আমার এক সহপাঠীকে ভার্চুয়াল জ্ঞান, লেখালেখি এবং অন্যান্য কর্মকাণ্ডে বেশ জ্ঞানবৃদ্ধ বলে মনে হয়। তার বিভিন্ন ফেসবুক পোস্ট দেখে ভাবি, হায়! এত মেধাবী একজনের সঙ্গে বসে ক্লাস করি, এ তো আমার সৌভাগ্য; কিন্তু আমার লালনকৃত ধারণার ধীরে ধীরে মৃত্যু ঘটতে থাকে। ক্লাসে স্যারেরা যখন মাঝেমধ্যে বিভিন্ন প্রশ্ন করে তখন তার সদুত্তর তো সে দিতেই পারে না, উলটো ভুল তথ্য দিয়ে নিজের পাণ্ডিত্য জাহির করতে গিয়ে হাস্যরসের শিকার হয়।
একদিন, ক্লাসে তার নির্দিষ্ট একটি টপিকের ওপর লেখা দেখে আমি হকচকিয়ে যাই। লেখার মধ্যে না আছে কোনো তথ্য উপস্থাপনের ধারাবাহিকতা, না আছে সুন্দর শব্দচয়ন, না আছে যতিচিহ্নের সঠিক ব্যবহার। আমি ভাবতে থাকি—ক্লাসে এত গরমিল, তা হলে ফেসবুকে এত সুন্দর শব্দচয়নে সে লেখে কীভাবে?
হঠাৎ একদিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মৌলিক বই প্লেটোর রিপাবলিকের বুক রিভিউ তার টাইম লাইনে আবিষ্কার করি। রিভিউ শেষে সে তার নাম এবং পরিচয় লেখে রেখেছে। অর্থাৎ লেখাটি তার নিজের সম্পদ—এই মর্মে সে লেখার শেষে তার পরিচয় যুক্ত করেছে। লেখাটি এতটাই দারুণ ছিল যে, আমি আরো ভাবনায় পড়ে যাই। আমি ভাবি, যে ব্যক্তি সামান্য একটি বিষয় সুন্দর করে লিখতে পারে না, সে এত সুন্দর শব্দচয়নে ফেসবুকে লেখে কীভাবে? আমি কোনো কারণে রিপাবলিক বইয়ের রিভিউ গুগলে সার্চ করি। ফলাফল যা আসে তাতে হতভম্ব হয়ে যাই।
রিপাবলিক বইয়ের ওপর লেখা মশিউল আলম সাহেবের রিভিউটি হুবহু চুরি করে নিজের নামে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা স্পষ্ট চৌর্যবৃত্তি। ইংরেজিতে যাকে প্লেজিয়ারিজম (Plagiarism) বলা হয়। এরকম আরো একটি লেখা তার টাইম লাইনে দেখে আমি তাকে সতর্ক করে বলি—এটা স্পষ্ট অনৈতিক এবং অপরাধমূলক কাজ।
তাকে সতর্ক করা সত্ত্বেও সে তার কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। অর্থাৎ চুরি বন্ধ করেনি। ফেসবুকে সামান্য কয়টি লাইক-কমেন্টের আশায় সে হয়তো এই কাজ করে থাকে; কিন্তু এটা মোটা দাগে প্রতারণা এবং অপরাধমূলক কাজ ছাড়া আর কিছুই নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে এটা আরো অন্যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর কাছে মানুষ নৈতিকতা আশা করে, মুক্তবুদ্ধি আশা করে। কোনো বিষয়ে সৃজনশীল সমাধান আশা করে। এখন সামান্য জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য যদি অন্যের মেধাসম্পদ নিজের নামে চালিয়ে দেয় তা হলে সে জাতির জন্য ত্রাতা হিসেবে পরিচিত না হয়ে বোঝা হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে।
এসব বলতে চাই না; কিন্তু বলতে বাধ্য হলাম একটা কারণে। কিছুদিন হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্মুক্ত প্ল্যাটফরম হিসেবে চ্যাটজিপিটির ((ChatGPT) সূচনা হয়েছে। এই প্ল্যাটফরমের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এতটাই শক্তিশালী যে, এটা গুগলের চেয়েও বেশি গোছালো কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম। এমনকি সৃজনশীল কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতেও সক্ষম। অর্থাৎ, কোনো একটি বিষয় প্রশ্ন করলে চ্যাটজিপিটি সুনির্দিষ্টভাবে উত্তর প্রদান করে থাকে। এই প্ল্যাটফরমটি মানুষের জন্য উপকারী হবে নাকি অপকারী হবে—সেটা নিয়ে এখন তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে। কারণ, প্রযুক্তি বের হওয়ার আগে মানুষ কোনো একটি বিষয়ের ওপর লিখতে চাইলে সেই সম্পর্কে লাইব্রেরিতে বসে কিছু সময় ব্যয় করে অধ্যয়ন করে জ্ঞান অর্জন করে নিত। গুগল বা অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিন আবিষ্কারের পরে মানুষ ঘরে বসে গুগলে সার্চ করে চার-পাঁচটি সূত্র থেকে তথ্য নিয়ে একটি লেখা রেডি করে ফেলে। অর্থাৎ অধ্যয়ন বা পড়াশোনার সময়টা আরো কম লাগছে। এবার চ্যাটজিপিটি আবিষ্কারের পরে কোনো একটি বিষয়ে লেখা রেডি করতে পড়াশোনাই করা লাগছে না। শুধু গোছালোভাবে প্রশ্ন করতে পারলেই হয়। আবার এমনও হয় যে, একটি প্রশ্নের একাধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ উত্তর আছে। আগে গুগল থেকে নেওয়া লেখার প্লেজিয়ারিজম চেক করলে ধরা পড়ত; কিন্তু এখন চ্যাটজিপিটি থেকে নেওয়া লিখার কোনো প্লেজিয়ারিজম ধরা পড়বে না। কারণ, তাৎক্ষণিক একটা লেখা সৃষ্টি হবে। সুতরাং যাদের মেধাসম্পদ চুরি করার অভ্যাস আছে তাদের ক্ষেত্রে আরো সুবিধা হতে পারে।
চ্যাটজিপিটি আবিষ্কারের পরে আমার সেই বন্ধুর কথা মনে পড়ে গেল। এখন আর তার লেখা চুরির পরে নিজের নামে চালিয়ে দিতে সংকোচ বোধ হবে না। কারণ, তাৎক্ষণিক সৃষ্ট লেখটি নিজের নামে চালালে কেউ আর বুঝতে পারবে না যে, লেখাটি তার নিজের নয়। চ্যাটজিপিটি যেমন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী আবিষ্কার, তেমনি মেধাসম্পদ চোরদের জন্যও ভালো লাগার বিষয় হতে পারে।
আশা করি, চ্যাটজিপিটির কর্তৃপক্ষ এমন ব্যবস্থা রাখবেন যাতে লেখার প্লেজিয়ারিজম চেকিংয়ের মাধ্যমে লেখার আসল মালিককে চিহ্নিত করা যাবে। নতুবা, মেধাসম্পদ চুরিতে অনেকেই দক্ষ হয়ে উঠবে এবং এতে চ্যাটজিপিটি নিয়ে সমালোচনা বাড়তে পারে। এখন যেমন ফেসবুকের সমালোচনা হতে হতে এর অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের সংখ্যা দিনদিন কমে যাচ্ছে, তেমনি চ্যাটজিপিটির কপালেও যে একই পরিণতি লেখা নেই, তা নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায় না।