বাঙালির দুর্ভাগ্য, গৃহশত্রু আর বহিঃশত্রুর একাধিক হামলার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাদের। সৌভাগ্য তবু, তারা মাথা নোয়াননি কখনো। পরাজয় থেকে বেরিয়ে, আত্মগ্লানি আর চাপিয়ে দেওয়া গ্লানি ভেদ করে জাতির চিন্তায় জয়সূচক চিহ্ন এঁকেছে। এর পরেও দানবীয় আক্রোশ থেকে রেহাই নেই, পরাজয়ের বৃত্তে সে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায় বিজয়ী পরমব্রতকে। এরকম সন্ধিক্ষণে জাতির সক্রিয় আর সরব হয়ে ওঠা আবশ্যক। জরুরি সতর্ক আর অবিলম্ব প্রস্তুতি। গদ্যে। কবিতায়। নিবন্ধে। সর্বত্র। রাতদিন। বারো মাস
বাঙালির সত্তা স্থাপনের ইতিহাসে, রক্তাক্ত সংগ্রামে, মহান একুশ আর অমর উনিশের তুলনা নেই। দুই অপরাজেয় ঘটনা তার অস্তিত্ব আর সত্তার রাজনৈতিক সংজ্ঞাকে যেভাবে উঁচু করেছে, তা অদ্বিতীয়, বিরলতম দৃষ্টান্ত। একুশের বাধ্যতামূলক, স্বতঃস্ফূর্ত আত্মত্যাগ তার জাতি গঠন প্রক্রিয়ার সাময়িক বিরতি আর বিভ্রান্তিকে চূর্ণবিচূর্ণ করতে শিখিয়েছে এবং বলিয়েছে তাকে, দেশভাগের মতো মর্মান্তিক ও আত্মঘাতী বিড়ম্বনা অতিক্রম করে ভাষা, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের প্রবাহকে বাঁচিয়ে রাখতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। ধর্ম নয়, মাতৃভাষাই আমাদের সমগোত্রীয়তাবোধের সবচেয়ে মহৎ অবলম্বন।
এখানে রাষ্ট্রের কৌশল, অপকৌশল বাঙালির প্রতি স্পর্ধার সামনে তুচ্ছ। শুকনো তৃণখণ্ডের মতো নগণ্য। এই নগণ্যতাবোধ বাঙালির জাতিসত্তাকে বিজয়ী করেছে; দেশ গঠনের, দেশপ্রেমের সরব স্থপতির আসনে বসিয়েছে। বাংলা যে বিশ্বের অন্যতম সেরা আর গঠনশীল ভাষা (সব অর্থে), যা তার বাহুকে, অনড় কবজিকে ছুঁয়ে আছে, সত্তায় জাগিয়ে রাখে বহুমুখী নির্মাণ আর ইহজাগতিকতার সুন্দরকে—আজ এসব স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে রাজনীতিদুষ্ট, আত্মসন্তুষ্ট পশ্চিমা অহমিকা। দ্বিতীয়ত, বাংলার জয় কেবল বাঙালির নয়, সব মাতৃভাষার, সব মাতৃপ্রেমিকের জয়। পরাজয়ও তেমনি নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র আর পাশ্চাত্যের একদর্শী গৌরবের। একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ বরাকের উনিশে মের আয়তনিক সংযোগ আপতদৃষ্টিতে সীমাবদ্ধ হলেও অনিঃশেষ তার গুরুত্ব। অসমে একই দিনে ১১ প্রেমিকের বিসর্জন এবং পরের আরো দুই ঘটনায় তিন বীরের আত্মাহুতি প্রমাণ করেছে, বাঙালির ভাবাবেগ তাত্ক্ষণিকতার ঊর্ধ্বে, অনেক ঊর্ধ্বে।
যখন ধেয়ে আসে কোনো সংকট, যখন কবন্ধেরা নাচতে শুরু করে, যখন রাষ্ট্র একভাষিকতার রাজনীতি-অনীতি চাপিয়ে দিতে চায়, তখনই গর্জে ওঠে গণকন্ঠ। বরাকে, অসমের অন্যত্র, ক্ষমতার ভাষাকে এখনো ব্যবহার করছে নির্বোধের দুর্বুদ্ধি। সামাজিক বিস্ফোরণ অসম্ভব নয়। কেননা, আকাশ ধোঁয়াটে, হাওয়া বড় অস্থির। এর বাইরেও কিছু কথা আছে, যা বলা দরকার। না বলাটা অন্যায়। জাতির ভৌগোলিক অখণ্ডে, তার সংস্কৃতিতে, তার মাতৃভাষার অন্তরে ও বাইরে নিঃশব্দে অপ্রত্যাশিত বিভ্রান্তি আর সংশয় প্রশ্রয় পেয়ে যাচ্ছে। একে নির্মূল করা দরকার। প্রয়োজন আরো একটি সর্বাত্মক ভাষা আন্দোলন। এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে হবে প্রথমত ভাষাবিজ্ঞানী, দ্বিতীয়ত লেখক ও কবি, তৃতীয়ত শিক্ষাবিদদের। চতুর্থত, রাজনীতি নির্বিশেষে ছাত্র আর যুবকদের। এদের সবাইকে একই মঞ্চে, একই ময়দানে জড়ো করতে হবে।
বাংলা ভাষা যে আক্রান্ত, অবরুদ্ধ তা উচ্চকণ্ঠে বলা দরকার। প্রতিদিন সমাজমাধ্যমে, সংবাদপত্রে, আমাদের সৃজনশীল লেখালেখিতে বাংলার ওপর অকথ্য অনাচার চলছে। অসতর্কতাবশত আমরাই করছি। ভুল শব্দ ব্যবহার, বিরতি চিহ্নের অপব্যবহার, ব্যাকরণের অনুশাসন ভাঙতে গিয়ে স্বেচ্ছাচারিতাকে আমল দিচ্ছি, এসবের উচ্ছেদ জরুরি। না হলে, অনাহূত বিবর্তনের স্রোত সর্বনাশ ডেকে আনবে। দ্বিতীয়ত, আমাদের লাগামছাড়া আবেগ ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি লক্ষ্যকে, সব ত্যাগীকে অবমাননার সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দেবে। যারা লেখক নন, কবি নন, ভাষাবিজ্ঞানী নন, ভাষার বিবর্তনমূলক ইতিহাস রচনার করিগর, তাদের সম্মানজনক শর্তে স্বস্থানে ফেরত পাঠাতে হবে। দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে হবে, সবাই কবি নন, কেউ কেউ কবি। বলতে হবে, আমাদের মাতৃভাষা বহু চড়াই-উতরাই পথ বেয়ে বিশ্বসভায় পৌঁছেছে। তার আত্মা আর দেহে বিভ্রান্তি আর সংশয় তৈরি করা পাপ। এই পাপকে কি নিঃশব্দে বরদাস্ত করব আমরা?
আপমান করব চার চারটি ভাষা আন্দোলনের শহিদদের?
কবি আব্দুল হাকিমের (১৬২০-১৬৭০) কাল থেকে এ পর্যন্ত মাতৃভাষার জন্য যাদের অযুত রক্তক্ষরণ হয়েছে, যারা স্বজাতির ভাষাদ্রোহিতাকেও কখনো মেনে নেননি, নিরন্তর লড়াই করছেন, কখনো রাষ্ট্রের একভাষিক আইনকানুনের বিরুদ্ধে, কখনো সংস্কৃত, উর্দু, আরবি ও ফারসির আনুশাসনিক ক্ষমতাকে রুখতে জড়ো হয়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন, এখনো যাদের উত্তরসূরিরা একভাষিক আধিপত্যবাদ আর অঘোষিত ঔপনিবেশিকতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নিরবচ্ছিন্ন লড়াইয়ে ব্যস্ত—তাদের আত্মত্যাগ, তাদের ভাবনাচিন্তাকে হেয় করব? অসম্ভব। এ জন্য নিজের হাতে নিজ ভাষার অপপ্রয়োগ এবং আরোপিত নৈরাশ্যকে চূর্ণ করতেই আমাদের আরো একটি সর্বব্যাপী লড়াই দরকার। তা বাংলাদেশে, পশ্চিমবঙ্গে, ত্রিপুরায়, আসামে, অন্যত্রও ছড়িয়ে দেওয়া জরুরি। আমাদের এই প্রস্তাব, আশা করি অযৌক্তিক নয়। বিবেক, যুক্তি আর ভাবাবেগ সমবেত করে একই সঙ্গে বাংলার গৃহশত্রু আর বহিঃশত্রুদের মোকাবিলা করতে হবে। প্রশ্ন উঠবে, কারা এই গৃহশত্রু?
তাদের অস্ত্র কী? বহিঃশত্রু বলতে কার দিকে, কাদের দিকে আঙুল উঁচু করতে হচ্ছে?
আগেই বলেছি খানিকটা, এবার বিশদভাবে বলা প্রয়োজন, যারা বাংলার কথা বলেন, লেখালেখি করেন, বাংলা ভাষার কৌলীন্যের ওপর, বেখেয়ালে অনবরত হামলা করছেন। যেমন—বানান ও বাক্য গঠনে অস্বচ্ছতা আর অশ্রদ্ধা প্রয়োগ নিয়ে যাদের দুশ্চিন্তা নেই—তারাই গৃহশত্রু।
তথ্যপ্রযুক্তির মন্দ যাদের ব্যবহার করছে, যারা তাদের ব্যাবহারিকতায় লাগামহীন নৈরাজ্য ছড়িয়ে অকারণে উসকানি দিচ্ছেন রাষ্ট্রীয়, অন্তঃরাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে; তারাই বাংলা ভাষার বহিঃশত্রু।
বহিঃশত্রুদের ছবি আর লক্ষ্য পরিষ্কার, তাদের খুঁজে বের করতে বিশেষ মেহনত করতে হয় না। দাম্ভিক আচরণ দেখিয়ে, রাষ্ট্রিক কৌশল ঘোষণা করে তারা জানিয়ে দেয়—বহুভাষিকতা নয়,
একভাষিকতার প্রতিষ্ঠা জরুরি। এতে দেশপ্রেম থাক বা না থাক, এই ভাবনা নেই। ক্ষমতা আর ক্ষমতালোভী দৈত্যের ইচ্ছাপূরণই যথেষ্ট। তারা তথ্যপ্রযুক্তির সৃষ্টিশীলতাকে নয়, যান্ত্রিক ব্যবহারকেই গুরুত্ব দেয়।
রাজা চায় না প্রজা শিক্ষিত হোক। সৃজনের বিশুদ্ধ পথ বেছে নিক। প্রজার প্রশিক্ষণ আর সুশিক্ষা মানেই তাদের মুক্তচিন্তার, অবাধ নদীমাতৃকতার, নদীর উন্মুক্ত অববাহিকার নবীন বিন্যাস।
এরকম বিন্যাসকে কোথাও কোনোকালে রাষ্ট্র সহ্য করেনি। কখনো বিষাক্ত, নির্মোক-কৌশলে, কখনো তার যন্ত্রের দাপাদাপিতে ঝড় তুলে, রক্তখেকোর চেহারা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে লোকভাষা, নগরভাষা ও প্রবহমান সংস্কৃতির বিশুদ্ধ দেহে।
বাঙালির দুর্ভাগ্য, গৃহশত্রু আর বহিঃশত্রুর একাধিক হামলার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাদের। সৌভাগ্য তবু, তারা মাথা নোয়াননি কখনো। পরাজয় থেকে বেরিয়ে, আত্মগ্লানি আর চাপিয়ে দেওয়া গ্লানি ভেদ করে জাতির চিন্তায় জয়সূচক চিহ্ন এঁকেছে। এর পরেও দানবীয় আক্রোশ থেকে রেহাই নেই, পরাজয়ের বৃত্তে সে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায় বিজয়ী পরমব্রতকে। এরকম সন্ধিক্ষণে জাতির সক্রিয় আর সরব হয়ে ওঠা আবশ্যক। জরুরি সতর্ক আর অবিলম্ব প্রস্তুতি। গদ্যে। কবিতায়। নিবন্ধে। সর্বত্র। রাতদিন। বারো মাস।
সম্প্রতি আমাদের একটি ভুল ভাঙল। নানা রকম মাধ্যমে, লেখালেখির দূষিত ছায়া-প্রতিচ্ছায়া দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, সাহিত্যকে বিভ্রান্তির পথে ঠেলে দিচ্ছে আমাদের উদাসীনতা, আমাদের অসতর্কতা আর আত্মতৃপ্তি। কিন্তু দেখা গেল, প্রবল প্রতিক্রিয়ার নৈতিক চাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে সামাজিক অভিমুখ।
দুর্দিনে এ এক বিরাট সুসংবাদ। অবশ্যই আপসহীন দ্রোহের শুভলক্ষণ। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে নয়, ভাষা আর সংস্কৃতির সংকট রুখতে জাতির প্রবীণ তারুণ্য আর নবীন দৃঢ়তা যে জেদ ঘোষণা করছে তাদের নির্মাণে, সৃজনে—তার আরেক নাম সংকল্প। এই লড়াই আর সংকল্পের ভিত্তি কী? অবশ্যই একুশ আর উনিশের চেতনার বিস্তার, যা বাংলা ভাষার গৃহশত্রু আর বহিঃশত্রুদের মোকাবিলায় আপাতত নিঃশব্দ হলেও অতন্দ্র প্রহরীর মতো সতর্ক। সজাগ। বাড়াবাড়ি ঘটলেই কণ্ঠে ঝড় তুলে দর্পহারী প্রেমের সন্তানসন্ততিরা বলবে, বলতেই পারে—একটু পা চালিয়ে ভাই। ভাবাবেগ এই মুহূর্তে অসংগঠিত। কোথাও কোথাও স্তম্ভিত। এ কারণেই, এক ভাষিক ষড়যন্ত্র, স্বেচ্ছাচার আর নগ্ন কোলাকুলির বিরুদ্ধে সংহত নেতৃত্ব: দরকার। দরকার শুদ্ধ আর অশুদ্ধের যোগ-বিয়োগ।