রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের তুলনায় আমদানি কমায় বাজারে ডলারের সংকট কিছুটা কমেছে। তবে সেটা আগের মতো স্বাভাবিক পর্যায়ে আসেনি। আগামী কয়েক মাস এ অবস্থা চলতে থাকলে পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, উলটো কথা। ডলার-সংকটের কারণে এলসি খুলতে না পারায় এখনো সব শিল্পেই কাঁচামালের সংকট দেখা দিয়েছে। এখনো তারা প্রয়োজনীয় এলসি খুলতেও পারছেন না।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ডলার সরবরাহের কিছুটা উন্নতি হওয়ায় এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে। ব্যাংকগুলোতে গড়ে প্রতিদিন ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার এলসি খোলা হচ্ছে। দুই-তিন মাস আগেও যা ছিল ১ হাজারের ঘরে।
ডলার পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফারাহ মো. নাছের ইত্তেফাককে বলেন, ডলার-সংকটের ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। আগের তুলনায় এলসি খোলার হার বেড়েছে। গত নভেম্বর থেকে ডলার-সংকট কিছুটা কাটতে শুরু করেছে। প্রথমত, ঐ মাস থেকে দেশে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় আমদানির ব্যয়ের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে। এখন আগের বড় বড় আমদানি দায়ের ব্যয় পরিশোধ করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, অপ্রয়োজনীয় আমদানি কড়াকড়ি করা হয়েছে। নতুন এলসি মনিটরিং করা হচ্ছে। আমদানিকৃত পণ্যের দামে অসংগতি দেখলে তা বাতিল করে দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ দুটি কারণে এলসি খোলা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। এখন প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার এলসি খোলা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
করোনা মহামারিতে বিশ্ব জুড়ে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়। এর পর শুরু হয় রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ। আর তাতে খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা আরও সংকটে পড়ে। ফলে বিশ্ববাজারে বেড়ে যায় এসব পণ্যের দাম। আর তাতে সবচেয়ে বেকায়দায় পড়ে বাংলাদেশসহ আমদানি নির্ভর দেশগুলো। বেশি দামে পণ্য কেনায় বেড়ে যায় আমদানি ব্যয়। সে তুলনায় রপ্তানিতে গতি না আসায় বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে হয় ৩৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি। আর ঐ সময়ে আশানুরূপ প্রবাসী আয় না থাকায় চলতি হিসাবের ভারসাম্যও দেখা দেয় বড় ধরনের ঘাটতি। বাজারে প্রকট হতে শুরু করে ডলারের সংকট। বার বার টাকার মান কমিয়েও যা সামাল দেওয়া যায়নি।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এ সময়ে আমদানি হয়েছে প্রায় ৩৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। অন্যদিকে রপ্তানি আয় হয়েছে প্রায় ২৬ বিলিয়ন ডলার। আর রেমিট্যান্স ১০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। যা বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী এবং সাবেক এবিবি চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও সেটি আগের অবস্থানে পৌঁছায়নি। এখনো ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকও রাখছে কঠোর নজরদারিতে। তবে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়ায় ডলারের বাজারে কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থা আরও কয়েক মাস চললে সংকট অনেকটাই কেটে যাবে বলে মনে করেন তিনি।
যদিও বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ইত্তেফাককে বলেন, ডলার-সংকট এখনো কাটেনি। ডলার সংকটের কারণে এখন সব শিল্পেই কাঁচামালের সংকট দেখা দিয়েছে। দেশীয় শিল্প এখন কাঁচামাল সংকটে উৎপাদন করতে পারছে না। তাদের ডলার আয় না থাকায় এলসি খুলতেও পারছেন না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পণ্য আমদানির ব্যাপারে কড়াকড়ি করা হচ্ছে। অতি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্য কোনো পণ্য আমদানির বিষয়ে নিরুত্সাহিত করা হচ্ছে। এজন্য তদারকি জোরদার করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারা বলছেন, ৩ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুললেই জবাবদিহি করতে হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলার হার বেড়েছিল প্রায় ৫৭ শতাংশ, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে তা কমে হয়েছে ঋণাত্মক সাড়ে ২৮ শতাংশ। আবার গত অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলার হার যেখানে বেড়েছিল প্রায় সাড়ে ৪৯ শতাংশ, চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে তা না বেড়ে বরং কমে হয়েছে ঋণাত্মক ২.২০ শতাংশ। এভাবেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকির কারণে এলসি খোলার হার কমে যায়। এভাবেই ব্যাংকিং খাতে ডলারের চাহিদা কমানো হয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত মার্চ থেকে দেশে ডলার-সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এ সংকট মোকাবিলায় শুরুতে ডলারের দাম বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু তাতে সংকট আরও বেড়ে যায়। পরে গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়। এ দায়িত্ব দেওয়া হয় এবিবি ও বাফেদার ওপর। এরপর থেকে এ দুই সংগঠন মিলে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় এবং আমদানি দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে ডলারের দাম নির্ধারণ করে আসছে।
রপ্তানিকারকেরা রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের দাম পাচ্ছেন ১০৪ টাকা। প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে ডলারের দাম ১০৭ টাকা। খোলাবাজারে নগদ ডলার অনেক দিন ধরে ১১০ টাকার দরে আশপাশে বিক্রি হচ্ছিল। তবে কয়েক দিন ধরে হঠাৎ দর বাড়ছে। এখন প্রতি ডলার ১১৩ টাকা ৩০ পয়সা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে সোমবার পণ্য রপ্তানি মূল্য বিলম্বে প্রত্যাবাসন (রপ্তানি পণ্যের মূল্য নির্ধারিত সময়ে না আসলে) হলে প্রকৃত প্রত্যাবাসনের তারিখের বিনিময় হারে মূল্য পরিশোধের নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থাৎ রপ্তানি পণ্যের মূল্য যেদিনই দেশে আসুক, প্রকৃত প্রত্যাবাসনের তারিখের ডলারের রেটে মূল্য পরিশোধ করবে ব্যাংক