করোনা ভাইরাসের পর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। প্রতিদিনই চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে তিন-চার জন করে মারা যাচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে আক্রান্ত রোগীর ভিড় বেড়েছে। ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বাড়লেও প্রতিরোধে সিটি করপোরেশনের কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এডিস মশা মারতে কার্যকর ওষুধ ব্যবহার হচ্ছে না। অন্যদিকে ডেঙ্গুর চিকিৎসা খরচও অনেক বেড়ে গেছে। প্রয়োজনীয় ওষুধ ও উপকরণের দাম বাড়িয়ে বাজারে সংকট তৈরি করছে সংশ্লিষ্ট ওষুধ কোম্পানিগুলো।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য চমেক হাসপাতাল, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল, ফৌজদারহাট বিআইটিডিআইতে আলাদা ওয়ার্ড চালু হয়েছে। তবে চিকিৎসকরা জানান, আক্রান্তদের মধ্যে অনেকেই দেরিতে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছে। তখন তাদের অবস্থা অনেক জটিল হয়ে পড়ে। ফলে অনেক রোগীকে আইসিইউতে নিয়েও বাঁচানো যাচ্ছে না। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পেলেও প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ পাচ্ছে না রোগীরা। তাদের চিকিৎসকের স্লিপ নিয়ে ওষুধ বাইর থেকে কিনতে হচ্ছে বলে অনেকের অভিযোগ। হাসপাতাল থেকে শুধু স্যালাইন বিনা মূল্যে সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে। নগরীর বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে এখন অধিকাংশ কেবিনে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছে। নামি-দামি হাসপাতালগুলোতে কেবিন না পেয়ে অনেক রোগী ফেরত যাচ্ছে। চিকিৎসকরা জানান, একজন ডেঙ্গু রোগীকে কমপক্ষে এক সপ্তাহ হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে। এতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ফি, ওষুধ খরচ, কেবিন ভাড়া ও রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষাসহ খরচ মেটাতে রোগীদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।
বেসরকারি ন্যাশনাল হসপিটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. মো. ইউসুফ বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে ৩৫-৪০ জনের মতো ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছে। ডেঙ্গু চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট স্যালাইনসহ ওষুধের দামও বেড়ে গেছে। কোম্পানিগুলো বাজারের চাহিদা অনুপাতে স্যালাইন সরবরাহ দিতে পারছে না। স্যালাইনের চাহিদা চার-পাঁচ গুণ বেড়ে গেছে। এতে চিকিৎসা খরচও বেড়ে গেছে।’
মশা মারার কার্যকর ওষুধ নেই চসিকে: চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন-চসিকের কর্মকর্তারা জানান, মশা নিধন কার্যক্ষম পরিচালনার জন্য তাদের লজিস্টিক ও অর্থের সংকট রয়েছে। এজন্য তারা জরুরি ভিত্তিতে সরকারের কাছে ২০ কোটি টাকা বিশেষ অর্থ বরাদ্দ চেয়েছিলেন। তাতে সাড়া মিলেনি।
বাড়ির আশপাশে, আঙিনায়, ছাদে খোলা জায়গায় পড়ে থাকা খালি পাত্রে, ডাবের খোসায়, খালি টায়ার, ফুলের টবে জমে থাকা পানিতে ডেঙ্গুর প্রজনন হচ্ছে। এছাড়া নালা নর্দমা খালে আবর্জনায় ভরাট হয়ে পড়েছে। এসব কিছু দেখাশোনা ও তদারকির দায়িত্বে রয়েছে সিটি করপোরেশন। কিন্তু তাদের কার্যকর উদ্যোগ নেই। মাঝেমধ্যে লোক দেখানো কিছু ওষুধ ছিটাতে দেখা যায়। অথচ বার্ষিক বাজেটে কয়েক কোটি টাকা পরিচ্ছন্নতা কাজে বরাদ্দ থাকে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদরা জরিপ চালিয়ে নগরীর সাতটি এলাকাকে ডেঙ্গুর হটস্পট হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। স্বাস্থ্য বিভাগের একটি টিম নগরীর ২১টি ওয়ার্ড জরিপ পরিচালনা করেছেন। জরিপে ৩২ শতাংশ বাড়িতে ও ৩৭ শতাংশ কনটেইনারে এডিস মশার লার্ভা পজিটিভ পাওয়া গেছে। জরিপ শেষে তারা ডেঙ্গু মশা নিয়ন্ত্রণে ৯টি সুপারিশ করেছেন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, ডেঙ্গু মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা না গেলে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব রোধ করা যাবে না। স্বাস্থ্য বিভাগের সুপারিশ বাস্তবায়নে কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। চসিক মশক নিধন কার্যক্রমে লার্ভিসাইড (লার্ভা ধ্বংসকারী কীটনাশক) ও এডালটিসাইড (পূর্ণাঙ্গ মশা ধ্বংসকারী কীটনাশক) ব্যবহার করে। কিন্তু এই ওষুধ ডেঙ্গুর প্রজনন ধ্বংসে কার্যকর নয়।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরে এই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রামে ৫৩ জন মারা গেছে। ২০২১ সালে ডেঙ্গুতে মারা গেছে মাত্র পাঁচ জন, আর ২০২২ সালে মারা গেছে ৪১ জন। চট্টগ্রামে চলতি বছরে এ পর্যন্ত ৫ হাজার ৬৯৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ২৬৫ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। অনেকেই চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন।