মানুষের জীবনের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বিষয় হচ্ছে স্বাধীনতা। স্বাধীনতাহীনতায় কেউ বাঁচতে চায় না। দাসত্বের শৃঙ্খল পরতে চায় না কেউ। কিন্তু অনেকের জীবনে মুক্ত বিহঙ্গের মতো সেই স্বাধীনতার স্বাদ অলীক স্বপ্ন হয়েই থেকে যায়। কোনো কোনো জাতি দশকের পর দশক স্বাধীনতার জন্য রক্ত ঝরিয়েও পাচ্ছে না স্বাধীন ভূখণ্ড, মানচিত্র, পতাকা। অনেক জাতি আবার নামেমাত্র স্বাধীন। ঔপনিবেশিকতার/// বেড়াজালে আটকা।
একবিংশ শতাব্দীতে সভ্যতা-প্রযুক্তি-সংস্কৃতির চরম উৎকর্ষের যুগেও চলছে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। এখনো জ্বলছে ফিলিস্তিন। ইয়েমেনে বোমার শব্দে ঘুম ভাঙে ছোট্ট শিশুর। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে স্থবির গোটা পৃথিবীর অর্থনীতি। তবে স্বাধীনতাযুদ্ধের সঙ্গে এই যুদ্ধের মৌলিক পার্থক্য আছে। মুক্তিসংগ্রামের দিক থেকে ভাগ্যবান জাতি হচ্ছে বাঙালি। যারা নিজের ভাষার নামে একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছে। পেয়েছে স্বতন্ত্র মানচিত্র। লাল-সবুজের পতাকা পতপত করে ওড়ে জানান দেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সগৌরব অস্তিত্ব।
৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম আর ৩০ লাখ শহিদের আত্মদানের পর আমরা লাভ করি স্বাধীনতা। সামরিক শক্তির দিক থেকে এক অসম যুদ্ধ হলেও দেশমাতৃকার জন্য বাঙালির সর্বোচ্চ ত্যাগ আমাদের মুক্তির সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে। পাকিস্তানি বাহিনী এ দেশের অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে ডিসেম্বরের শুরুতেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পিছু হটতে থাকে। ১৬ ডিসেম্বর আসে চূড়ান্ত ক্ষণ। হানাদারমুক্ত হয় দেশ। পাকিস্তানি বাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের পর অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের।
বাংলাদেশের জন্ম থেকেই শুরু হয় নানা ষড়যন্ত্র। এ দেশটির জন্ম হোক—এটা যারা চায়নি, তারা নানাভাবে তাদের হীন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখে, যা শুরু হয়েছিল চূড়ান্ত বিজয় লাভের মাত্র দুদিন আগে লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী হত্যার মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও যাতে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, সেজন্য জাতিকে মেধাশূন্য করার এ নীলনকশা বাস্তবায়ন করে এ দেশের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর আলবদর, আলশামস বাহিনী। বস্তুতপক্ষে এ ষড়যন্ত্র স্বাধীনতা লাভের পরও থেমে থাকেনি।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। শুধু তা-ই নয়, একই বছর ৩ নভেম্বর জেলখানায় নির্মম নিষ্ঠুরতায় হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। যারা স্বাধীনতাসংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এরপর সামরিক শাসন চেপে বসে। অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীরা স্বাধীনতার ইতিহাস ঘুরিয়ে দেয়। দেশকে নিয়ে যায় পেছনের দিকে। কিন্তু এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত হতে দেয়নি।
নানা প্রতিকূলতার পরও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে। কমছে মাতৃমৃত্যু এবং শিশুমৃত্যু। গড় আয়ু বেড়েছে। রোধ করা সম্ভব হচ্ছে বাল্যবিবাহ। নারীরা সমাজে পুরুষের সমান্তরালে এগিয়ে যাচ্ছেন। সরকারপ্রধান, জাতীয় সংসদের স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী। এছাড়া মাঠ প্রশাসনেও নারীরা গুরুত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। নারী জাগরণের অন্যতম রূপকার হচ্ছেন আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
উন্নয়নের রোল মডেল এখন বাংলাদেশ। প্রযুক্তি খাতে অভাবনীয় উন্নতি হচ্ছে। সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের বিষয় ছিল নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে জয়ী হতে চলেছে। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু উদ্বোধন হয়েছে। এই সেতুকে ঘিরে পরিচালিত হচ্ছে বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করেছিল। একই পথ অনুসরণ করেছিল অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীরাও। পদ্মা সেতু প্রকল্পে সম্ভাব্য দুর্নীতির পরিপ্রেক্ষিতে মামলা হয় কানাডার একটি আদালতেও। ইতিমধ্যে সে মামলার রায়ে আদালত একে নিছকই ‘অনুমান ও গুজব’ হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং কানাডার সেই কোম্পানির অভিযুক্ত তিন কর্মকর্তাকে অব্যাহতিও দেয়। দুর্নীতির অভিযোগটি কেবল কিছু ব্যক্তি, সরকারের বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধেও।
অভিযোগ ছিল, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ পেতে কানাডার একটি কোম্পানি ঘুষ দিতে চেয়েছিল। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ ব্যাপারে দুই দফা তদন্ত করেও অভিযোগের সত্যতা পায়নি। সরকারও পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি বা দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়নি বলে জোর দাবি জানালেও কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করেনি বিশ্বব্যাংক।
এটা ছিল বাংলাদেশের মানুষের জন্য এক বিরাট দুঃসংবাদ। সরকারও বিশ্বব্যাংকের এই সিদ্ধান্তে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। কারণ, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন মহাজোট সরকারের অন্যতম নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণ। সেজন্য ক্ষমতায় এসেই পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে সরকার। বিএনপি সরকারের সময় যে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, সেই বিশ্বব্যাংককে আবার বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পে সংযুক্ত করতে সক্ষম হয় আওয়ামী লীগ সরকার। সংগত কারণেই ২৯০ কোটি ডলারের পদ্মা সেতু প্রকল্পে এককভাবে ১২০ কোটি মার্কিন ডলার (৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা) বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্বব্যাংক।
যদিও বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এতে দেশে এক অভূতপূর্ব জনজাগরণের সৃষ্টি হয়। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে এক অভিনব দেশাত্মবোধের উন্মেষ ঘটে। সবাই ‘যার হাতে যা আছে’ তাই নিয়ে পদ্মা সেতুর জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।
অন্যদিকে মালয়েশিয়াসহ অনেক দাতাগোষ্ঠীও এগিয়ে আসে। সরকার সব পথই খোলা রাখে। এমনকি বিশ্বব্যাংক যেসব কারণ দেখিয়ে ঋণচুক্তি বাতিল করে সেগুলোও প্রতিকারের চেষ্টা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মন গলেনি বিশ্বব্যাংকের। অবশেষে এতদিন পর কানাডার আদালতের রায়ে সবকিছু মিথ্যা ও গালগল্প হিসেবে প্রমাণিত হওয়ায় চুক্তি বাতিলের বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তটি যে ভুল ছিল সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশের সর্ববৃহৎ এ নির্মাণ প্রকল্পের অগ্রগতি দেখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আমরা প্রমাণ করেছি, আমরা পারি। এটা ছিল বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ, বড় সিদ্ধান্তের বিষয়। এর সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তি জড়িত ছিল। এমন বৃহত ও খরস্রোতা একটা নদীর ওপর এত বড় সেতু নির্মাণ করে আমরা বিশ্বের সামনে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলাম।’ বাংলাদেশ যে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে তার প্রমাণ পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের আর্থিক সক্ষমতা ও দৃঢ় সংকল্প নেতৃত্বের সাহসের প্রতীক হয়ে থাকবে—এটাই আমাদের বিশ্বাস।
এবারের বিজয়ের মাস এসেছে এমন এক সময়ে; যখন স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হয়েছি আমরা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালন করা হয়েছে দুই বছর আগে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে—এটা স্বস্তির বিষয়। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা এখনো থেমে নেই। তাদের ষড়যন্ত্র চলছে। তারা নানা কায়দায় বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। ধর্মীয় উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিচ্ছে চার দিকে। কিন্তু সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপের কারণে সেটি সম্ভব হচ্ছে না।
স্বাধীনতাহীনতায় কেউ বাঁচতে চায় না। কারণ, স্বাধীনতাই মানুষকে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দেয়। স্বাধীনতা তখনই অর্থবহ হবে—যখন দারিদ্র্য, বৈষম্য থাকবে না। মূলোত্পাটন হবে দুর্নীতির। ন্যায়ের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদা নিয়ে কোনো চিন্তা থাকবে না। রাষ্ট্র পরিচালিত হবে সংবিধানের আলোকে। গণতান্ত্রিক আবহে।
বাস্তবতা হচ্ছে, দুর্নীতি সর্বব্যাপী, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আকাশচুম্বী। করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বকে এক কঠিন অবস্থার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। জ্বালানিসংকটের প্রভাব পড়ছে সর্বত্র। ডলার-সংকটে ব্যাহত হচ্ছে আমদানি-রপ্তানি। যার মারাত্মক রকম নেতিবচাক প্রভাব পড়ছে জনজীবনে। রাজনৈতিক অনৈক্যজনিত সংকট তো আছেই। এই অবস্থায় জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনাটা অত্যন্ত জরুরি।
জাতীয় ঐক্যের মধ্য দিয়েই দেশবিরোধী অপতত্পরতার জবাব দিতে হবে। রুখে দাঁড়াতে হবে অপশক্তির বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে সম্মিলিতভাবে। শোষণমুক্ত, দারিদ্রমুক্ত, বৈষম্যহীন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যেখানে সবাই সবার নাগরিক অধিকার নিয়ে একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে গৌরবের সঙ্গে বসবাস করতে পারবে। এ লক্ষ্যে বিজয়ের মাসে নতুন করে শপথ নিতে হবে।