বিশ্বের বিষুব অঞ্চলের কাছাকাছি কর্কটক্রান্তি এ মকরক্রান্তির মাঝামাঝি এলাকা মেগাডাইভারস হিসেবে বিবেচিত। এখানেই সবচেয়ে বেশি জীববৈচিত্র্যের সন্ধান পাওয়া যায়। আর তেমনি একটি অঞ্চলই হচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান। সেই হিসেবে এতদঞ্চলের মানুষ অনেকটাই সৌভাগ্যবান বলা যায়। তথাপি বিষয়টার মর্মোপলব্ধি করতে পারেনি মানুষ আজ অবধি। যার ফলে অহেতুক জীবের বিনাশ ঘটাচ্ছেন। কারণে-অকারণেই এই কাজটি করছেন তারা। যে পোকা বা পতঙ্গটি মারার দরকার নেই; অথচ ওকে জুতার নিচে ফেলে পিষে মারছেন। আবার পুড়িয়েও মারছেন। আগাছা দমনের অজুহাতে জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে জীববৈচিত্র্যে আঘাত হানছেন অনেকেই। এ কাজটি বেশি করা হচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। বিশেষ করে বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় আরও ব্যাপক। জুমচাষিরা পাহাড়ের গায়ে আগুন লাগিয়ে আগাছা বিনাশের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে ধ্বংস করছেন। এটি অনেক সময় কিন্তু অনিচ্ছাকৃতই করছেন তারা। অথচ ব্যক্তি কিন্তু জানেন না যে, কত বড় ধরনের জঘন্য কাজই না করছেন তিনি। সত্যি বলতে, এ ধরনের জঘন্য কর্মকাণ্ডের অভ্যাস কিন্তু এক দিনে তৈরি হয়নি মানুষের। জন্মের পর অর্থাৎ জ্ঞান হওয়া অবধি থেকে এসব দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়েছেন তারা। দেখতে বিশ্রী একটা পোকাকে মেরে ফেলতেই হবে; অমন মানসিকতা ছোটবেলা থেকেই তৈরি হয়েছে তাদের। বাবা-মা মেরেছেন তাকেও মারতে হবে, না হলে পোকাটা ক্ষতি করতে পারে। এমন ধারণা থেকেই এ মানসিকতার জন্ম হয়েছে। অকারণে বন্যপ্রাণী নিধন, পাখির মাংস খাওয়া কিংবা পোকামাকড় পিষে মারা বা পুড়িয়ে মারা—এসব আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখে অভ্যস্ত। যার ফলে কেউ-ই এখন চট করে পরিহার করতে পারছেন না। ফলে জীববৈচিত্র্য আমাদের কাছে তুচ্ছ একটি বিষয় হয়ে আছে। বিষয়টার সঙ্গে যে মানুষের বেঁচে থাকার সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত তা জানার বাইরে থাকায় এ জঘন্য ঘটনা ঘটছে।
গর্বের বিষয় হচ্ছে, দুই বাংলার সমগ্র অঞ্চলেই জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। ভৌগোলিক কারণেই হোক অথবা অন্য কোনো কারণেই হোক প্রায় একই ধরনের জীববৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। ছোট্ট দুটি অঞ্চল, অথচ কত ধরনের পোকামাকড়ের ঘরবসতি রয়েছে এতদঞ্চলে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুই বাংলার সুন্দরবন এবং বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন দ্বীপে জীববৈচিত্র্যে ঠাসা। প্রথমে আমরা সুন্দরবনের হিসাব-নিকাশে যাচ্ছি। দুই বাংলাব্যাপী সুন্দরবনের বিস্তৃতি হলেও বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ অংশের আয়তন ৩ হাজার ৯৮৩ বর্গকিলোমিটার। মোট ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের অরণ্যটি ইতিমধ্যে বিশ্বের অন্যতম ‘ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ’ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে জীববৈচিত্র্যের কারণে। অনেকের ধারণা সুন্দরবন বিশ্বের ম্যানগ্রোভ অরণ্যের মধ্যে সর্ববৃহৎ বিধায় ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজে স্থান পেয়েছে। আসলে তা সম্পূর্ণ সঠিক নয়। এখানে জীববৈচিত্র্যের বিষয়টি প্রথম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বনটি যে আকারে বৃহত, সেটিও জরিপে এসেছে। দুইয়ে মিলেই ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজে স্থান পেতে সাহায্য করেছে।
সুন্দরবন বাংলাদেশের জাতীয় বন। এটি একটি শ্বাপদসংকুল অরণ্য। এ অরণ্য যুগ যুগ ধরে মানুষের কাছে এক রোমাঞ্চকর জঙ্গল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আর রোমাঞ্চকর বলেই হয়তো এ জঙ্গলের গুরুত্ব অপরিসীম পর্যটকদের কাছে। যার প্রধান কারণই হচ্ছে জীববৈচিত্র্য!
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এ সুন্দরবনেই পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের শতকরা ৪০ ভাগের সন্ধান পাওয়া গেছে। বিস্ময়কর তথ্যই বটে! তন্মধ্যে রয়েছে ২৭০ প্রজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, আট প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৫০ প্রজাতির মাছ ছাড়াও রয়েছে হাঙর, কুমির, ডলফিন ও বিশ্বখ্যাত রয়েলে বেঙ্গল টাইগার। আর বিভিন্ন ধরনের দুষ্প্রাপ্য উদ্ভিদের কথা আমরা বাদই দিলাম। সূত্র মতে জানা যায়, সুন্দরবনে মোট ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। তন্মধ্যে ৮৭টি একবীজপত্রী, ২৩০টি দ্বিবীজপত্রী, ১৭টি ফার্ন জাতীয়, ১৩ প্রজাতির অর্কিড ও ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল। যার প্রতিটি উদ্ভিদই জীববৈচিত্র্যের রক্ষণাবেক্ষণের ভূমিকা রাখছে। তত্সঙ্গে টিকিয়ে রাখছে সুন্দরবনকে হাজার বছর ধরে।
সুন্দরবনের পরেই রয়েছে বাংলাদেশের সেন্টমার্টিনের দ্বীপের অবস্থান। জীববৈচিত্র্যে ঠাসা সেন্টমার্টিন দ্বীপেও। মাত্র আট বর্গকিলোমিটার পরিধির একটা দ্বীপ। অথচ দ্বীপটি যেন জীববৈচিত্র্যের স্বর্গরাজ্য। এক সমীক্ষায় জানা যায়, এই দ্বীপে ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৫০ প্রজাতির মাছ, ৫ প্রজাতির দুর্লভ কাছিম, ১৫ প্রজাতির সাপ, ৩০০ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ২০০ প্রজাতির পাখি (দেশি ও পরিযায়ী মিলিয়ে), ৫ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৫ প্রজাতির টিকটিকি-গিরগিটি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। রয়েছে পাথুরে শিলা ও হরেক রকম শৈবালের রাজ্য। এছাড়াও অসংখ্য নারিকেলগাছ এবং কেয়াবনসহ নানান ধরনের উদ্ভিদ রয়েছে। যার কারণেই সেন্টমার্টিন দ্বীপকে বলা হয়েছে বিশ্বের দুর্লভতম স্থানের একটি।
বিশেষ করে স্বল্প আয়তনের আর কোনো স্থানে এমন নৈসর্গিক দৃশ্য ও বহুল প্রজাতির উদ্ভিদ এবং জীববৈচিত্র্যের সন্ধান পাওয়া যায় না। এখানে আরেকটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়; তা হচ্ছে, বিশ্বের অতি দুর্লভতম একটি কাছিমের নাম ‘অলিভ টার্টল’। যেটা সেন্টমার্টিনে দেখা যায়। সেন্টমার্টিনে এসে ওরা ডিম পাড়ে। যদিও ডিম পাড়তে এসে নানান বাধার সম্মুখীন হতে হয় ওদেরকে এবং ডিম পাড়তে না পেরে পরবর্তী সময়ে দ্বীপ ত্যাগ করে। এক পর্যায়ে পেটে ডিম পেটে অলিভ টার্টলের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে। সে এক দুঃখজনক ঘটনা। তথাপিও সব মিলিয়ে বলতে হয় আমরা গর্বিত আধিক্য জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে বসবাস করতে পেরে। যদিও এর সারমর্ম বুঝতে সক্ষম নন অনেকেই। বেশির ভাগ মানুষেরই ধারণা কীটপতঙ্গ দেখলেই পিষে ফেলা উচিত। আসলে যে পোকাটি মানবজাতিকে বেঁচে থাকতে বিভিন্নভাবে সাহায্য করছে, তা কিন্তু কেউই টের পাচ্ছে না। মানুষের বেঁচে থাকার সম্পর্ক অর্থাৎ জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে ধারণা দিতে প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমেই। কেবল বিশেষ দিবসে এর গুরুত্ব তুলে ধরলে চলবে না, সব সময়ই কমবেশি জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে মানুষকে ধারণা দিতে হবে, তা হলেই রক্ষা পাবে আমাদের জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ বিশাল ভান্ডারটি।