জ্বালানিসংকটে ইউরোপ জুড়ে বিদ্যুতের ঘাটতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, মোমবাতির আলোয় চলছে ইউরোপের কোনো কোনো দেশে রেস্টুরেন্টের কার্যক্রম। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশও অর্থনৈতিকভাবে স্বস্তিতে নেই। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। হুমকির মুখে পড়েছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খাদ্যনিরাপত্তা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই মন্দা মোকাবিলায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। এই লক্ষ্যে সবাইকে সাশ্রয়ী হতে বলেছেন। তিনি কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়েই ক্ষান্ত হননি, গণভবনের অভ্যন্তরে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, যা দেশের জনগণকে যারপরনাই অনুপ্রাণিত করেছে
জাতীয় নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে রাজনীতির মাঠ ততই সরগরম হচ্ছে। এরই মধ্যে বিএনপি দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে সমাবেশ করেছে। তারা ঢাকার সমাবেশে ১০ দফা ঘোষণার মাধ্যমে তাদের সমাবেশ শেষ করে। এরপর তারা ঘোষণা করে রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ দফা। তাদের সাম্প্রতিক সময়ের কর্মসূচি হচ্ছে পদযাত্রা। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বিএনপি-জামায়াতের নৈরাজ্য ও সহিংসতার প্রতিবাদে শান্তি সমাবেশ ঘোষণা করেছে। এমন পরিস্থিতিতে সচেতন নাগরিক হিসেবে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকার বিষয়ে মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে। এমতাবস্থায় নিরপেক্ষ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে দেশের বিভিন্ন শাসনামলের উন্নয়ন পর্যালোচনা সময়ের দাবি।
স্বাধীনতার পর ৫০ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে আসা বাংলাদেশ সামরিক শাসনসহ অনেক শাসনব্যবস্থা দেখেছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশ পরিচালনার ভার ছিল বিএনপির হাতে। ২০০৭ ও ২০০৮ সালের ‘চেপে বসা দুঃশাসন’ পেরিয়ে আজকের বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের বিস্ময়। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের মোট বাজেট ছিল ৬১ হাজার ৬ কোটি টাকা, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। বিগত ১৫ বছরে আর্থসামাজিক খাতে এক অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। ২০০৬ সালে জিডিপির আকার ৪ লাখ ৮২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা ছিল, তা ২০২১ সালে বেড়ে ২৮ লাখ কোটি টাকার অধিক হয়েছে। ২০০৬ সালে জিডিপির বৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ০৪। আর করোনাকালে ২০২১ সালে ৬ দশমিক ১ জিডিপি অর্জিত হয়েছে। ২০০৬ সালে জনগণের মাথাপিছু আয় ছিল ৫৪৩ মার্কিন ডলার, যা ২০২১ সালে ২ হাজার ৫৫৩ ডলারে উন্নীত হয়, বৈদেশিক রিজার্ভ ছিল ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০২১ সালে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। বিএনপির শাসনামলে খাদ্য ঘাটতি থাকলেও ২০২১ সালে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ২০০৬ সালের রপ্তানি আয় ১০ দশমিক ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থাকলেও ২০২১ সালে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। সেবা খাতসহ রেমিট্যান্স আয় ৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হলেও ২০২১ সালে তা ২৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। ২০০৬ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ, যা ২০২১ সালে ২১ শতাংশের নিচে নেমে আসে।
সমুদ্রসীমা জয়ের কৃতিত্ব আওয়ামী লীগ সরকারের ঝুলিতে জমা রয়েছে। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, পায়রা বন্দর, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, দরিদ্রের জন্য ঘর উপহার, গড় আয়ু বৃদ্ধি, স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশ, ডিজিটাল বাংলাদেশ, কমিউনিটি ক্লিনিক, বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি (৩ হাজার ২০০ মেগাওয়াট থেকে ২৪ হাজার ৪২১ মেগাওয়াট), বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, মডেল মসজিদ কাম ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, দোহাজারী থেকে কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, মেট্রোরেল চালু ইত্যাদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও ঐকান্তিকতার ফসল। এছাড়া ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ এবং ডেলটা প্ল্যান ২১০০ সালের রূপরেখা ঘোষণা তার দেশপ্রেমিক মননের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
বঙ্গবন্ধুর শুরু করা প্রযুক্তিগত উন্নয়ন পরিপূর্ণতা পায় তারই সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে। তিনি ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের ঘোষণা দেন। বর্তমানে দেশব্যাপী সাড়ে ৬ লাখ ফ্রিল্যান্সার কাজ করেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসেও ইন্টারনেটের মাধ্যমে আউটসোর্সিং করে তারা কয়েক শ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছেন। বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষামতে, অনলাইন শ্রমশক্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে দ্বিতীয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কৃষি খাতে বাংলাদেশের অর্জন ঈর্ষণীয়। বাংলাদেশ বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনে ১ম, চাল উৎপাদনে ৩য়, ছাগল উৎপাদনে ৪র্থ, আম উৎপাদনে ৭ম, আউটসোর্সিংয়ে ৮ম, আলু উৎপাদনে ৭ম, সবজি উৎপাদনে ৩য়, মৌসুমি ফল উৎপাদনে ১০ম, পাট রপ্তানিতে ১ম, মাছ উৎপাদনে ৩য়, কাঁঠাল উৎপাদনে ২য়, পেয়ারা উৎপাদনে ৮ম। পরিসংখ্যান বলে, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন আমাদের চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট।
মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রকোপে পৃথিবীর প্রায় সব দেশই বিপর্যস্ত হয়েছিল। এই ভাইরাসে বাংলাদেশের অবস্থাও ছিল নাজুক। সেই পরিস্থিতি থেকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে করোনা ভাইরাস মোকাবিলার সফলতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। তিনি করোনা মহামারি থেকে মানুষের জীবন বাঁচাতে ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে দ্রুত নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করা, টিকাদানে জোর দেওয়া, অর্থনীতি গতিশীল রাখতে সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপ এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। করোনা ভাইরাসের আক্রমণে বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানগণ যখন দিশেহারা, তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান শেখ হাসিনার দৃঢ় মনোবল ও পরিকল্পিত নেতৃত্ব স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হয়েছে। একই সঙ্গে সে সময় দরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ত্রাণ সহযোগিতার পাশাপাশি জীবিকা নির্বাহ ও অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। করোনা সংকট মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ায় আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশ সুনাম অর্জন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ফোর্বস থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক মিডিয়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করেছে।
করোনা মহামারি পৃথিবীকে করেছিল স্তব্ধ। মন্থর হয়েছিল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। করোনার রেশ কাটতে না কাটতেই শুরু হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ। যুদ্ধে পক্ষ-বিপক্ষের শক্তি একে অন্যকে ধরাশায়ী করার বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছে। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অবরোধে পৃথিবীব্যাপী সৃষ্টি হয়েছে জ্বালানিসংকট এবং ভেঙে পড়েছে খাদ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা। জ্বালানি সংকটে ইউরোপ জুড়ে বিদ্যুতের ঘাটতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, মোমবাতির আলোয় চলছে ইউরোপের কোনো কোনো দেশে রেস্টুরেন্টের কার্যক্রম। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশও অর্থনৈতিকভাবে স্বস্তিতে নেই। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। হুমকির মুখে পড়েছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খাদ্যনিরাপত্তা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই মন্দা মোকাবিলায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। এই লক্ষ্যে সবাইকে সাশ্রয়ী হতে বলেছেন। তিনি কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়েই ক্ষান্ত হননি, গণভবনের অভ্যন্তরে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, যা দেশের জনগণকে যারপরনাই অনুপ্রাণিত করেছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশের স্মার্ট মানুষ উন্নয়নে বিশ্বাসী। কোনো বিভ্রান্তিমূলক তথ্য, যুক্তিহীন আশ্বাস তাদেরকে প্রলুব্ধ করতে পারবে না। অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা জনগণ প্রয়োগ করবে—জনগণের রায়েই অব্যাহত থাকবে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা।