বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে শ্রম অভিবাসন (৮ লাখ বাংলাদেশি কর্মী এবং ইউএসডি ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন রেমিট্যান্স), জ্বালানি সহযোগিতা (১৫ বছরের জি-২-জি এলএনজি চুক্তি) এবং রোহিঙ্গাদের জন্য ক্রমাগত সহায়তাসহ বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক রয়েছে। একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির অধীনে কাতার ও ওমান থেকে বাংলাদেশ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস ক্রয় করে চলেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বছরে প্রায় চার মিলিয়ন টন তরলীকৃত গ্যাস আমদানি করে। কাতারের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ ২০৩২ সালে শেষ হবে এবং ওমানের সঙ্গে মেয়াদ শেষ হবে ২০২৯ সালে। কাতার অন্যতম শীর্ষ জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশ। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে কাতারের সঙ্গে জিটুজি পদ্ধতিতে (গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট) ১৫ বছরের জন্য এলএনজি চুক্তি করেছে। তবে ইউক্রেনে যুদ্ধ, রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এবং পরবর্তীকালে জ্বালানিমূল্য বাড়ানোর কারণে বাংলাদেশে জ্বালানিসংকট দেখা দিয়েছে। স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন হ্রাস এবং আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির উচ্চমূল্যের কারণে বাংলাদেশ বর্তমানে প্রাকৃতিক গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মোকাবিলায় সংগ্রাম করে যাচ্ছে।
কাতার মধ্যপ্রাচ্যের একটি তেলসমৃদ্ধ দেশ। এই দেশের অর্থনীতি মূলত বিদেশি শ্রমের ওপর নির্ভরশীল; কাতারের ৮৯ দশমিক ৫ শতাংশ বাসিন্দা বিদেশি নাগরিক। বিপরীতে বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম শ্রম রপ্তানিকারক দেশগুলোর একটি। প্রায় ৪ লাখ বাংলাদেশি প্রবাসী সেখানে কাজ করছেন, যা কাতারের মোট বাসিন্দার ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। তেলসমৃদ্ধ দেশটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের প্রবাসী ও অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। এছাড়া কাতার চ্যারিটি বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি স্কুল, এতিমখানা ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র পরিচালনা করে। ২০১৭ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ পরবর্তী ১৫ বছরের জন্য বার্ষিক ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন টন এলএনজি পাওয়ার জন্য কাতারের কোম্পানি রাস গ্যাসের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এটা লক্ষণীয় যে গত পাঁচ বছরে কাতার থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ মার্কিন ১ বিলিয়ন ছুঁয়েছে।
বাংলাদেশ যেহেতু জ্বালানিসংকটে ভুগছে, কাতার তার ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াবে। কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির কাছে বছরে আরো এক মিলিয়ন টন তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী গত রোববার (৫ মার্চ) কাতারের দোহায় কাতার ন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে (কিউএনসিসি) স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ওপর জাতিসংঘের পঞ্চম সম্মেলনের মধ্যে দেশটির আমিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে কাতারের আমির বাংলাদেশকে জ্বালানি সরবরাহের আশ্বাস দিয়েছেন। বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান।
বর্তমানে বাংলাদেশ কাতার থেকে বছরে প্রায় ৪০ কনটেইনার জ্বালানি আমদানি করে, অর্থাৎ ১ দশমিক ৮ থেকে ২৫ মিলিয়ন টন। আবদুল মোমেন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে আন্তরিকভাবে সাড়া দিয়ে কাতারের আমির বাংলাদেশ আরো কতটা চায় জানতে চান। আমরা বলেছি, আমরা আরো ১ মিলিয়ন টন বা ১৬-১৭ কনটেইনার চাই। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অনুরোধের পর কাতারের আমির প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, আমি আজ আমাদের জ্বালানিমন্ত্রীকে নির্দেশ দিচ্ছি। কাতার সব সময় বাংলাদেশের পাশে থাকবে।
বাংলাদেশ ও কাতার সম্প্রতি তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করেছে। কাতারের ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তারা ইতিমধ্যে বাংলাদেশের জ্বালানি খাত, এলপিজি স্টোরেজ টার্মিনাল, বিদ্যুৎ ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছেন। এলএনজির বর্ধিত ঋণ ও জরুরি সরবরাহ বাংলাদেশকে জ্বালানি নিরাপত্তায় সহায়তা করবে। বাংলাদেশ যদি বিলম্বিত অর্থ প্রদানের ভিত্তিতে কাতারের এলএনজি পেতে পারে, তবে এটি বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে সহজ করবে এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় আমদানি ক্রয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সাহায্য করবে। কাতার শোধনাগার খাতে সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করতে পারে। ওআইসি সদস্যপদ এবং মুসলিম পরিচয় বাংলাদেশকে এক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে।
অত্যাবশ্যকীয় জ্বালানির অভাব আমাদের রপ্তানিমুখী পোশাক ইউনিটগুলোর জন্য বিদেশি অর্ডারের ক্ষতির কারণ হতে পারে। অন্যান্য শিল্পের উৎপাদনও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিপুলসংখ্যক মানুষ, বিশেষ করে নারী শ্রমিকেরা তাদের চাকরি হারাতে পারেন এবং সমাজে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যসহ সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের খুব ভালো সম্পর্ক রয়েছে। তাই উন্নয়ন ও শান্তি-শৃঙ্খলার স্বার্থে বর্তমান জ্বালানিসংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আরো বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়। এদিকে, কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে খুবই আগ্রহী এবং তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ইতিহাসে এটি একটি যুগান্তকারী ঘটনা হবে, বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে সম্পর্ক সুসংহত হবে। এই সফর বাংলাদেশে কাতারের বিনিয়োগের পথ সুগম করবে। কাতারকে বাংলাদেশের দরকার।
বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা সম্প্রতি সশস্ত্র বাহিনীর ১ হাজার ১২৯ সদস্যকে ডেপুটেশনে কাতারে পাঠানোর চুক্তির খসড়া অনুমোদন করেছে। চুক্তিটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে নবায়ন করা হবে। পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর দুই দেশের সশস্ত্র বাহিনী চূড়ান্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে। বাংলাদেশ ও কাতার উভয়েই এখন প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতায় আগ্রহী। সামগ্রিক সম্পর্ক ইঙ্গিত দেয় যে, এ দুটি দেশ একে অপরের কার্যকর অংশীদার হতে পারে। কাতারের মতো দেশের কাছে বাংলাদেশ অনুকূল দেশ। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মানের ওষুধ উৎপাদন করে এবং কাতার বিদেশ থেকে ওষুধ আমদানি করে। কাতারের আমাদের হাইড্রোকার্বন এবং সেবা খাতে বিনিয়োগের বিশাল সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া করপোরেট ট্যাক্স দিয়ে আয়কর কমানোয় বাংলাদেশে বিনিয়োগ দেশের জন্য আরো বেশি লাভবান হবে। বাংলাদেশ একটি ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট তথা জনসংখ্যাগত লভ্যাংশ উপভোগ করছে এবং উভয় দেশই এই বিরল সুযোগ থেকে উপকৃত হতে পারে। ডিজিটাল স্পেসে বাংলাদেশও এগিয়ে যাচ্ছে এবং কাতার বাংলাদেশের আইটি খাতেও বিনিয়োগ করতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতি মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হতে চলেছে। এখানকার মুদ্রা স্থিতিশীল থাকাকালীন সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করা আকর্ষণীয়। তবে বাংলাদেশ সরকারের জন্য বিদেশি বিনিয়োগসংক্রান্ত সমস্ত অপ্রয়োজনীয় আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতা অপসারণ করাও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে যখন দেশটি এখনো একটি নিরাপদ ও ব্যবসাবান্ধব জাতি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। ২০৪০ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশ হওয়ার লক্ষ্য পূরণে কাতারের মতো দেশ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সরাসরি অবদান রাখতে পারে।