বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাসের দিকে তাকালে ছাত্ররাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য দেখতে পাওয়া যায়। ১৯৪৮ সালে মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দিলে বাংলার ছাত্রসমাজ তা মেনে নেয়নি। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্ররা রাজপথে নেমেছিল। অর্থাৎ ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল সাধারণ ছাত্র ও ছাত্রনেতারা। একইভাবে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, বাঙালির মুক্তির সনদ ১৯৬৬ সালের ছয় দফা পরিচালিত হয় ছাত্রদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে। একইভাবে ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের কথা বলতে গেলে ছাত্রদের নামই প্রথম আসে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধেও ছাত্রসমাজের অবদান অগ্রগণ্য। বাংলার ছাত্রসমাজ এক হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছিল বলেই আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। এছাড়া স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও সামনে থেকেছেন ছাত্ররা। নেতৃত্বে ছিলেন ছাত্রনেতারা। এভাবে ছাত্রনেতাদের হাত ধরে বহু বিজয়গাথা আছে বাঙালি জাতির।
ছাত্ররাজনীতি মূলত কী? ছাত্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত, নতুন নেতৃত্বের সৃষ্টি এবং ছাত্রদের দাবি আদায় করার উদ্দেশ্যই পরিচালিত হয় ছাত্ররাজনীতি। ছাত্ররাজনীতির পথ ধরেই একসময় চেয়ারম্যান, এমপি, মন্ত্রীর পদে বসে দেশ পরিচালনায় অংশ নেবেন ছাত্রনেতারা, নির্দেশনা দেবেন আমলাদের—নিয়ম ও রীতি এটাই। আমরা যদি ভেবে থাকি, যারা পড়ালেখায় পিছিয়ে আছেন, কেবল তাদের জন্যই রাজনীতি, তবে আমাদের ভাবনা একদমই ভুল। কেননা, মেধাবীরা যদি রাজনীতিতে না আসেন, তবে দেশের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিপর্যয় নেমে আসতে কতক্ষণ! ছাত্র হলেই যে রাজনীতি করতে হবে, বিষয়টা এমন নয়। আবার ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হলেই যে পড়াশোনা গোল্লায় যাবে, এমনটা ভাবাও যুক্তিসংগত নয়। এক্ষেত্রে দরকার মূলত উভয়ের মধ্যে ‘ব্যালেন্স’ ও সৎ কর্মস্পৃহা।
স্বাধীনতার আগে ছাত্ররাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতি থাকলেও স্বাধীনতার পর ছাত্ররাজনীতিতে কিছুটা বিচ্যুতি ঘটে। এর পেছনে মোটাদাগে দায়ী ‘বিভক্তি’। আর ছাত্ররাজনীতির আসল ক্ষতি হয় ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর। বঙ্গবন্ধুকে হারানোর পর ছাত্ররা যেন নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েন! বিভক্ত হয়ে পড়েন! পরবর্তী সময়গুলোতে দেশে ছাত্ররাজনীতি তেমন একটা ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বলেই ধরে নেওয়া যায়। মধ্যে স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রসংগঠনগুলো ঝিমিয়ে পড়া অবস্থা থেকে আবার জেগে ওঠে। ঐক্যবদ্ধ হয়। স্বৈরাচারের পতন ঘটাতে পালন করে ব্যাপক ভূমিকা। বলতে বাধা নেই, এরশাদের পতনের পর রাজনৈতিক দলগুলো বুঝতে পারে, ছাত্রসংগঠনগুলোকে অঙ্গসংগঠন হিসেবে ব্যবহার করা গেলে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করা অনেকটা সহজ হবে। তার পর থেকে ছাত্রদের ব্যবহার শুরু হয় রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করার উদ্দেশ্য হিসেবে। যে দল যখন ক্ষমতায় এসেছে, তারাই ছাত্ররাজনীতিকে ব্যবহার করেছে নিজের মতো করে। যার কারণে ক্যাম্পাস র্যাগিং, চাঁদাবাজি, ভর্তি-বাণিজ্য, শিক্ষক-শিক্ষার্থী হয়রানি, হামলা ও খুনের মতো মারাত্মক অপরাধমূলক কাজকর্ম শুরু হয়েছে। এভাবে চলতে চলতে আজ ছাত্ররাজনীতি অবনতির চরম পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমানে বেশির ভাগ তরুণ শিক্ষার্থীর রাজনীতি নিয়ে একধরনের অনীহা আছে। শুধু তরুণরা নয়, অভিভাবকরাও সন্তানের রাজনীতিতে জড়ানোর বিষয়কে অত্যন্ত ভয়ের চোখে দেখেন। কী সাংঘাতিক কথা! রাজনীতিতে অনীহার কারণ মারামারি, বিশৃঙ্খলা, হানাহানি, খুন, ধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক বিষয়। যেই দেশের ইতিহাসে ছাত্রদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে, সেই দেশে ছাত্ররাজনীতির প্রতি অনীহা জন্মানোর এই চিত্র আসলেই দুর্ভাগ্যজনক। এর জন্য দায়ী আসলে কারা? স্বয়ং রাজনৈতিক দলগুলো নয় কি?
ছাত্ররাজনীতির বর্তমান বেহালদশা দেখে মেধাবীরা তাদের মন ফিরিয়ে নিচ্ছেন ছাত্ররাজনীতি থেকে। এতে জাতি হিসেবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি আমরা নিজেরাই। নেতৃত্বশূন্য হতে যাচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। একটা জাতির জন্য এর থেকে দুঃসংবাদ আর কী হতে পারে?
এক্ষেত্রে বলতে হয়, ছাত্ররাজনীতি নয়, বরং বন্ধ হওয়া উচিত ছাত্ররাজনীতির নামে ‘অপরাজনীতি’। ছাত্রদের রাজনীতি এমন হওয়া উচিত, যেখানে ছাত্রনেতারা কেবল ছাত্রদের অধিকার আদায়ের বিষয়েই কথা বলবেন। কোনো রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যবহারের শিকারে পরিণত হবেন না। ছাত্রবান্ধব ছাত্ররাজনীতির চর্চা শুরু করা গেলে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার ও জাতির কল্যাণের পথ মসৃণ হবে—অতীত ইতিহাস সে কথাই বলে। এতে করে মেধাবীরা আসবেন ছাত্ররাজনীতিতে। জাতি পাবে যোগ্য নেতৃত্ব। এগিয়ে যাবে দেশ।