সুধীর বরণ মাঝি
শিক্ষক, হাইমচর সরকারি মহাবিদ্যায়, হাইমচর, চাঁদপুর।
যারা ধরে জাটকা , তাদের ধরে আটকা। আজকের জাটকাই আগামী দিনের সুস্বাধু পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ বড় রূপালী ইলিশ। এখন যে হারে জাটকা নিধন চলছে তাতে আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশ আগামী দিনে বইয়ের পাতা এবং জাদুঘরেই দেখা যাবে। জেলারা অবোধে জাটকা নিধন করে চলছে। জাটকা নিধনে জেলেরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বাজারে প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে জাটকা।
শুধু বাজারেই নয় গ্রামের অলিগলিতেও ফেরি করে বিক্রি হচ্ছে জাটকা। কিছু বলতে গেলেই চড়াও হয়ে উঠে। দেখি আর ভাবি মানুষ কীভাবে পারে ? তোমরা কতটা অমানবকি ! সামান্য লোভের কারণে আগামীর উজ্জ্বল ভবষ্যিৎকে নিজেদের হাতে গলা টিপে হত্যা করছ। অনকেটা নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার মতো। আমরা এই অবস্থা দেখতে চাই না আমরা এর প্রতিকার চাই। মেঘনায় যে হারে জাটকা নিধন চলছে তা বন্ধ হওয়া দরকার। না হলে ভবষ্যিতে ইলশি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
শুধুমাত্র ঘোষণা দিয়ে জাটকা রক্ষা করা যাবে না। ঘোষণার সাথে সাথে বাস্তবায়নের সফল উদ্যোগও নিতে হবে। আমরা প্রচন্ড লোভের বৃত্তে আটকে পরে গেছি। এই লোভের বৃত্ত ভাঙ্গতে না পারলে জাটকা রক্ষা করা আদৌ সম্ভব নয়।
ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ, জাতীয় সম্পদ এবং ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ প্রথম। এক একটি জটকা ৫-৭মাসের মধ্যে ৭০০গ্রাম থেকে এক কেজি ওজনের ইলিশে পরিণত হয়। একটি জাটকা ৫টাকা আর একটি ইলিশ ৬০০-৯০০টাকা। জাটকা রক্ষা করতে পারলেই ইলিশ হয় এবং তা জাতীয় সম্পদে পরিণত হয়। “আর ধরবো না জাটকা, ইলিশ খাবো টাটকা।” ইলিশ আমাদের মৎস্য পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে । জাটকা রক্ষা করতে পারলেই ইলিশের উৎপাদন বহুগুনে বৃদ্ধি পাবে। আর রক্ষা করতে না পারলে ইলিশখ্যাত বাংলাদেশে অচিরেই ইলিশের আকাল দেখা দিবে। ইলিশ আমাদের জাতীয় সম্পদ এবং ঐতিহ্যে। একে রক্ষা করা এবং এর উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করা প্রতিটি নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।
ডিম ছাড়ার সময় এবং প্রজনন মৌসুমে নদীতে সকল প্রকার মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকলে কতিপয় অসাধু ব্যক্তি অতিরিক্ত মুনাফার আশায় কখনো গোপনে এবং কখনো প্রশাসনের যোগসাজশে কিংবা অন্যকোন উপায়ে জাটকাসহ অন্যান্য মাছ ধরে আমাদের মৎস্য সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে।
জাটকাসহ নদীর অন্যান্য মাছকে রক্ষা করতে হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক নজরদারী, আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং এর সাথে নদীর নাব্যতা এবং গতিকেও সচল রাখতে হবে। নিষিদ্ধ মৌসুমে নদীতে সকল প্রকার মাছ না ধরার অভিযানকে শতভাগ সফল করতে হবে। এই অভিযানকে সফল করার জন্য প্রশাসনের পাশাপাশি সচেতন নাগরিককে এগিয়ে আসতে হবে। নিয়মিত অভিযান পরিচালিত না হওয়ার ফলে জেলেরা অবাধে মাছ ধরাার সুযোগ পাচ্ছে।
চাঁদপুর লঞ্চঘাটের পর থেকে গজারিয়া পর্যন্ত, হাইমচরের চরভৈরবী, ঈশানবালা, মাঝের চর, লক্ষীপুরে, ভোলা এবং বরিশালে অনেকটা
প্রকাশ্যে প্রশাসনের নাকের ডগায় দিনের বেলাতেই নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল দিয়ে অবাধে জাটকাসহ অন্যান্য মাছ নিধন চলছে। মহনপুর এবং গজারিয়ার জেলেরা অতিমাত্রায় বেপরোয়া এবং আগ্রাসী। অবৈধ ভাবে জাটকা ধরার মহোৎসব চলছে। জাটকাসহ নদীর অন্যান্য মাছ রক্ষার অভিযানকে সফল করতে এবং মৎস্য সম্পদকে রক্ষা করতে হলে ভ্রাম্যমান আদালত, নৌ-বাহিনী কোষ্টগার্ডসহ অন্যান্য সকল টহল অভিযানকে আরো জোড়দাড় করতে হবে এবং প্রত্যেকের কাজের সমন্বয় করতে হবে। প্রশাসনের কাজের জবাদিহিতা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল উৎপাদন এবং আমদানি বন্ধ করতে হবে যে কোন মূল্যে। জাটকা নিধনে কেউ যেন কোন প্রকার সুযোগ গ্রহণ করতে না পারে। প্রয়োজনে বিজিবি এবং সেনাবাহিনীকে কাজে লাগাতে হবে এবং বর্তমান সময়ে এর যথেষ্ট প্রযোজনীয়তা রয়েছে।
জেলে এবং নাগরিকদের আরো সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। জাটকাসহ নদীর অন্যান্য মাছ রক্ষার গুরুত্ব বিষয়ে স্থানীয় পর্যায়ে চলমান সভা-সমাবেশ, লিফলেট, ফেস্টুন ইত্যাদি এবং গণমাধ্যমের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার- প্রচরণা পরিচালনা করতে হবে। জাটকা রক্ষার প্রশাসনের কোন রকম অবহেলা পরিলক্ষিত হলে তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। জেলেদের বোঝাতে হবে এই ইলিশের মালিক জেলেরাই এবং তাই জেলেদেরকে ইলিশ রক্ষা এবং লালনপালনের দায়িত্ব নিতে হবে এবং এক্ষেত্রে সরকার এবং প্রশাসন তাদের সর্বোচ্চ সহযোগি।
সন্তানকে লালনপালন করে বড় করলে একসময় যেমন সন্তান তার পিতামাতার দায়িত্ব নেই ইলিশ এবং নদীর অন্যান্য মাছও জেলেদের জীবনে ঠিক তেমনি।
আইনের সঠিক প্রয়োগ যেমন থাকতে হবে তেমনি থাকতে হবে সচতেনতামূলক কার্যক্রম তাহলেই রক্ষা পাবে পৃথিবী বিখ্যাত চাঁদপুরের ইলিশ এবং বাড়বে রপ্তানি আয়। আসুন মৎস্য সম্পদ রক্ষার জন্য প্রশাসনের পাশাপাশি সকলে মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করি। অপরাধিরা সংখ্যায় কম হয়েও আমাদের উপর কর্তৃত্ব করে যাচ্ছে যা কোন ভাবেই কাম্য হতে পারে না। প্রশাসন যত কঠোর হবে জাটকা এবং ইলিশ রক্ষার কার্যক্রম ততো সফল হবে। জাটকা রক্ষা করতে পারলে জেলেদের জীবনে যেমন অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা, নিরাপত্তা আসবে ঠিক তেমনি রাষ্ট্রের অর্থনীতির চাকাও সচল হবে এবং ডলার সংকট মোকাবেলায়ও ভূমিকা রাখবে। আমরা জাটকা রক্ষার সফল অভিযান দেখতে চাই। তা যতই কঠোর ও কঠিনই হউক।