গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণে বস্ত্র খাত মুখ থুবড়ে পড়েছে। গত মার্চে গ্যাসের সংকট শুরু হয়। জুলাইয়ে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়। আর আগস্ট থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা, রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার, নরসিংদীর মাধবদী, ঢাকার পার্শ্ববর্তী সাভার-আশুলিয়া, গাজীপুরের শ্রীপুর, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের বস্ত্রকলগুলো গ্যাস-সংকটের কারণে দিনে গড়ে ১২ ঘণ্টা বন্ধ থাকছে। এতে করে কারখানাগুলো উত্পাদনক্ষমতার মাত্র ৩০-৪০ শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে। গতকাল শনিবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী।
বিটিএমএ সভাপতি বলেন, প্রতি কেজি সুতা উৎপাদনে ১ ডলার ২৫ সেন্ট খরচ হলেও দিনের অর্ধেক সময় কারখানা বন্ধ থাকার কারণে তা বেড়ে আড়াই ডলারে গিয়ে পৌঁছেছে। কাপড় রং করার ডাইং কারখানাগুলোও লোডশেডিংয়ের কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তিনি বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের কারণে ৬০ শতাংশ বস্ত্রকল ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দ্রুত সংকট সমাধান করে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ করা না হলে অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। চাকরি হারাবেন শ্রমিকেরা। ব্যাংকও তাদের পুঁজি হারাবে।
বিটিএমএ সভাপতি বলেন, জ্বালানির সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিলে আজকে এ অবস্থা তৈরি হতো না। পেট্রোবাংলা তাদের আশ্বস্ত করেছিলেন, অক্টোবরের শুরু থেকে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে। নভেম্বরে আরো ভালো থাকবে। ডিসেম্বরে কোনো সংকট থাকবে না। কিন্তু উন্নতি তো দূরে, অক্টোবরে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। তাদের শঙ্কা, আগামী দুই মাসে গ্যাসের সংকট আরো বাড়বে।
সংবাদ সম্মেলনে সভাপতি বলেন, গ্যাস-সংকটে উৎপাদন এখন তলানীতে গিয়ে পৌঁছেছে। হুমকির মুখে পড়েছে ১ কোটি ৬০ হাজার ডলারের বিনিয়োগ। ১০ লাখ মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত। উৎপাদন করা না গেলে শ্রমিক ছাঁটায়ের শঙ্কাও তীব্র হবে।
মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, নিট পোশাকের ৮০ ভাগ কাঁচামালের যোগান দেয় স্থানীয় স্পিনিং শিল্প। গেল বছরেই এই খাত থেকে যোগান দেওয়া হয় ৭ বিলিয়ন মিটার কাপড়। যার আনুমানিক দাম ৮ বিলিয়ন ডলার। তাই এই শিল্পখাতকে বাঁচিয়ে রাখা জরুরি। তিনি বলেন, গত কয়েক মাসে ১ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গ্যাস-সংকট অব্যাহত থাকলে রপ্তানি আরো কমবে। যা ডলার-সংকট আরো বাড়িয়ে দেবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন উদ্যোক্তারা।
বিটিএমএ সভাপতি বলেন, দেশের শিল্পকারখানাগুলো গ্যাসের চাপজনিত সংকটে ভুগছে। অব্যাহতভাবে চলতে থাকা এ সংকট এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে। গ্যাস-সংকটের এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে সরবরাহ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, সরকার নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ালে প্রয়োজনে বাড়তি অর্থ দেবে শিল্পমালিকরা।
বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতির প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগ যখন রেশনিং ব্যবস্থা চালু করে তখন আমরা তা মেনে নেই। কারণ তখন জানতাম কখন বিদ্যুৎ থাকবে, আর কখন থাকবে না। কিন্তু রেশনিংয়ের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে লোডশেডিং।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দেশের বস্ত্রখাতের পণ্যকে উদ্যোক্তারা দুই ভাগে ভাগ করেছেন। একটি স্থানীয় এবং আরেকটি রপ্তানিযোগ্য। তবে এ খাতের শিল্পগুলো রপ্তানিপণ্যে মূল্য সংযোজনের ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখছে। গত ২০২০-২০২১ অর্থবছরে রপ্তানিতে মোট ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মূল্য সংযোজন করেছে বস্ত্র খাতের কারখানাগুলো। এর মধ্যে নিটওয়্যার খাতে স্থানীয় মূল্য সংযোজনের হার ৯০ শতাংশের কাছাকাছি। ওভেন এবং ডেনিম মিলিয়ে মূল্য সংযোজনের হার ৪৫ শতাংশের ওপরে। বস্ত্র কারখানাগুলো রপ্তানিতে অবদান রাখার পাশাপাশি স্থানীয় চাহিদাও পূরণ করছে।
বিটিএমএ সভাপতি বলেন, এ মুহূর্তে দেশের গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থা ২ হাজার ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ৩ হাজার রাখা গেলে শিল্পমালিকরা গ্যাস পাবেন। তাতে টেক্সটাইল খাতে রপ্তানি স্বাভাবিক রাখা যাবে। তিনি বলেন, সরকার যদি আমাদের ২ লাখ ডলারের গ্যাস দেয় আমরা ৪৮ লাখ ডলারের রপ্তানি আয় এনে দেব। প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা গ্যাস না থাকায় টেক্সটাইল শিল্পের উৎপাদন অর্ধেকেরও নিচে নেমে গেছে। শিল্পটিকে বাঁচাতে প্রয়োজনে স্পট মার্কেট থেকে বেশি দামে গ্যাস এনে সরবরাহ ঠিক রাখার দাবি জানিয়েছেন বিটিএমএ সভাপতি।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বস্ত্রখাতের বিনিয়োগের ৭০ শতাংশই বিভিন্ন ব্যাংকের বিনিয়োগ। কারখানাগুলোর উৎপাদন কমে যাওয়ায় ক্রমাগত লোকসানের কারণে উদ্যোক্তারা ব্যাংক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছেন। অনেক শিল্প ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে।
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন বিটিএমএ সহসভাপতি ফজলুল হক ও আব্দুল্লাহ আল মামুন, পরিচালক মোশাররফ হোসেন, আবদুল্লাহ জোবায়ের, সৈয়দ নুরুল ইসলাম, মোনালিসা মান্নান প্রমুখ।