আহত বাঘ, নাকি তীব্র ক্ষুধায় শিকারের জন্য ছটফট করা বাঘ— কোনটির সঙ্গে তুলনা করবেন জার্মানিকে? বিশ্বকাপের আগের ২১ আসরের মধ্যে ১৯ বারই অংশ নেওয়া জার্মানি চ্যাম্পিয়ন হয়েছে চার বার। ৯ বার উঠেছে ফাইনালে। সেমিফাইনাল খেলেছে ১৩ বার! বিশ্বকাপের চিরকালীন ফেভারিট সেই জার্মানি টানা দ্বিতীয় বারের মতো গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায়ের শঙ্কায় থর-হরিকম্প। শুধু কাঁপছে বললে কম হবে, এর সঙ্গে জার্মানরা চরম অস্থিরতায়ও ভুগছে। এই অস্থিরতার চাদর মুড়িয়েই আজ গ্রুপ পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচটা খেলতে নামছে জার্মানি। কোস্টারিকার বিপক্ষে যে ম্যাচটি তাদের জন্য ‘ফাইনাল’। বা তার চেয়েও বেশি কিছু।
বিপদটা জার্মানদের মতো নয়, তবে ই গ্রুপ থেকে স্পেন, জাপান, কোস্টারিকা এবং এফ গ্রুপ থেকে ক্রোয়েশিয়া, বেলজিয়াম ও মরক্কো আজ কঠিন পরীক্ষার সামনে। দুই গ্রুপের আট দলের মধ্যে স্বস্তিতে কেবল কানাডা, যারা প্রথম দুই ম্যাচ হেরেই টুর্নামেন্ট থেকে ছুটি নিয়ে ফেলেছে! ফলে আজ তাদের কোনো টেনশন নেই।
যে দলটি ৯ বার ফাইনালে উঠে চার বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, সেই জার্মানির হাতে আজ নকআউটে উঠার পুরো ক্ষমতা নেই! মানে জার্মানরা আজ নিজেদের ভাগ্য নিজেরা গড়তে পারবে না। শঙ্কার পাহাড় ঠেলে শেষ ষোলোতে উঠতে হলে অন্যের সাহায্যও নিতে হবে তাদের! দুই ম্যাচ থেকে তাদের সংগ্রহ মাত্র ১ পয়েন্ট। এরপরও তাদের আশার সলতেটা জ্বলছে। তবে সেটা এতটাই নিভু নিভু যে, তা সহমিয়ায় জ্বালাতে হলে নিজেদের সামর্থ্যের সর্বোচ্চটা করার পাশাপাশি অন্যের দিকেও তাকিয়ে থাকতে হবে।
তাদের সামনে আজ সমীকরণটা এমন, প্রথমত কোস্টারিকার বিপক্ষে নিজেদের জিততে হবে। পাশাপাশি সর্বনাশ কামনা করতে হবে স্পেন কিংবা জাপানের। যারা গ্রুপের অন্য ম্যাচে মুখোমুখি হবে। মানে স্পেন-জাপানির যে কোনো এক দলের হার কামনা করতে হবে। তবে নিজেদের জয়ের পাশাপাশি প্রার্থনায় জার্মানরা হয়তো জাপানের সর্বনাশ কামনাই করবে বেশি! কারণ, নিজেরা জিতলে এবং স্পেনের কাছে জাপান হারলে অনায়াসেই নকআউটে যেতে পারবে জার্মানি। কিন্তু জাপানের কাছে স্পেন হারলে জার্মানদের কোস্টারিকার বিপক্ষে জিততে হবে বিশাল ব্যবধানে। যদি স্পেন-জাপান ম্যাচটি ড্র হয়, সেক্ষেত্রেও জার্মানিকে অন্তত ২-০ গোলে জিততে হবে।
এই সমীকরণ স্পষ্টই বলছে, আজ কঠিন পরীক্ষার সামনে জার্মানরা। কঠিন পরীক্ষা ২০১০-এ চ্যাম্পিয়ন স্পেন, গত আসরের রানার্সআপ ক্রোয়েশিয়া, বেলজিয়াম, জাপান, মরক্কোর জন্যও। কানাডা বাদে দুই গ্রুপের বাকি সাত দলেরই যেমন নকআউটে যাওয়ার আশা আছে, তেমনি সাত দলেরই বাদ পড়ার শঙ্কা আছে। প্রশ্ন হলো, কঠিন এই পরীক্ষায় উতরে শেষ ষোলোতে পা রাখতে পারবে জার্মানি, স্পেন, ক্রোয়েশিয়ার মতো দলগুলো? নাকি তাদের আশাকে দুরাশায় রূপান্তরিত করে শেষ ষোলোর টিকিট হাতে হাসবে জাপান, মরক্কো, কোস্টারিকার মতো দলগুলো?
সম্ভাবনার দুই দুয়ারই খোলা। তবে জার্মানরা যে আজ ক্ষুধার্ত বাঘের মতোই কোস্টারিকার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, সেটি না বললেও চলে। ২০১৮ বিশ্বকাপে এশিয়ার দল দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে হেরে দ্বিতীয় বারের মতো গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছিল জার্মানি। এবারও এশিয়ারই দেশ জাপানের কাছে প্রথম ম্যাচে হেরে গর্তে পড়ে গেছে তারা। স্পেনের বিপক্ষে কোনো রকমে ১-১ ড্র করে আশার নিভু নিভু প্রদীপটা জ্বালিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। আজ নিশ্চিতভাবেই তারা মরণ কামড় দেবে। তবে প্রতিপক্ষ কোস্টারিকারও নকআউটে যাওয়ার আশাটা বেঁচে আছে। সুতরাং তারাও যে জার্মানির চোখ রাঙানিতে ভয় না পেয়ে পালটা আঘাতের চেষ্টা করবে, সেটি অনুমেয়ই। যে জাপানের কাছে জার্মানরা প্রথম ম্যাচে হেরেছে, সেই জাপানকে হারিয়েই নিজেদের স্বপ্নটা জিইয়ে রেখেছে কোস্টারিকা। কাজেই হানসি ফ্লিকের জার্মানির হুংকার-গর্জনে জল ঢালার সামর্থ্য এবং ইচ্ছা, কোস্টারিকানদের দুটোই আছে। সুতরাং দুই দলের কঠিন পরীক্ষাটা সত্যিকার অর্থেই কঠিন হবে।
লুইস এনরিকের স্পেন শুরুটা করেছিল অবিশ্বাস্যভাবে, কোস্টারিকাকে ৭-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে। কিন্তু জার্মানির সঙ্গে দ্বিতীয় ম্যাচে ড্র করায় তাদের শঙ্কাটা রয়েই গেছে। তবে আজ জাপানের বিপক্ষে ড্র করলেই চলবে তাদের। জিতলে তো কথাই নেই। এমনকি হারলেও সম্ভাবনা থাকবে তাদের। ফলে লুইস এনরিকের দলের শঙ্কার চেয়ে আশাটাই বড়।
শঙ্কার তুলনায় আশা বড় ক্রোয়েশিয়ারও। কিন্তু আজ তাদের মুখোমুখি হতে হবে সোনালি প্রজন্মের বেলজিয়ামের। যারা কাতারে এসেছেন হূদয়ে শিরোপার ছবি আঁকিয়ে। সুতরাং সমীকরণ সহজ হলেও লুকা মডরিচের ক্রোয়েশিয়ার জন্য তা মেলানো সহজ হবে না। আফ্রিকার দেশ মরক্কো মুখোমুখি হবে টেনশনমুক্ত কানাডার। যারা বিদায়ের আগে মরক্কোকে একটা ধাক্কা দিতে চাইবে। দীর্ঘ ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপে খেলতে এসে একেবারেই শূন্য হাতে ফিরলে কেমন হয়! তাই বিদায় বেলায় তারা অন্তত একটা জয় মুঠোবন্দি করতে চাইবে। তবে মরক্কোর জন্য অনুপ্রেরণাটা আরো বড়। তাদের সামনে দ্বিতীয় বারের মতো বিশ্বকাপের নকআউটপর্বে যাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ। কানাডাকে হারালেই মিলবে সেই সোনার হরিণ। ওয়ালিদ রেগরাজডুইয়ের মরক্কো কোনোভাবেই চাইবে না এই সুযোগ হাতছাড়া করতে।