয় নিয়ে কথা বলা স্বাভাবিকভাবেই কঠিন, কিন্তু সত্য তো সামনে আসবেই।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ব্যাপক ধুমধামের মধ্য দিয়ে ইইউ-চীন বিনিয়োগসংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে দেখা যায়। এসব নিয়ে কম কথা হয়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চুক্তি সম্পাদিত হলেও তার অনুমোদন এখনো অনেকটাই ঝুলে আছে। ঘটনা আছে লিথুয়ানিয়াকে ঘিরেও। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্ষুদ্রতম সদস্য লিথুয়ানিয়া ভিলনিয়াসে একটি বাণিজ্য অফিস খোলার অনুমতি দেয় তাইওয়ানকে। এ নিয়ে চীনের সঙ্গে একটি বড় বিরোধের সৃষ্টি হয় দেশটির। চীন একে ‘এক চীন নীতি’র পরিপন্থী হিসেবে অবিহিত করে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে চীনের সঙ্গে বিভিন্ন নেতা কথা চালাচালিতে আক্রমণ-পালটা আক্রমণে জড়িয়ে পড়েন।
সত্যিকার অর্থেই, চীনের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্পষ্ট বিভাজন রেখা রয়েছে, যা দীর্ঘকালের। এই বিভাজন দেশগুলোর অভ্যন্তরেও বিদ্যমান। রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়ী নেতারা প্রায়শই নিজেদের মধ্যে এ নিয়ে বিবাদে জড়ান। চীনের প্রতি কোন পন্থা অবলম্বন করা হবে—এ নিয়ে একে অপরের সঙ্গে মতবিরোধে লিপ্ত হন। যেমন—উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাজ্যের কথা ধরা যাক। যুক্তরাজ্যের নেতাদের বৈদেশিক নীতির অগ্রাধিকার নির্ধারণের ঐতিহ্যবাহী স্থান লন্ডনের লর্ড মেয়রের ভোজসভায় এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক চীনের প্রতি ‘দৃঢ় বাস্তববাদ’ নীতি গ্রহণের পক্ষে কথা বলেছেন। এই নীতি কনজারভেটিভ পার্টির কট্টরপন্থীদের মধ্যে ভারসাম্য আনতে গ্রহণ করা হবে বলে সুনাক মত প্রকাশ করেন। চীনের প্রতি কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি এবং দেশটির সঙ্গে ব্যবসার স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন নানা ঘটনার মধ্যে নির্বাচিত হওয়া যুক্তরাজ্যের এই প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু, দেশটির নজরদারি ব্যবস্থায় চীনা ক্যামেরার ব্যবহার নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত ইঙ্গিত দেয় যে, চীনের বিষয়ে বিতর্ক থামবে না শিগিগরই। বস্তুত, এ ধরনের বিতর্ক শুধু যুক্তরাজ্যেই নয়, পশ্চিমের প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অনেকটা স্থায়ী প্রবণতা হিসেবে জায়গা দখল করে আছে।
চীনের সঙ্গে ব্যবসার ক্ষেত্রে বিতর্ক চলছে জার্মানিতে। সরকার চীনের সঙ্গে প্রাইভেট-সেক্টর লিংকের বিষয়ে নতুন নিয়ম তৈরি করেছে। এ নিয়ে বিতর্ক এখন তুঙ্গে। সরকার এমন নীতি প্রণয়ন করতে চায়, যাতে করে জার্মান কোম্পানিগুলোর জন্য অন্য কোথাও বাজার খোঁজা সহজ হয়, এবং যার ফলে চীনের ওপর সরকারের নির্ভরতা কমানো সহজতর হয়ে ওঠে। সরকারের এই নীতি গ্রহণের বিরুদ্ধে জবাব আসছে ব্যাবসায়িক মহল থেকে। জার্মান গাড়ি প্রস্তুতকারী মার্সিডিজ-বেঞ্জের প্রধান নির্বাহী ওলা ক্যালেনিয়াস বলেছেন, ‘চীনা বাজার থেকে ফিরে আসার চিন্তা করা কল্পনারও বাইরে।’ ব্যবসায়ীদের মতোই চীনের বিপক্ষে অবস্থান বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর। যেমন—চীনের ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রশ্নে অনেক দূরে অবস্থান নিয়েছে জার্মান জোট সরকারও। গ্রিন পার্টি, যা কি না চ্যান্সেলর শলেসর মন্ত্রিসভায় অর্থনীতি এবং বৈদেশিক বিষয়ের রূপকার, চীনকে বাড়তি সুবিধা দিতে একেবারেই ইচ্ছুক নয়।
সব মিলিয়ে এই যখন অবস্থা, তখন ঠিক এমন একটি পটভূমিতে দাঁড়িয়ে মিশেলের চীন সফর ইইউ-চীন সম্পর্কে কতটা মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। বাণিজ্য সম্পর্কের স্থিতিশীলতার স্বার্থে বিভিন্ন ইইউ সরকার যতই পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করুক না কেন, এ কথা মানতেই হবে—বৈশ্বিক এই দুই ‘অর্থনৈতিক দৈত্য’ সর্বদাই পরস্পর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাবে! এতে করে ইইউ এবং চীন উভয়ই পড়বে অস্থিরতার মুখে। দেশীয় এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এর জোর ধাক্কা লাগবে। এবং চলমান বৈশ্বিক সংকটে এই ধাক্কা সামলাতে পারা বেশ মুশকিল যদিও।
জলবায়ু পরিবর্তন, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বৈশ্বিক খাদ্য ও জ্বালানির দামের টালমাটাল পরিস্থিতে জটিল সব চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়িয়ে পুরো বিশ্ব। অর্থনৈতিক উদ্বেগই এখন প্রতিটি দেশের বাস্তবতা। এই সংকটময় পরিস্থিতির উত্তরণেই দেশগুলো চীনের সঙ্গে সখ্যতা গড়তে চায়—এ কথা অনেকাংশেই সত্য। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়! মৌলিক রাজনৈতিক পার্থক্যকে চিরতরে বিদায় করে অর্থনৈতিক দিক কি বাস্তবতার আলো ছড়াতে পারবে? বেইজিংয়ের সঙ্গে ব্যাবসায়িক ক্ষেত্রে যতই স্বাভাবিক সম্পর্ক বজার রাখার চেষ্টা করা হোক না কেন, রাজনৈতিক প্রশ্নে ইইউ-চীন সবসময়ই পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাবে। এই বাস্তবতা যেন চিরকালীন!