
জুলাই অভ্যুত্থান গণমানুষের যে আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে সংঘটিত হয়েছিল সেই আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন থেকে ক্রমশই দূরে সড়ে যাচ্ছি। কথা ছিল জীবন ও জীবীকার নিশ্চয়তা মিলবে, জীবনের নিরাপত্তা মিলবে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত হবে, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাসের মধ্য দিয়ে সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে। বাজার সিন্ডিকেটদের দৌরাত্ব ঘুচবে, ভেজালের সমারোহ কমবে, সরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবা সহজলভ্য হবে, চিকিৎসার নিশ্চয়তা মিলবে। কিন্তু না ফ্যাসিজমের সকল কিছুই আছে বহালতবিয়তে আগের মতোই।
কথা ছিল নিরপেক্ষভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করা। তারা কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব না করে, সবার জন্য সমান সুযোগ ও সুবিচার নিশ্চিত করবে। দেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখবে। তারা যেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সকল ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ এবং প্রয়োগ নিশ্চিত করবেন। বাক স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার প্রশ্নে রাষ্ট্র সর্বোচ্চ ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবেন। কিন্ত উল্টো অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ঐতিহ্য, বাক স্বাধীনতা। অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে মব জাস্টিসের ঘটনা। প্রতিকার মিলছে না বরং বাড়ছে প্রতিহিংসা। অন্ধকার যেন ক্রমেই ঘনিয়ে আসছে। দিন দিন আমরা হিংসাত্মক এবং ধ্বংসাত্মক হয়ে ইঠছি। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে দেখেছি ক্ষমতা পরিবর্তনের পরবর্তী সময়ে খুন, গুম, দখলবাণিজ্য এবং ধর্ষণের পরিমাণ মাত্রারিক্তভাবে বয়ে চলছে। যা থেকে বাদ যায়নি ২৪এর গণঅভ্যূত্থানও। এই সময়গুলোতে ধর্মীয় সংখ্যলঘু পরিবারগুলোতে নির্যাতন, জ্বালাও-পেড়াও, ধর্ষণের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। যা কোন বিবেকবান মানুষের কাছেই কাম্য নয়।
মানুষ স্বৈরাচারি, ফ্যাসিবাদী শাসন-শোষেণের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, জীবন দিয়েছে গণতান্ত্রিক শাসনের জন্য। কিন্তু অন্তবর্তী সরকারের কার্যক্রম মানুষকে হতাশ করেছে। গণ অভ্যুত্থানের আকাঙক্ষার বিপরীতে সরকারের ভূমিকার জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। ধর্মীয় উগ্রতা, নারী হেনস্তা, শিশু ধর্ষণ, হত্যা, গুম-খুন, বলাৎকার বেড়েই চলছে। বিচরহীনতা সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। জনগণ দেখছে প্রতিশ্রুতির অপলাপ, গণতন্ত্রের নামে অগণতান্ত্রিক দমননীতি। গণতন্ত্রের নামে চলছে একতরফা শাসন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। শোষিত জনগণ দিশেহারা। সংকট যত গভীর হচ্ছে, ততই প্রশ্ন উঠছে— এই শাসনব্যবস্থা কার জন্য? কাদের স্বার্থ রক্ষা করছে? চলমান সংকট এবং অস্থিশীল অবস্থার একটা স্থায়ী এবং অধিক যুক্তিসংঘত সমাধান জরুরী। চলমান যে সংকট তা আর সামনে না আগানোটাই হবে রাষ্ট্রের জন্য সবোর্চ্চ উত্তম। নেতৃত্ব যদি ভুল করে তবে তার খেসারত দিতে হয় সাধারণ জনগণকে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ এবং উন্নত রাষ্ট্র গঠন করাই হোক আমাদের প্রধান লক্ষ্য। সংস্কার হওয়া দরকার গণমানুষের জন্য। রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও উন্নতির জন্য। যেখানে প্রতিটি নাগরিক নিরাপদ, সম্মানিত এবং সমৃদ্ধ জীবনের অধিকারী হবে।
সমাজ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড.নেহাল করিম বলেন, “বাংলাদেশে শতকরা ৯৯ ভাগ লোকের সামাজিকীকরণ ঠিকমতো হয়নি ৷ ফলে সব পেশাতেই অসামঞ্জস্য আছে, বৈষম্য আছে ৷ এখনই প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও কার্যকর নীতিমালা গ্রহণ। ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রশাসনকে হতে হবে স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক এবং জনবান্ধব। বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করে সুশাসনের ভিত মজবুত করতে হবে। একটি সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ এবং ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা জরুরি। গঠনমূলক সমালোচনা, মতপার্থক্য এবং গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ সৃষ্টি না হলে দমন-পীড়ন আরও বাড়বে, যা সংকটকে আরও জটিল করে তুলবে। এখন সময় এসেছে জাতিকে বিভক্ত না করে ঐক্যের ভিত্তিতে অগ্রসর হওয়ার। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে হলে প্রয়োজন কার্যকর সংস্কার, ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা এবং নীতিনির্ধারকদের নিরপেক্ষ ও দায়িত্বশীল ভূমিকা।
শিক্ষা, সংস্কৃতি ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে একটি আধুনিক জাতি গঠনের পথেই আমাদের অগ্রসর হতে হবে। শিক্ষা, নৈতিকতা ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী সমাজ গড়ে তুলতে হবে, যেখানে প্রতিটি নাগরিক সমান সুযোগ ও অধিকার ভোগ করবে। নেতৃত্বের উচিত জনগণের কথা শোনা, তাদের চাহিদা ও স্বপ্নকে গুরুত্ব দেওয়া এবং সেবার মনোভাব নিয়ে কাজ করা।” আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন এক নিরাপদ, মানবিক ও সমৃদ্ধ দেশ পায়, সে লক্ষ্যে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। নেতৃত্বকে বুঝতে হবে, জনগণের আকাঙ্ক্ষাই শেষ কথা—সেই আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান জানানোই হবে প্রকৃত রাষ্ট্রনায়কের দায়িত্ব। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সুযোগ সম্প্রসারিত করে একটি স্বনির্ভর জাতি গড়ে তুলতে হবে। নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা ও দেশপ্রেম জাগ্রত করতে হবে, যাতে তারা নিজেদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়। সমাজে ন্যায়বিচার, সুশাসন ও সাম্যের ভিত্তি শক্তিশালী করলেই আমরা সত্যিকারের উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে পারব। জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য নেতৃত্বের উচিত সততা, জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতার নীতি অনুসরণ করা। শুধু উন্নয়নই নয়, তা যেন টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়, সে বিষয়েও সচেতন থাকতে হবে। নতুন প্রজন্মকে দক্ষ, সৃজনশীল ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে বিনিয়োগ করতে হবে। শুধু ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ নয়, জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। তবেই আমরা একটি শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ ও মর্যাদাপূর্ণ দেশ গড়ে তুলতে পারব। নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও মানবিক গুণাবলির চর্চার মাধ্যমে সমাজে সাম্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারবো।