সর্বোচ্চ ২০০ জন দর্শক থাকতেন মাঠে। সেটাও নিখাঁদ বিনোদনের খোঁজে। সমর্থন বলতে কিছুই ছিল না জিরোনা এফসিতে। শীর্ষ পর্যায় দূরে থাক, দ্বিতীয় বিভাগের ধারেকাছেও ছিল না তারা। প্রায় ৫০ বছর ধরে দ্বিতীয় বিভাগের বাইরে থাকা একটা দলের চিত্র তো এমনই হওয়ার কথা!
সেই জিরোনাই এখন স্প্যানিশ ফুটবলের প্রচারের আলোয় ঝলমলে। বিশ্ব ফুটবলে কুড়াচ্ছে ভূয়সী প্রশংসা। নামধাম কিংবা আলোচনায় না থাকা একটা ক্লাব কীভাবে ভোজবাজির মতো পাল্টে গেল? দুনিয়াজুড়ে তাদের বিখ্যাত হয়ে ওঠার নেপথ্যের গল্পটা কী? কার ছোঁয়ায় জিরোনার এই ফুটবল-বিপ্লব?
লা লিগায় রাজত্ব করছে জিরোনা। কাতালুনিয়ার এই ক্লাব তাদের অঞ্চলের সবচেয়ে বিখ্যাত দল বার্সেলোনাকে হারিয়ে দিয়েছে। বসেছে লা লিগার পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে। কিন্তু একটা সময় এই দলটার না ছিল কোনও সমর্থক, না ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মানসিকতা। ২০১৭ সালে প্রথমবার তারা খেলে লা লিগায়। এর আগের সময়টা ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন।
স্প্যানিশ ফুটবল সিস্টেমে বেশিরভাগ সময় পঞ্চম কিংবা চতুর্থ বিভাগই ছিল জিরোনার ঠিকানা। খেলতে হতো কাতালুনিয়ার দলগুলোর বিপক্ষে। ২০০৭ সালেও কাতালান ক্লাবটি খেলেছে তৃতীয় বিভাগে। এরপরই পাল্টাতে থাকে জিরোনার ইতিাস। ৪৯ বছর পর তারা স্প্যানিশ ফুটবলের দ্বিতীয় বিভাগে ফিরলে বাড়তে থাকে সমর্থন। ফুটবলে আশা খুঁজতে থাকেন জিরোনা অঞ্চলের বাসিন্দারা।
এই অঞ্চলেই বেড়ে উঠেছেন দেলফি গেলি। বার্সেলোনা ও আতলেতিকো মাদ্রিদের সাবেক এই রাইট ব্যাক এখন জিরোনার সভাপতি। কাতালান ক্লাবটির সব ইতিহাসই তার জানা। অনেক দুঃসময়ের সাক্ষী তিনি। আফসোস করে এক সাক্ষাৎকারে গেলি বলেছেন, ‘আমাদের এখানে জিরোনার (এফসি) কোনও অস্তিত্ব ছিল না। এখনকার লোকেরা হয় বার্সেলোনা কিংবা রিয়াল মাদ্রিদের সমর্থক ছিল। এমনকি এস্পানিওলের ভক্তও ছিল। এখানে একটা বাস্কেটবল দল ছিল, যারা জাতীয় পর্যায়ে খেলতো। ওই দলেরও সমর্থক ছিল। কিন্তু জিরোনায় ফুটবল… এটা এখানে খুঁজে পাওয়া যেত না।’
তবে জিরোনা দ্বিতীয় বিভাগে ফিরলে সব কিছু পাল্টাতে থাকে। সমর্থন ও খেলার মান ভালো হলেও আরেকটি দিক দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ক্লাব পরিচালনার খরচ। ক্লাব ও খেলোয়াড়দের বেতনের ভারে বাড়তে থাকে জিরোনার ঋণের বোঝা। সেটা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে স্প্যানিশ কর অধিদপ্তরের কাছে ২.৩ মিলিয়ন ইউরো ও স্প্যানিশ পাবলিক হেল্থ সার্ভিসের কাছে ঋণ ৮ লাখ ইউরোর। সঙ্গে খেলোয়াড়দের বেতন দিতে না পারার বিষয়টি তো ছিলই।
ওই সময় জিরোনার মালিক ছিলেন স্থানীয় ব্যবসায়ী জোসেফ দেলগাদো। উপায় না দেখে ২০১৩ সালে ক্লাবের ৮০ শতাংশ শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন। আর্জেন্টাইন আইনজীবী রিকার্দো পিনির সঙ্গে প্রায় ছয় মাসের আলোচনার পর ২ মিলিয়ন ইউরোতে সমঝোতাও হয়। কিন্তু পিনি তার সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেললে দেউলিয়া হওয়ার জোগাড় জিরোনার।
চারদিক যখন অন্ধকার হয়ে আসছিল, ঠিক সেসময়ই জিরোনায় যোগ দেন পেরে গার্দিওলা। ম্যানচেস্টার সিটির কোচ পেপ গার্দিওলার ভাই। তার ছোঁয়াতেই পাল্টে যেতে থাকে জিরোনার ইতিহাস। পেরের মধ্যস্থতায় ফরাসি প্রতিষ্ঠান ‘টিভিএসসি ফুটবল’-এর কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয় জিরোনা। ফরাসি প্রতিষ্ঠানটির মালিক লুইস দুতারেত ও সামির বুদজেমার ২ মিলিয়ন ইউরোর সঙ্গে খেলোয়াড়দের বেতন পরিশোধে আরও ৬ লাখ ইউরো বাড়তি দিয়েছিলেন।
এরপর ২০১৭ সালে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। প্রথমবার লা লিগায় সুযোগ পায় জিরোনা। ওই সময়ই ঘোষণা আসে, ক্লাবের সম্পূর্ণ শেয়ার কিনে নিয়েছে ম্যান সিটির মালিকানা প্রতিষ্ঠান ‘সিটি ফুটবল গ্রুপ’। তাদের বিনিয়োগের নেপথ্যেও পেরে গার্দিওলা। স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যমের দাবি, এই চুক্তিতে বড় ভূমিকা রেখেছেন পেপ গার্দিওলা।
সিটি ফুটবল যোগ হওয়ায় জিরোনা সমর্থকদের মনে ভয় ছড়ায়- এবার হয়তো ক্লাবের নাম পাল্টে যাবে। কারণ সিটি ফুটবলের মালিকানায় প্রায় সব ক্লাবেরই নাম পাল্টেছে। অন্তত ‘সিটি’ শব্দ যোগ হয়েছে। সেই হিসেবে জিরোনার সমর্থকদের ধারণা হয়, তাদের ক্লাবের নাম হতে যাচ্ছে ‘জিরোনা সিটি’। যদিও নাম পরিবর্তন হয়নি জিরোনার।
সিটি ফুটবল মানেই অর্থেই ঝনঝনানি। তবে জিরোনায় সেটি হয়নি। নামিদামি খেলোয়াড়ের দিকে তারা ছুটেনি। তবে জিরোনার দক্ষ ম্যানেজমেন্ট গড়ে তুলতে রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এছাড়া স্কাউটিংয়ের মাধ্যমে সম্ভাবনাময় খেলোয়াড় তুলে দিচ্ছে জিরোনোর হাতে।
যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ সাভিও। ১৯ বছর বয়সী এই ব্রাজিলিয়ান লা লিগার অন্যতম আকর্ষণ। ফ্রান্সের দ্বিতীয় বিভাগে খেলা ত্রোয়ের মালিক ‘সিটি ফুটবল গ্রুপ’। এই ক্লাবের জন্যই ৭ মিলিয়ন ইউরোতে ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গারকে কিনেছে তারা। যদিও ২০২৩ সাল থেকে তিনি ধারে খেলছেন জিরোনায়।
দক্ষ ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়দের নিয়ে সাজানো জিরোনার স্কোয়াড। তারপরও লা লিগায় ফিরতে পারছিল না। ২০১৭ সালে প্রথমবার লা লিগায় খেলার পর ২০১৮-১৯ মৌসুমেও টিকে ছিল। কিন্তু ২০১৯-২০ মৌসুমে নেমে যেতে হয় দ্বিতীয় বিভাগে। তাহলে উপায়? এবার জিরোনা দায়িত্ব তুলে দেয় মাইকেলের কাঁধে। যাকে ডাকা হয় ‘প্রমোশন এক্সপার্ট’ নামে। কারণ রায়ো ভায়েকানো ও হুয়েস্কা লা লিগায় ফিরেছিল তারই অধীনে।
যদিও শুরুর দিকে সুবিধা করতে পারেননি। একটা সময় বরখাস্ত হওয়ার শঙ্কাও জেগেছিল তার। তবে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে ২০২২ সালে কাতালান ক্লাবকে তুলে আনেন লা লিগায়। দলকে আরও সুশৃঙ্খল করে ২০২৩-২৩ মৌসুমে লিগ শেষ করে ১০ নম্বরে থেকে। আর এবার কাটাচ্ছেন স্বপ্নের মতো এক মৌসুম।
যেখানে আছে শিরোপা জেতার সম্ভাবনাও! যদিও লিগের মাঝপথ পার হয়নি এখনও। স্বাভাবিকভাবেই এত আগে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে না। তবে বার্সেলোনাকে যেভাবে হারিয়ে দিয়েছে, তাতে আত্মবিশ্বাসের পারদ আকাশেই চড়ার কথা। কে জানে, এই আত্মবিশ্বাসে নতুন রূপকথা লিখে ফেলতেই পারে জিরোনা!