জি-২০ হচ্ছে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক জোট। ২০টি দেশের সমন্বয়ে এই জোট গঠিত হয় ১৯৯৯ সালে ২৬ সেপ্টেম্বর। জোটভুক্ত সদস্য দেশগুলোর সম্মেলন শুরু হয় ২০০৬ সাল থেকে। বৈশ্বিক অর্থনীতির মূল বিষয়সমূহের ওপর আলোচনার জন্য বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে একত্রিত করার উদ্দেশ্যেই এই জোট গঠিত হয়। সম্প্রতি বালিতে ১৭তম সম্মেলন শেষ হয়েছে। সম্মেলনের পরবর্তী এক বছরের জন্য জি-২০-এর মতো পৃথিবীতে আরো জোট রয়েছে; যেমন—জি-৭, জি-৮, জি-৭৭, বিমস্টেক, এডিবি, ইকো, ওপেক, অ্যাপেক ইত্যাদি। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ সম্পর্কে কমবেশি সবারই জানা। বিভিন্ন অর্থনৈতিক জোট ছাড়াও আন্তর্জাতিক অনেক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই পৃথিবীতে। মূলত মানবকল্যাণ ও সভ্যতা বিকাশের লক্ষ্য নিয়েই এসব সংগঠনের জন্ম হয়েছে। তবে সাধারণ মানুষের কল্যাণ কতটা হয়েছে, তার একটা বড় প্রশ্ন থেকেই যায়।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিশ্ব আজ বড় অশান্ত, যেন ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। আধুনিক সভ্যতা বিকাশের পশ্চাতে মানুষ তার সুকুমারবৃত্তির কথা বিস্মৃত হয়ে সাধারণ প্রাণীর মতো নিম্নতর বৃত্তিকে চরিতার্থ করার অশুভ বাসনা পোষণ করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এই বাসনা পূর্তির জন্য সে দৈহিক ও বৌদ্ধিক শক্তি বিস্তার করে চলেছে। এতে কেউ কেউ আপাতত সাফল্য লাভ করে গর্বিত হলেও পরিণামে মানব সমাজের যে শান্তি ভঙ্গ হচ্ছে, সেদিকে তাদের কোনো খেয়াল নেই। মানব সমাজে এমন একটি নেশার জ্বাল বিস্তৃত, যেন শুধু চাই আর চাই। যার আছে, সে আরো চায়। না পেলে অতৃপ্ত। যার নেই, তার পাওয়ার আশা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। অশান্ত বিশ্বকে সব ক্ষেত্রে স্থিতিশীল ও শান্তিময় বিশ্ব গড়ে তোলার মানসিকতায় উদার ও নৈতিক বক্তব্য রেখেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। জি-২০-এর সভাপতিত্ব গ্রহণের সময় তিনি বলেছেন, ‘পূর্বতন জি-২০-এর ১৭টির সভাপতিত্বে অন্যান্য ফলাফলের মধ্যে ম্যাক্রো অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, যুক্তিগ্রাহ্য করের ব্যবস্থা, সদস্য দেশগুলোর ওপর থেকে করের বোঝা কমানো সুনিশ্চিত করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ফল প্রদান করেছে। এসব অর্জিত ফল থেকে আমরা লাভবান হব এবং এগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে নিজেদের আরো গড়ে তুলব। যা-ই হোক না কেন, ভারত যেহেতু এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছে, আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করেছি, এখনো কি জি-২০-এর আরো অগ্রগতি হতে পারে? সামগ্রিকভাবে মানব সভ্যতার উপকার করার জন্য একটি মৌলিক মানসিকতার পরিবর্তনকে অনুঘটক করতে পারি? আমি বিশ্বাস করি আমরা পারি।’ তার বক্তৃতায় উচ্চতর মস্তিষ্কের মহৎ কর্ম প্রচেষ্টার কথাই প্রতিভাত হয়েছে। কেননা, মানুষের উচ্চতর মস্তিষ্কের মহত্ কর্ম প্রচেষ্টা ও তার পূর্ণতা বিধানের সামর্থ্য ইন্দ্রিয়জ বাসনা-কামনার দাসত্ব থেকে, তার নিম্নতর প্রকৃতির প্ররোচনা ও প্রকৃতির দাসত্ব থেকে মুক্তির সঙ্গে সমানুপাতিক। আপন বিচারশক্তি ও কল্পনা দ্বারা উচ্চতর মস্তিষ্ক দৈহিক সংবেদনশীলতাকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে, নিজের প্রকৃত স্বরূপ জেনে নিজেকে যথার্থ উন্নত করতে পারে। নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘আমাদের পরিস্থিতির দ্বারা আমাদের মানসিকতা তৈরি হয়। সমগ্র ইতিহাসে মানব সভ্যতা অভাবের মধ্যে বাস করছিল। আমরা সীমিত সংস্থানের জন্য লড়াই করেছিলাম। কারণ আমাদের বেঁচে থাকা নির্ভর করত অন্যদের সেই সংস্থানের অধিকারকে অস্বীকারের দ্বারা। ভাবনা আদর্শ ও ব্যক্তি পরিচয়ের মধ্যে সংঘাত ও প্রতিযোগিতাই আদর্শ হয়ে উঠেছিল। দুর্ভাগ্যবশত আজও আমরা সেই একই শূন্য মানসিকতার ফাঁদে আটকে রয়েছি। যখন দেশগুলো ভুখ ও সম্পদ নিয়ে লড়াই করে, আমরা তখন দেখি। আমরা এটা লক্ষ করি যখন অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সরবরাহ অস্ত্রশস্ত্রে পর্যবসিত হয়।’
নরেন্দ্র মোদি তার বক্তব্যে কার্যত মানুষের আধ্যাত্ম বিকাশের প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরেছেন। নৈতিক সচেতনতা, সমাজ সচেতনতা এবং পরস্পরের যথার্থ সহমর্মিতার মাধ্যমেই মানুষের আধ্যাত্ম বিকাশের প্রথম অভিব্যক্তি ঘটে। আধ্যাত্মিক শিক্ষা, আধ্যাত্মিক বিকাশ মানুষের কল্যাণের এক বিশাল পরিমণ্ডল রচনা করে। জি-২০-এর সদস্য দেশগুলোর মানুষের মধ্যে আধ্যাত্ম বিকাশের অপরিহার্যতা বিবেচনা করে মোদি বিশ্ব একতার ভাবনাকে সামনে নিয়ে এসেছেন। তিনি নতুন স্লোগান তুলেছেন এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ। এটি কোনো স্লোগানে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, এর জন্য কাজ করতে হবে সমন্বয়ী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে। জি-২০-এর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর কোটি কোটি নর-নারীর চরিত্র গঠনের মাধ্যমে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করে সমতার ভিত্তিতে এগিয়ে যেতে হবে। যারা বুদ্ধিমান ও অকোতভয়, তারা সানন্দে মোদির কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করবেনই। আজ আমাদের নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে—পৃথিবীতে আমরা কী ধরনের সমাজ গড়তে চাই, কী ধরনের মানবিক উৎকর্ষের লক্ষ্য আমরা জনসাধারণের সামনে তুলে ধরব। পৃথিবীর একশ্রেণির মানুষ যথেষ্ট কষ্ট সহ্য করছে। অবহেলা আর শোষণ ছাড়া তাদের কপালে কিছুই জোটেনি। কতিপয় নেতৃত্বের হৃদয়ের কঠোরতা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানবজাতির দুর্দশার কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। দুর্বল ও অনুন্নত শ্রেণির কোনো স্থান সমাজে অতীতে ছিল না, বর্তমানেও নেই। তাদের সব সময় আমরা কোণঠাসা করে রেখেছি। এজাতীয় পাপ, বিবেকানন্দের ভাষায়—এজাতীয় কলঙ্ক মুছে ফেলতেই হবে।’ প্রতিটি স্বাধীন দেশের নাগরিকদের সামনে এক নতুন সুযোগ হাতছানি দিচ্ছে।
আমরা গভীরভাবে লক্ষ করছি, একদিকে স্বার্থপরতা, শোষণ, অজ্ঞতা, কুসংস্কার, দাসত্ব ও তার ছায়াসঙ্গী পরশ্রীকাতরতা; অন্যদিকে সংকীর্ণ আত্মতৃপ্ত মনোভাব, সেই সঙ্গে নিশ্চল বাহ্যিক ধর্মাচরণের জাগতিকতা—এ যেন দুর্ভেদ্য দুর্গের মতো সব অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। এই অচলায়তনের ওপর আঘাত হানার এটাই প্রকৃষ্ট সময়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এই অচলায়তন ভাঙার অমিত সাহস নিয়েই এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। সমকালীন বিশ্ব পরিস্থিতিতে নরেন্দ্র মোদি এ কাজের জন্য অনুকূল পরিবেশ মনে করছেন। পুঞ্জীভূত তামসিকতা আমাদের ইতিহাসকে এমনভাবে বিধ্বস্ত করেছে যে, ১ হাজার বছরেরও বেশি সময় জাতীয় উন্নতি সম্ভব হয়নি। এই কলঙ্কিত ইতিহাস থেকে আমরা মোক্ষম শিক্ষা পেয়েছি। এটি বহুদিন পরে হলেও নরেন্দ্র মোদি বুঝতে পেরেছেন। তাই তিনি বলেছেন, ‘আজ আমাদের কাছে পৃথিবীর সব মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট পরিমাণে উৎপাদন করার সংস্থান রয়েছে। আমাদের টিকে থাকার জন্য লড়াই করার দরকার নেই। আমাদের যুগে একটি যুদ্ধের প্রয়োজন নেই। অবশ্যই কোনো যুদ্ধের প্রয়োজন নেই। আজ সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি, তা হলো জলবায়ু পরিবর্তন, সন্ত্রাসবাদ ও অতিমারি, যা একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধ করে সমাধান সম্ভব নয়। বরং একসঙ্গে সক্রিয় অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে সমাধান সম্ভব। সৌভাগ্যবশত, আজকের প্রযুক্তি বিস্তৃত আকারে মানব জাতির সমস্যাগুলো সমাধান করার পথও প্রদর্শন করছে। আমরা আজ যে বিশাল ভার্চুয়াল বিশ্বে বসবাস করি, তা ডিজিটাল প্রযুক্তির বিন্যাসকে প্রদর্শন করে। মানবতার ছয় ভাগের এক ভাগ বসতিসহ এবং ভাষাগত, ধর্মগত, প্রথা ও বিশ্বাসগতভাবে প্রচুর বৈচিত্র্যসহ ভারত হলো একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ। সমষ্টিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রাচীনতম প্রথাসহ গণতন্ত্রের ভিত্তিগত ডিএনএ প্রদানে ভারতের অবদান রয়েছে। গণতন্ত্রের জননী হিসেবে ভারতের জাতীয় সচেতনতা কঠোর নির্দেশ দ্বারা চালিত নয়, বরং একই সুরে লাখ লাখ স্বাধীন কণ্ঠের সমন্বয়ে চালিত।’ নরেন্দ্র মোদির বক্তব্য অনুযায়ী ভারতবর্ষ হয়ে উঠতে পারে নৃতত্ত্বের এক অসাধারণ গবেষণাগার। নরেন্দ্র মোদি যে উদার ও সক্রিয় মনোভাব তথা নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা তুলে ধরেছেন, তা বিশ্বের প্রতিটি নাগরিককে উজ্জীবিত করবে বলে মনে করি। নরেন্দ্র মোদির মহত্ কর্মপ্রয়াসে দুটি জিনিস মানব জাতির কাছে আশীর্বাদস্বরূপ হয়ে উঠতে পারে। এর একটি হলো আমাদের শাশ্বত বৈদান্তিক আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য এবং দ্বিতীয়টি হলো আধুনিক পাশ্চাত্য চিন্তাধারা। বেদান্ত থেকে আমরা জানতে পারি, মানুষের অন্তর্নিহিত দেবত্বের শাশ্বত সত্যের কথা পাই—সব বস্তুর মূলগত ঐক্যের জ্ঞান। আর আধুনিক চিন্তাধারা আমাদের শেখায় বৈদান্তিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বাস্তবায়ন করার বিজ্ঞানসম্মত প্রয়োগ কৌশল। মানুষের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ও উন্নতির জন্য প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে এ দুই সাংস্কৃতিক ধারার মিলন আবশ্যিক। আজকের সমস্ত প্রগতিশীল চিন্তার একটি বিষয় হচ্ছে মানুষের উন্নতি, বিকাশ ও পরিপূর্ণতা। এক পৃথিবীর নিরাময় সাধনই জি-২০-এর মূল উদ্দেশ্য। মানবকেন্দ্রিক বিশ্বায়নের একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে জি-২০কে গতিশীল করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। ভারতের জি-২০ এজেন্ডা হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, উচ্চাকাঙ্ক্ষিত, কর্মভিত্তিক সিদ্ধান্তমূলক।