রাজধানীর কদমতলী এলাকার বাসিন্দা নাসিমা আক্তার। একটি কাগজের কার্টন প্রস্তুতকারক কারখানায় কাজ করে মাসে বেতন পান মাত্র ৮ হাজার টাকা। সন্ধ্যার পর বাসাবাড়িতে কাজ করে আয় হয় আরও তিন হাজার টাকা। এই ১১ হাজার টাকাতেই চলে নাসিমার পাঁচ সদস্যের সংসার। এদিকে বাজারে লাগাতার বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে অনেক বেড়ে যাওয়ায় জিনিসপত্রের দামেও প্রভাব পড়েছে। প্রায় প্রতিটি পণ্যের দামও বেড়েছে অসহনীয় মাত্রায়। অথচ দুবছর হলো আয় বাড়েনি নাসিমার। সংসারের তিন বেলা খাবারের সংস্থান করতে খেই হারিয়ে ফেলেছেন মধ্য বয়স্ক এ নারী। বাজারে গিয়ে এক রকম খালি হাতেই ফিরতে হচ্ছে তাকে।
সাদ্দাম মার্কেট বাজারে গতকাল নাসিমা আক্তার আক্ষেপ করে বলেন, ‘তেল, চালের দাম অনেক আগেই সাধ্যের বাইরে চইলা গেছে। আইজকা আইসা শুনি মসুর ডাউলের দাম কেজিতে ১০ টাকা বাড়ছে। ডিম কিনতে গেলাম, ডজনে ২০ টাকা বাড়ছে। বাড়িতে মেহমান। ফার্মের মুরগির দাম করলাম। তাও ১৮৫ টাকায় উঠছে। একটাও কেনা হইল না। তরিতরকারি কিনুম যে তারও উপায় নাই। যেইটায় হাত দেই ৫০ টাকা-৬০ টাকা। এক পোয়া (২৫০ গ্রাম) কাঁচামরিচের দামও চাইতাছে ৬০ টাকা। ১০ টাকায় কয়েকটা মরিচ পাইলাম, তাই নিলাম। শেষে দুইটা তেলাপিয়া মাছ আর দুই পিস কাঁচা কলা কিনে বাড়ির পথ ধরলেন তিনি। যেতে যেতে লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘কিছুই কেনা হইল না আইজ। এইভাবে দাম বাড়লে না খেয়েই মরতে হবে।’
নাসিমার মতো নিম্ন ও খেটে খাওয়া মনুষদের অনেকেরই বাড়ি ফিরতে হচ্ছে বাজারের খালি ব্যাগ নিয়েই। দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে টিকে থাকার লড়াই করছেন মধ্যবিত্তরা।
মালিবাগ বাজারে এসে মুরগির দাম শুনে হতবাক বেসরকারি চাকরিজীবী সাকিব মোল্লা। কথা হলে বলেন, ফার্মের মুরগির কেজি ১৮৫ টাকা, ডিমের ডজন ১৪০ টাকা- কী হচ্ছে এসব। মুরগি আর ডিম দেখি সমানে সমান। বাজারের যে হাল তাতে মাছ-মাংস খাওয়া এক রকম ছেড়েই দিয়েছি। ব্রয়লার মুরগি আর ডিম কিনে খেতাম। সেটাও এখন নাগালের বাইরে চলে গেছে। জ্বালানি তেলের সঙ্গে আমাদের কষ্টও বাড়ল। তিন-চারটা পণ্য কিনতেই হাজার টাকা ফুরিয়ে যাচ্ছে। বাজারের ব্যাগ খালিই থাকছে। মুখ ফুটে প্রকাশ করতেও পারি না এ কষ্টের কথা।
মালিবাগ বাজারের মুরগি বিক্রেতা মো. ফারুক জানান, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার ফলে পরিবহন ব্যয় বেড়েছে। তা ছাড়া মুরগির ফিডসহ (খাবার) সবকিছুর দামই বাড়তি। তাই পাইকারিতেই এ ধাক্কায় ২৫ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। এর প্রভাব খুচরায় পড়েছে। গত সপ্তাহের শুরুতে ১৫৫ টাকা কেজি বিক্রি করতে পারলে এ সপ্তাহে ব্রয়লারের কেজি ১৮০ টাকার নিচে বিক্রি করা যাচ্ছে না।
একই কথা জানালেন এ বাজারের ডিম ব্যবসায়ী মো. রুহুল আমিনও। জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সব খাতে প্রভাব পড়ছে। বাজারে জিনিসপত্রের দামও বাড়ছে। বাদ পড়েনি ডিমও। আড়তে ডিমের শ (১০০ পিস) কেনাই পড়ছে এক হাজার ১৫০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি পিস ডিমের কেনা দামই সাড়ে ১১ টাকা। এ ডিমের ডজন বিক্রি করছি ১৪০ টাকা। একটু বড় আকারের ডিমের ডজন ১৫০ টাকা।
করোনার পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক পণ্য বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এর আঁচ লেগেছে দেশের বাজারেও। যার ফলে জিনিসপত্রের দাম বাড়তি। এর মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম এক ধাক্কায় এত হারে বাড়ানোর ফলে নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষ আরও অসহনীয় চাপের মুখে পড়েছেন বলে জানান ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। এমনটা চললে স্বল্প আয়ের মানুষের পক্ষে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করেন তিনি।
গোলাম রহমান বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলে তা সরাসরি ভোক্তার ঘাড়ে এসেই পড়ে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই তা কৃষি ও শিল্প খাতে উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেয় এবং পরিবহন খাতেও খরচ বাড়ে। কিন্তু এ খরচের ভার অন্যরা নিতে চান না। ঘুরেফিরে সম্পূর্ণ ভার ভোক্তার ঘাড়েই এসে পড়ে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। তবে যতটা বাড়ার কথা তার থেকেও বেশি বাড়ে। মানুষের বর্তমান আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় জ্বালানির দাম এত হারে বাড়ানো উচিত হয়নি।
জ্বালানির বাড়তি দাম মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিচ্ছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যেই এর আঁচ পাওয়া যাচ্ছে। বাজারে ডিম, সবজি থেকে শুরু করে একে একে সবকিছুর দাম বাড়ছে। এমনটা চলতে থাকলে আমি মনে করি আগামী অক্টোবর নাগাদ দেশে মূল্যস্ফীতি ডাবল ডিজিট ছুঁয়ে ফেলতে পারে। সেটা হলে দেশের অর্থনীতিসহ বাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা দেখা দেবে। মানুষের জীবনমান নিচে নেমে যাবে।
এদিকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, নিম্ন ও খেটে খাওয়া মানুষ ইতোমধ্যে ডাবল ডিজিট মূল্যস্ফীতির সমান চাপ অনুভব করছেন। গড় হিসাব নয়, বরং তারা নিয়মিত যেসব প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করেন সেগুলোর দাম অনেক হারে বেড়ে যাওয়ায় তাদের ওপর চাপটা অনেক বেশি। এ অবস্থায় তাদের পক্ষে জীবনধারণ অনেক কষ্টকর হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় অর্থনীতিতে এর গুণিতক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এর ফলে উৎপাদন থেকে শুরু করে বিতরণ, বিপণন- সব ক্ষেত্রেই খরচ বাড়ছে। এ খরচ বাড়ার ক্ষেত্রে অঙ্ক কশে বাড়ে না। সমানুপাতিকভাবে বাড়ে না। উল্টো অনেকে এমন পরিস্থিতির সুযোগ নেয়। যার ফলে খরচ অনেক হারে বেড়ে যায়। আমি বলব এমন পরিস্থিতিতে জ্বালানির দাম এত হারে বাড়ানো সঠিক সিদ্ধান্ত হয়নি। এ ক্ষেত্রে আরও সময় নেওয়া যেত।
গত শুক্রবার রাতে সরকারের পক্ষ থেকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসে। ওই দিন রাত ১২টা থেকেই সরকারের এ সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর করা হয়। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতি লিটার ডিজেলে ৩৪ টাকা, অকটেনে ৪৬ টাকা ও পেট্রলে ৪৪ টাকা দাম বেড়েছে। ডিজেল কিনতে লিটারপ্রতি এখন খরচ পড়ছে ১১৪ টাকা। মূলত ডিজেলের দামের প্রভাব পড়েছে কৃষি, শিল্প খাতসহ পণ্য পরিবহন খাতে। এতে উৎপাদন ও পরিবহন ব্যয় বেড়েছে। আর এতেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।
কদমতলী সাদ্দাম মার্কেট ও মালিকবাগ বাজারসহ রাজধানীর বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সপ্তাহের ব্যবধানে চাল থেকে শুরু করে ডাল, আদা, রসুন, পেঁয়াজ, আটা, ডিম, মুরগি, গুঁড়াদুধসহ প্রায় প্রতিটি প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য পর্যালচনা করে দেখা গেছে সপ্তাহের ব্যবধানে প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যগুলোর দাম বেড়েছে।
খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিগত কয়েক দিনের ব্যবধানে সরু চালের দাম কেজিপ্রতি ২ থেকে ৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। তবে মাঝারি ও মোটা চালের দাম অনেকটা অপরিবর্তীত রয়েছে। দুই কেজি আটার প্যাকেটে ৪ টাকা দাম বেড়ে ১১২ টাকা হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত যা ১০৮ টাকা ছিল। গুঁড়াদুধের কেজিতেও ৫০ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। অপরদিকে সয়াবিন তেলের দামও বাড়াতে ট্যারিফ কমিশনের কাছে প্রস্তাব করেছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। যা ভোক্তার দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে।
ছোট দানার মসুর ডালের কেজি এখন ১৪০ টাকা এবং মোটা দানা ১১০ টাকা। আমদানিকৃত রসুনের কেজি এখন ১৩০ টাকা, গত সপ্তাহে যা বিক্রি হয় ১১০ টাকা। দাম বেড়ে আদা বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকা। খোলা চিনিতেও কেজিপ্রতি ৫ টাকা দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৮৫ টাকায়। দাম বেড়েছে পেঁয়াজেরও। গত সপ্তাহে ৪২ টাকায় বিক্রি হওয়া দেশি পেঁয়াজ এখন ৫০ টাকায় ঠেকেছে।
শ্যামবাজারের মিতালী আড়তের পাইকারি ব্যবসায়ী কানাই সাহা জানান, পাবনা থেকে ঢাকায় পণ্য আনতে বস্তাপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। আগে যেখানে ৭০ কেজির বস্তায় ৮০ থেকে ৯০ টাকা ট্রাক ভাড়া লাগত। ডিজেলের দাম বাড়ায় এখন সেখানে ১২০ টাকা লাগছে। এতে পাইকারিতে কেজিপ্রতি পেঁয়াজে ১ থেকে ২ টাকা দাম বেড়েছে। একইভাবে অন্য মসলারও দাম বাড়ছে। যার প্রভাব খুচরায় পড়বে।
সবজির বাজারেও দাম কেবল বাড়ছে। কাঁচামরিচের ঝাল একটু কমলেও বিক্রি হচ্ছে ২৪০ থেকে ২৮০ টাকা কেজি দরে। অন্যদিকে তরিতরকারির দাম কেজিপ্রতি ৫ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। কারওয়ানবাজারের পাইকারি প্রতিষ্ঠান রিয়াদ এন্টারপ্রাইজের ব্যবসায়ী বলরাম চন্দ্র জানান, পাবনা থেকে সবজি আনতে ট্রাকপ্রতি সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার টাকা ভাড়া বেড়েছে। ট্রাক সংকটের ফলে রিজার্ভ ট্রাকে সবজি আনতে হচ্ছে এতে আরও খরচ বাড়ছে। বাড়তি খরচ সবজির দামে যুক্ত হচ্ছে।
এদিকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে ব্যাখ্যায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে সমন্বয়, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) লোকসান কমানোসহ পাচার হওয়ার আশঙ্কা থেকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার।
এ বিষয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিপিসির লোকসান কমাতে গিয়ে যদি জ্বালানির দাম ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বাড়ানো হয়, তা হলে তা সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। সে ক্ষেত্রে সরকারের অন্যদিক থেকে আরও বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। তাই জ্বালানির মতো কৌশলী পণ্যের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে লাভ-ক্ষতির হিসাব না করে সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর কি অভিঘাত ফেলবে তা বিবেচনা করা দরকার।