বাংলা নববর্ষের অন্যতম বড় সুসংবাদ হচ্ছে ভারতকে সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম আর মোংলা বন্দর ব্যবহারের আনুষ্ঠানিক অনুমতিপত্র (স্থায়ী ট্রানজিট অর্ডার) উপহার দিয়েছে বাংলাদেশ। দীর্ঘদিনের ঝুলন্ত স্বপ্নের কাঙ্ক্ষিত সমাধান ঢাকা-দিল্লির আয়ত্তে চলে এলো এবার।
দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী, কূটনীতিক আর মঙ্গলকামী জনপ্রতিনিধিরা বহুবার বলেছেন, ভারত-বাংলাদেশের সৌহার্দের নির্মাণ আর বিস্তার আজ স্বর্ণযুগে উপনীত। এই ভাবনা নিছক হূদয়তাড়িত নয়। এর সঙ্গে উপলব্ধি আর কল্যাণপ্রসূ কূটনীতি জড়িয়ে আছে। বাংলাদেশ নিকটতম প্রতিবেশী নয় শুধু, সাংস্কৃতিক আর আর্থিক সংশ্রবেও সে ভারতের সবচেয়ে বড় আত্মীয়। এক দেশে ঢিল পড়লে কেঁপে ওঠে অন্যের হৃদয়, শুরু হয় দেহকম্পন। ’৭১ সাল থেকে এ পর্যন্ত এই মুখ, অভিমুখের পঙিক্ত দুই দেশের কণ্ঠস্থ। দুর্যোগে, নেতির উত্থানে (অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বাদ দিলে) ঢাকা আর দিল্লি কখনো মূঢ় নৈঃশব্দকে আমল দেয়নি, দেওয়া সম্ভব নয়। ভৌগোলিক অবস্থান আর অর্থনৈতিক নিশানা তাদের নিশান কে ঊর্ধ্বারোহণের সঙ্গী করেছে। ইতিহাসের অলিখিত নির্দেশ এটি, সামাজিক দাবিরও অবিচ্ছেদ্য শর্ত। যে পাখি ভারতের আকাশপথে উড়তে উড়তে সীমান্তহীন গন্তব্যের দিকে ছুটে যায়, সে বিনা বাধায়, অবলীলায় বাংলাদেশের অসীমকেও স্পর্শ করে। মহাপ্রকৃতি, জীবপ্রকৃতির এ আরেক প্রকাণ্ড সিদ্ধান্ত। একে লঙ্ঘন করা অন্যায়। এর বিরোধিতা মানেই ক্ষুদ্রতার উপাসনা, যা কখনো স্থায়ী হয় না, হবে না।
এসব বলতে হচ্ছে এ কারণেই যে, কখনো কখনো আমাদের দেখতে হয়েছে, ভারতকে বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার প্রশ্নে, কোনো কোনো পরাজেয় শক্তির আত্মঘাতী অনিচ্ছা আর প্ররোচিত অভ্যাসের দৃষ্টিহীন আস্ফাালন। এর যুক্তিগ্রাহ্য ভিত্তি কী? ছিল কি আর্থসামাজিক সমর্থন? এ রকম প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের নয়। আশা করি, তারাই জবাব খুঁজবেন, ব্যাখ্যা করবেন রাষ্ট্রশাসিত অনীহার সমূহ কারণ।
সোমবার ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশের রাজস্ব পরির্ষদ (এনবিআর) ভারতের জন্য চট্টগ্রাম আর মোংলা বন্দর ব্যবহারের স্থায়ী পরিবহন অর্ডার (পিটিও) বিলি করেছে। এতে ভারতের সুবিধা, দুই বন্দরে পণ্যবাহী জাহাজ ঢোকার অনায়াস সুযোগ মিলবে। সড়কপথে আর রেলে হরেক রকম প্রয়োজনীয় সামগ্রী আমাদের উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন রাজ্যে পৌঁছে যাবে। সময়ক্ষয়, অর্থ ব্যয়ের অপচয় বিপুল হারে কমবে। সড়কপথ প্রস্তুত। রেলপথও সম্ভবত শেষ হওয়ার সম্মুখে। তার মানে, জলে-স্থলে, বাণিজ্যিক বন্ধনের হাত ছুঁয়ে দুই অভিন্ন, সমধর্মী প্রতিবেশীর মনের বসবাস আর আকাঙ্ক্ষা আরো দৃশ্যমান, আরো বাস্তবমুখী হয়ে উঠবে।
নিছক আবেগ দিয়ে স্বপ্ন তৈরি হয় না। স্বপ্ন আর আবেগের আয়োজিত অর্জনের বড় রসদ যুক্তি আর অর্থনৈতিক ভারসাম্য। ভারতকে ব্যাপক রেমিটেন্স সরবরাহ করে বাংলাদেশ। তুলনায় বাংলাদেশি পণ্যের বিস্তার আর ব্যবহার অনেক কম। বাণিজ্যিক ভারসাম্য গড়ে তোলার দাবি দিল্লিকে শুনতে হবে। যুক্তি আর প্রয়োজনের ভিত্তিতে ঢাকার নির্মীয়মাণ অর্থনীতিতে ভারতীয় সদিচ্ছার যোগ আর সংযোগ বাড়ানো দরকার। দুই বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে বাংলাদেশ যে শুভেচ্ছা, যে কল্যাণচেতনা প্রদর্শন করল, তার বিনিময়ে ভারত কী উপহার দেবে, দেওয়া সম্ভব, তা ভেবে দেখা দরকার।
প্রেম নিষ্কাম হতে পারে, নিঃস্বার্থ নয়। যে প্রেমে স্বার্থ অস্পষ্ট, অনুচ্চারিত, তা তাৎক্ষণিকের পরশের মতো হাওয়া আর ধুলোয় মিশে যায়। প্রেম, বিশেষ করে কূটনৈতিক হৃদ্যতা আর পারস্পরিক মুগ্ধতার স্থায়িত্ব দাঁড়িয়ে থাকে চার স্তম্ভের ওপর। দিতে হবে, নিতে হবে, ছড়াতে হবে, মিশতে হবে। প্রগাঢ় প্রজ্ঞার রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেছিলেন এই সহজিয়া সত্য। প্রসঙ্গ ভিন্নতর এবং সাংস্কৃতিক একাত্মতাবোধের অপরিহার্য শর্ত হলেও কবির দার্শনিক অনুভব যে কোনো সম্পর্ক নির্মাণেরই শাশ্বত সুন্দর। এরকম চিরমনোহরকে এড়িয়ে কূটনৈতিক আত্মীয়তার বিকাশ কি সম্ভব? মহাযুদ্ধ, যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ আর হিংসাচর্চা লঙ্ঘন করে সভ্যতা নতুন মিনার গড়তে চাইছে। সদর্থক কূটনীতি নির্মিত আর উদীয়মান ভালোবাসার স্থাপত্যে চুন-সুরকির বদলে মসৃণ ভাবাবেগ দাবি করছে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, ভারত আর বাংলাদেশ পুরাতন স্রোতে গা ভাসাবে না, আবিষ্কার করবে যুক্তিময়, ন্যায়যুক্ত দিশা।
এক দেশের জল আরেক দেশে প্রবেশ করে মোহনা সাজিয়ে ঢুকে যায়, মিশে যায় সমুদ্রে, মহাসমুদ্রে। এ তো প্রকৃতির স্বাভাবিক কসরত। এতে বরাবর সায় দিয়েছে আবহমানের ভারতাত্মা। দেশভাগ নামক মর্মান্তিক বিচ্ছেদের পরেও ভারত তার আকাশ, জলস্রোত খণ্ডিত হতে দেয়নি। পাকিস্তান তিন বার যুদ্ধ করেছে। পাকিস্তান অভিমুখী জল আটকায়নি ভারত। পঞ্চনদীর স্রোত উত্তর-পশ্চিমের ঈর্ষাকাতর প্রতিবেশীর ভূখণ্ডে এখনো প্রতিদিন ঢুকছে। ভবিষ্যতেও ঢুকবে।
ফারাক্কার জল বণ্টনেও সংশয়কে প্রশ্রয় দেয়নি দিল্লি। ভারতীয় তিস্তাও একদিন নির্বাধে বাংলাদেশে তিস্তায় যোগ দেবে। স্রোত আর বিশুদ্ধ ভাবাবেগ ব্যাবহারিক কৌশলের সামনে মাথা নোয়ায় না। যে কোনো ফাঁক দিয়ে জলশক্তি আর বাইরের জনশক্তির শুভ্রতা এক হয়ে শস্য-শ্যামল প্রান্তরের শোভা বাড়িয়ে তোলে। ভারতকে তার বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে প্রকৃতি আর মহামানবের অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুফলা সত্যকে প্রকারান্তরে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে ঢাকা। বিনিময়ে কী দেবে দিল্লি?
কবি নীলমণি ফুকনকে নিজের হাতে আঁকা ছবি উপহার দিয়েছিলেন পূর্ব ইউরোপের বিবেক ভাস্কো পোপা। নিজের কবিতা দিতে পারতেন। দিলেন প্রতীকী ভালোবাসার স্মারকচিহ্ন। বলতে আর বিশ্বাস করতে ভালো লাগছে, আলাদা মানচিত্র আর সার্বভৌমিক সত্তা নিয়েই জগত্সভায় যৌথ আসনে বসবে দুই সহোদর দেশ—এরকম মহিমা অর্জনের সড়কে ভারতের দায়িত্ব কী? ব্যাবহারিক রাজনীতিতে লৌকিক আর বহুত্ববাদী সমাজের পূর্ণযোগ সংযোজিত করার লাগাতার প্রচেষ্টা। এরকম প্রত্যাশিত স্থাপনা বাংলাদেশকে উত্সাহিত করবে, আমাদেরও খিদে মেটাবে।
বহু রকম চড়াই-উত্রাই পথ বেয়ে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক অর্জন করেছে তার বিস্তৃতি। দিগন্তকে কখনো ধোঁয়াটে, কখনো সংশয়াচ্ছন্ন, কখনো প্ররোচিত মূর্তির আকারে বিভ্রান্ত হতে দেখা গেছে। সংঘর্ষহীন, মুক্ত প্রেমের নিবিড় ছবি এঁকেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার চিত্রপটের লক্ষ্য সুদূরপ্রসারী, বহু বর্ণে রঞ্জিত। দুর্ভাগ্য, বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় প্রত্যাশিত বিন্যাসে ক্ষয়পোকার অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে। পোকা দমনের সময় পাননি বাংলাদেশের জনক। সপরিবারে তাকে হত্যা, জেলে তার অনুগামীদের খুন, রক্তমাখা হাত নিয়ে ক্ষমতায় অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষমতাবানদের উত্থান এবং আরো বহু ঘটনায় প্ররোচিত হয়ে ঢাকা দিল্লি থেকে দূরে সরে যেতে চাইল। মওলানা ভাসানির মতো গণমুখী নেতাও ফাঁদে পা দিলেন, জল বণ্টনকে ইস্যু করে ফরাক্কা অভিযানের ডাক দিয়ে বসলেন। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী তখন ক্ষমতাচ্যুত। দূষিত আবেগ নিয়ন্ত্রণের শক্তি তার আয়ত্তের বাইরে। ঢাকা-বাংলাদেশের ভুল বোঝাবুঝির বহর বাড়ল। ১৯৭৯ সালে নীরক্ত অভ্যুত্থান ঘটিয়ে প্রেসিডেন্ট এরশাদের মঞ্চে প্রবেশ এবং দিল্লি শাসনে শ্রীমতি গান্ধীর প্রত্যাবর্তনের পর ফিরে এলো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পুরোনো স্থিতি। ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশই বুঝতে পারল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শান্তি আর উন্নয়ন অনেকটাই তাদের স্বচ্ছ সহাবস্থানের ওপর নির্ভরশীল। কালক্রমে ফরাক্কার জলবণ্টন সমস্যার অবসান ঘটল, সীমান্তের অমীমাংসিত ছিটমহল ইস্যুও আলোচনার আওতায় আসতে শুরু করল। এখনো সীমান্ত হত্যা, চোরাই কারবারমুক্ত সম্পর্কের অলিন্দে চিড় ধরাতে চাইছে, পারছে না, ঢাকা-দিল্লি উসকানি রোখার সংকল্পে ঐক্যবদ্ধ। আমাদের ধারণা, ভারত-বাংলাদেশের মৈত্রী ভবিষ্যতে আলোর চেয়েও অধিক আলো ছড়াবে। ভারতের পণ্যবাহী নৌযানকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে শানিত, প্রশ্নহীন সম্ভাবনার এমনই বার্তা ছড়িয়ে দিল বাংলাদেশ।