বিদেশি বিনিয়োগে উন্নয়নশীল দেশের ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়নের বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। আজ শুধু জাপানি বিনিয়োগের মাধ্যমে বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করব। আমরা জানি, জাপান বিশ্বের অন্যতম উন্নত ও ধনী দেশ। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। জাপান প্রযুক্তিগতভাবে অত্যন্ত উন্নত এবং জাপানের অটোমোবাইল, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস পণ্যের চাহিদা বিশ্বব্যাপী। দেশটির প্রতিষ্ঠানগুলো বিপুল পরিমাণ অর্থ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করে থাকে। ২০১৯ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাপানের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল প্রায় ২৪ লাখ ১৮ হাজার ৪২০ কোটি টাকা এবং ২০২১ সালে এর পরিমাণ ছিল প্রায় ১৫ লাখ ২৬ হাজার ৪১০ কোটি টাকা।
২০২২ সালের প্রথমার্ধে, থাইল্যান্ডে জাপানের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল প্রায় ৮ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। এ সময়ে ২৮৪ জন বৈদেশিক বিনিয়োগকারী থাইল্যান্ডে বিনিয়োগ করেন এবং এর মধ্যে জাপানি বিনিয়োগকারী ছিলেন ৭১ জন। এ সময়ে ৩ হাজার ১৬৪ জন থাইল্যান্ডের নাগরিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। ইলেকট্রনিকস, কেমিক্যাল, বায়োপ্লাস্টিক প্রভৃতি খাতে থাইল্যান্ডে প্রচুর জাপানি বিনিয়োগ হয়েছে। আকর্ষণীয় এবং স্থিতিশীল বিনিয়োগ নীতি, জাপান ও থাইল্যান্ডের মধ্যে অর্থনীতিক অংশীদারত্বের চুক্তি, উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ, থাইল্যান্ড ও জাপানের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রভৃতির কারণে থাইল্যান্ডে প্রচুর পরিমাণ জাপানি বিনিয়োগ হয়েছে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত আশিয়ান দেশগুলোর মধ্যে জাপান থাইল্যান্ডে সর্বাধিক (৩৬ শতাংশ) বিনিয়োগ করেছে। ২০১৬ সালে জাপানের মোট বিনিয়োগের ৩৬ শতাংশ ছিল থাইল্যান্ডে। জাপানির বিনিয়োগের ফলে থাইল্যান্ডে কৃষি এবং শিল্প বিকাশ লাভ করেছে এবং এর প্রভাব পড়েছে থাইল্যান্ডের অর্থনীতিতে।
এবার আসা যাক, মালয়েশিয়া প্রসঙ্গে। ২০২১ সালে মালয়েশিয়ায় জাপানের বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৯ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা। কিছু দিন পূর্বে মালয়েশিয়া প্রায় ২২ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা জাপান থেকে বৈদেশিক বিনিয়োগ হিসেবে অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এর অর্থ মালয়েশিয়ার ইলেকট্রনিকস এবং ইলেকট্রিক্যাল শিল্প, আইটি, যোগাযোগ ইত্যাদি খাতে ব্যয় হবে। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় ১ হাজার ৪০০-এর বেশি জাপানি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। স্থানীয় অধিবাসীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ট্রেনিং প্রোগ্রামের ব্যবস্থা, স্থানীয় বিক্রেতাগণের উন্নয়ন, কর্মসংস্থানের সুযোগ, মালয়েশিয়ার বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের মিশন প্রভৃতির কারণে জাপান মালয়েশিয়ায় বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। জাপানের বিনিয়োগ মালয়েশিয়ার অর্থসামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।
এদিকে ২০১৯ সালে ফিলিপাইনের অর্জিত বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল প্রায় ৯০ হাজার ২০০ কোটি টাকা। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত জাপান প্রায় ৩ হাজা ৩৬৮ কোটি টাকা ফিলিপাইনে বিনিয়োগ করে, যা সে সময়ের প্রাপ্ত বিনিয়োগের ৩১ দশমিক ৯২ শতাংশ। ফিলিপাইনের বিভিন্ন অর্থনৈতিক জোনগুলোতে ৮৯১টি জাপানি প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং ১৯৯৫ সাল থেকে ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় ১ লাখ ৪১ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা ফিলিপাইনে বিনিয়োগ করেছেন, যা ফিলিপাইন অর্থনৈতিক জোনগুলোতে বৈদেশিক বিনিয়োগের ২৭ দশমিক ৫২ শতাংশ। ব্যবসায়বান্ধব পরিবেশ, ইংরেজিতে কথা বলতে সক্ষম যুবশ্রেণির শ্রমবাজার, বিনিয়োগবান্ধব আইন এবং নীতি ইত্যাদির কারণে ফিলিপাইন জাপানি বিনিয়োগকারীগণকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে।
এবার বাংলাদেশের কথা বলব। ২০২১ সালে বাংলাদেশে প্রাপ্ত বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩০ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অরগানাইজেশনের তথ্য মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে ৩৩৪টি জাপানি প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং এদের প্রায় ৭০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে যাচ্ছে আগামী দু-এক বছরের মধ্যে। জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অরগানাইজেশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের শ্রমিকদের মান আশানুরূপ নয়। দক্ষ জনবলের অভাব বাংলাদেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির একটি অন্যতম অন্তরায়। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে জাপান টোবাকো ইন্টারন্যাশনাল আমাদের দেশের আকিজ গ্রুপের টোবাকো ব্যবসাকে প্রায় ১৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা প্রদানের মাধ্যমে আয়ত্ত করে নেয়। ২০১৮ সালে হোন্ডা মুন্সীগঞ্জের ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্ট শুরু করে। বাংলাদেশ সরকার এবং জাপান ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশন এজেন্সির মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জ জেলায় আড়াইহাজার উপজেলায় ১ হাজার একর জমির ওপর জাপানিজ ইকোনমিক জোন স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এবং ২০২৩ সালের মার্চ মাসে জাপানিজ ইকোনমিক জোনে উৎপাদন শুরু হতে যাচ্ছে। জাপানের বিখ্যাত মিতসুবিশি নামক প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে।
জাপান আশা করছে, জাপানিজ ইকোনমিক জোনে প্রায় ১০০টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ অর্জন সম্ভব হবে। জাপানিজ ইকোনমিক জোনে কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে প্রায় ১ লাখ মানুষের। ইতিমধ্যে ৪০টি কোম্পানি জাপানিজ অর্থনৈতিক জোনে কাজ শুরু করছে এবং এর মধ্যে ৩০টি প্রতিষ্ঠান জাপানের। বর্তমানে বাংলাদেশে ৩৩৪টি জাপানের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। জাপানের বিনিয়োগকারীগণ ইঞ্জিনিয়ারিং, কেমিক্যাল, অটোমোবাইল, এগ্রো ফুড, ফার্মাসিটিক্যালস প্রভৃতি শিল্পে বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী। জাপানিজ ইকোনমিক জোনের ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা। বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করা প্রয়োজন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপানি বিনিয়োগকারীগণের কাছে বড় ধরনের বিনিয়োগ আশা করছেন। যার মাধ্যমে আমরা উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারি।
কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে বিনিয়োগের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে বৃদ্ধি পাবে কর্মসংস্থান এবং আয়স্তর। সম্পদের সুষম বণ্টনের জন্য বিনিয়োগ জরুরি। বিশ্বের উন্নত দেশসমূহ বিনিয়োগের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও দারিদ্র্য দূরীকরণ করতে সক্ষম হয়েছে। জাপান প্রযুক্তিগতভাবে অত্যন্ত অগ্রসর একটি দেশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের কানেকটিভিটি বৃদ্ধির মাধ্যমে এবং পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে জাপানি বিনিয়োগকারীগণকে আকৃষ্ট করে জাপানি বিনিয়োগ আনতে সক্ষম হয়েছে এবং জাপানি বিনিয়োগ তাদের অর্থসামাজিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। তাই জাপানসহ যে কোনো উন্নত দেশের বিনিয়োগ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আমাদের সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এজন্য বেকার তরুণদের আরো উন্নত প্রশিক্ষণও প্রয়োজন।