বৈদেশিক মুদ্রার খরচ কমাতে নানা উদ্যোগ চলমান আছে। সরবরাহ বাড়াতে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবুও কিছুতেই বাগে আসছে না ডলার। আমদানি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে ডলারের দর অনেক বেড়ে যাওয়ায় মাঝে মাঝে আন্তঃব্যাংক লেনদেনে দর বাড়ানো হচ্ছে। গতকাল আন্তঃব্যাংকে প্রতি ডলারে আরও ৫০ পয়সা বাড়িয়ে দর ঠিক করা হয়েছে ৯৪ টাকা ৪৫ পয়সা। এ নিয়ে এক বছরে আন্তঃব্যাংকে প্রতি ডলারে বাড়ল ৯ টাকা ৬৫ পয়সা বা ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
বাজারের চাহিদা মেটাতে গতকাল কয়েকটি ব্যাংকের কাছে আরও ৭ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কয়েক দিনে বিক্রি করা হয়েছে ৭০ কোটি ডলার। গত অর্থবছর বিক্রি করা হয় ৭৬২ কোটি ১৭ লাখ ডলার। এর আগের অর্থবছর কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৭৯৩ কোটি ডলার কিনেছিল। ডলার বিক্রির ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে। গত বছরের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করা রিজার্ভ গতকাল ছিল ৩৯ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ডলারের সংকট থাকায় কিছু ব্যাংক এখন বড় এলসি খুলতে চাচ্ছে না। আর ভোগ্যপণ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের এলসিতে দর দিতে হচ্ছে বেশি। আমদানি পর্যায়ে অনেক ক্ষেত্রে দর উঠেছে ১০০ থেকে ১০২ টাকায়। চলতি বছরের শুরুতেও যা ৮৬ টাকার নিচে ছিল। আমদানির পাশাপাশি প্রবাসীদের রেমিট্যান্স এবং দেশের রপ্তানিকারকদের ক্ষেত্রে ডলারের দর এখন ১০০ টাকা বা এর আশপাশে। এদিকে কোনো ব্যাংক বা গ্রাহক ডলার নিয়ে যেন কারসাজি করতে না পারে সেজন্য ৫০ লাখ ডলারের বেশি এলসির তথ্য নিয়মিতভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাতে হচ্ছে। সেখানে কোনো অস্বাভাবিকতা প্রমাণিত হলে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মে মাস পর্যন্ত আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৭ হাজার ৫৪০ কোটি ডলার। একই সময় পর্যন্ত রপ্তানি আয় হয়েছে ৪ হাজার ৪৫৮ কোটি ডলারের। এতে করে প্রথম ১১ মাসে রেকর্ড ৩ হাজার ৮২ কোটি ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। একই সময়ে রেমিট্যান্স প্রায় ১৬ শতাংশ কমে ১ হাজার ৯১৯ কোটি ডলারে নেমেছে। এতে করে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে ১৭ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার।
করোনার পরে এমনিতে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বাড়ছিল। এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিভিন্ন পণ্যের দাম অনেক বেড়েছে। আবার পরিবহন খরচও বেড়ে গেছে। যে কারণে বিভিন্ন দেশে উচ্চ মূল্যস্ম্ফীতি দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশেই শুধু টাকা মূল্যমান হারাচ্ছে তেমন নয়, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ অধিকাংশ দেশের মুদ্রা মূল্যমান হারিয়েছে। ডলারের খরচ কমাতে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয় কাটছাঁট করা হয়েছে ও বিদেশ যাওয়ার ওপর কঠোরতা আরোপ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির খরচ সাশ্রয়ে সপ্তাহে এক দিন পেট্রোল পাম্প বন্ধ রাখা, এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংসহ বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়েছে সরকার।
আমদানি ব্যয় কমাতে গাড়ি, টিভি, ফ্রিজসহ ২৭ পণ্যে শতভাগ এলসি মার্জিন নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে শুল্ক্ক বাড়ানো হয়। একই সঙ্গে বাজারে ডলার সরবরাহ বাড়াতে ব্যাংক ও রপ্তানিকারকের ডলার ধারণের ক্ষমতা কমানো হয়েছে। রপ্তানি আয় আসার এক দিনের মধ্যে ডলার নগদায়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আবার অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট থেকে নেওয়া ঋণ স্থানীয় মুদ্রায় স্থানান্তরের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ইডিএফ থেকে নেওয়া ঋণ কেবল রপ্তানিকারকের নিজস্ব আয় বা জমা বৈদেশিক মুদ্রা থেকে পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। ইডিএফের সুদহার ১ শতাংশ বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে।
এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে করোনার সময়ে দেওয়া শিথিলতার মেয়াদ আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। অবশ্য বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও ভোজ্যতেলের দাম ইতোমধ্যে কমতে শুরু করেছে। এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে এবং বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় আমদানি ব্যয় কমানো সম্ভব হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশা করেন সংশ্লিষ্টরা।