সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীতে আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। অতীতে মানুষ ছিল প্রকৃতির অধীনে; কিন্তু বর্তমানে প্রকৃতি মানুষের অধীনে। প্রকৃতিকে মানুষ নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করছে ইচ্ছা মতো। ফলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কর্মকাণ্ডের বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে প্রকৃতিতে। প্রযুক্তির কল্যাণ আমাদের জীবনধারাকে সহজ করে দিলেও, পরিবেশ নষ্ট করে দিচ্ছে। প্রাকৃতিক কারণে জলবায়ুতে স্বাভাবিকভাবে কিছু পরিবর্তন হয়। কিন্তু বর্তমানে যে হারে তাপমাত্রা বাড়ছে তার জন্য মানুষের কর্মকাণ্ডই প্রধানত দায়ী। মানুষ যখন থেকে কলকারখানা এবং যানবাহন চালাতে, শীতে ঘর গরম রাখতে তেল, গ্যাস এবং কয়লা পোড়ানো শুরু করল, সেই সময়ের তুলনায় পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েছে ১ দশমিক ২ডিগ্রি সেলসিয়াস। বায়ুমণ্ডলে অন্যতম একটি গ্রিন হাউজ গ্যাস কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ঊনবিংশ শতকের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে। তার মধ্যে বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণেও গ্রিন হাউজ গ্যাসের নির্গমন বাড়ছে। জনসংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে মানুষ জীবনের তাগিদে প্রতিনিয়ত প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তার করছে। গাছপালা ধ্বংস করে আধুনিক যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য নিজেদের উন্নত করছে, অপরিকল্পিত বাসাবাড়ি, কলকারখানা এবং আরামআয়েশের ব্যবস্থা করছে।
আমরা জানি, কোনো দেশের শতকরা ২৫ শতাংশ বনাঞ্চল থাকা প্রয়োজন, কিন্তু বাংলাদেশের পরিমাণ ১৭ শতাংশ হলেও দিনদিন তার পরিমাণ কমে যাচ্ছে। আর এই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা যাচ্ছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, মৌসুমি বায়ুর পরিবর্তন, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, খরা, বন্যা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং উপকূলীয় এলাকায় জোয়ারের মাত্রা বৃদ্ধির ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ৩৫ মিলিয়ন বা সাড়ে ৩ কোটি মানুষ গৃহহারা হয়ে যেতে পারে। আশঙ্কা করা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আগামী ৪০ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রায় ২০০ মিলিয়ন বা ২০ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুতির শিকার হবে। আর সবচেয়ে বেশি বাস্তুচ্যুতির শিকার হবে বাংলাদেশই—৩৫ মিলিয়ন বা সাড়ে ৩ কোটি মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা গত ২০ বছরে ৩ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। ভবিষ্যতে আরো বৃদ্ধি পাবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বা ৩০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের ১৮ শতাংশ লোক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। নিচু এলাকায় লবণাক্ত পানি প্রবেশের ফলে শুধু উপকূলীয় অঞ্চল নয়, হাওর এলাকার মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশে উদ্বাস্তুর সংখ্যা বেড়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশের ৩৫ মিলিয়ন মানুষকে তাদের বাসস্থান ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হবে। সমীক্ষা রিপোর্টে উঠে এসেছে, বাংলাদেশ জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন কমবে প্রায় ৮ শতাংশ এবং গমের উৎপাদন কমবে ৩২ শতাংশ। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে সবচয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিশ্বব্যাংকের ধারণানুযায়ী, ২০৩০ সালে কার্বন নির্গমন ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এজন্য পরিবেশবান্ধব দূষণহীন প্রযুক্তি দরকার। এ প্রযুক্তি অধিকহারে নবায়নযোগ্য ও স্থানান্তরযোগ্য এনার্জি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারবে। বাংলাদেশ যখন দারিদ্র্য নিরসন, অর্থনৈতিক প্রগতি সাধন, জনস্বাস্থ্যের উন্নতি বিধানে ব্যাপক ও বহুমুখী প্রাণান্তকর প্রক্রিয়ায় বিশেষভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার উদ্যোগী, পরিবেশ বিপর্যয় এই সন্ধীক্ষণে সব প্রয়াসকে স্তব্ধ করে দিতে চলেছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হ্রাসে নেওয়া পদক্ষেপ ও কর্মকাণ্ডগুলোকে নীতি নির্ধারণের পরিসর নিয়ে আসা এবং মানিয়ে নেওয়া নীতি গ্রহণের পাশাপাশি কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত করতে হবে। পরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্প কলকারখানা নির্মাণ, সম্পদের যথাযথ ব্যবহার, বেশি করে বৃক্ষরোপণসহ নাগরিকদের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।