ঢাকায় একটি বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে কী হবে—তেমন অশুভ চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলেও কেন জানি পারি না। বারবার তাড়া করে ফেরে সেই ভয়ানক পরিস্থিতির কাল্পনিক চিত্র। ঢাকায় বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে যত মানুষ মারা যাবে, তার কয়েক গুণ বেশি মারা যাবে আগুনে পুড়ে এবং বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হয়ে। ভূমিকম্পের পর গ্যাসলাইনে বিস্ফোরণ ঘটবে। সেই আগুনে পুড়ে পুরো নগর দাউ দাউ করে জ্বলবে। ভূগর্ভস্থ পানি ও আশপাশের নদী-জলাশয়ের পানি নগরে বন্যার সৃষ্টি করবে। উপড়ে পড়া বিদ্যুতের খুঁটির তারের সংস্পর্শে এসে সেই পানি বিদ্যুতায়িত হবে। বিধ্বস্ত নগরীতে আহতদের উদ্ধারের জন্য লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না।
উদ্ধারকাজে সাধারণ সময়ে যারা মূল ভূমিকা রাখেন, সেই ফায়ার সার্ভিসের অস্তিত্ব থাকবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ আছে। রাজধানী ঢাকা শহরে তেমন আশঙ্কা বুকে চেপে রেখে আমরা দিন-রাত পার করছি। দিনে দিনে বাড়তি মানুষের চাপে ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। নানা সংকটে জর্জরিত নগরবাসীর নাভিশ্বাস চরমে উঠছে। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত, বিত্তহীন, ছিন্নমূল বস্তিবাসী—সবাইকে একধরনের অস্থিরতা, অতৃপ্তি, অশান্তি নিয়ে থাকতে হচ্ছে। সব জানার পরও প্রতিদিনই গ্রাম ছেড়ে ঢাকা শহরে পা রাখছেন অগণিত নারী-পুরুষ। বিশ্বব্যাংকের ‘বিশ্ব উন্নয়ন সূচক’-সংক্রান্ত বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে ‘বাংলাদেশের জনসংখ্যা :অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে দ্রুত নগরায়ণ হলেও বিপুল মানুষকে ধারণ করার জন্য নগরগুলো মোটেই প্রস্তুত নয়। আবাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগসহ নানা পরিসেবায় নগরগুলো বেশ পিছিয়ে। এ অবস্থায় ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা কঠিন হয়ে পড়বে। গত বছরের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনশুমারি ও গৃহগণনার চূড়ান্ত হিসেবে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ। জনসংখ্যার নিরিখে ২০৫০ সালে বাংলাদেশ দশম বৃহত্তম দেশ হবে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমার পরও ঐ সময় দেশের জনসংখ্যা হবে ২০ কোটি ৪০ লাখ। বিভাগ হিসেবে ঢাকায় জনঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। এই বিভাগে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২ হাজার ১৫৬ জনের বসবাস। নগর হিসেবে সবচেয়ে বেশি মানুষ বাস করে ঢাকায়। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৭ শতাংশ ঢাকায় বসবাস করে। সর্বশেষ জনশুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যার ৩১ দশমিক ৫১ শতাংশ নগরে বাস করে। ২০৫০ সালে দেশের মোট জনসংখ্যার ৫৮ দশমিক ৪ শতাংশ নগরবাসী হবে। ১৯৭৪ সালে নগরে বাস করা মানুষের হার ছিল মোট জনসংখ্যার মাত্র ৯ শতাংশ। নগরায়ণের সবচেয়ে বড় চাপ ঢাকার ওপরে। ঢাকা এখন জনসংখ্যার বিচারে বিশ্বের নবম বৃহত্তম নগর। জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিভাগের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকার অবস্থান হবে তৃতীয়। এই সময়ের মধ্যে ঢাকা ব্রাজিলের সাও পাওলো ও ভারতের মুম্বাইকে ছাড়িয়ে যাবে। দাবদাহের কারণে প্রচণ্ড গরমে বেশ কিছুদিন খুব অস্বস্তিতে ছিল ঢাকাবাসী। কিন্তু সেই সময় ঢাকার চারপাশে সবুজ এলাকায় গরমের অনুভূতি কম ছিল। গবেষকেরা বলছেন, ঢাকার সঙ্গে শহরের বাইরের গরমের অনুভূতির এই পার্থক্যের মূলে রয়েছে তাপীয় দ্বীপ (হিট আইল্যান্ড)। ঢাকার মূল বসতি ও বাণিজ্যিক এলাকার একটা বড় অংশ তাপীয় দ্বীপে পরিণত হয়েছে।
ফলে ঢাকার ঠিক বাইরের প্রাকৃতিক পরিবেশসমৃদ্ধ এলাকার সঙ্গে রাজধানীর তাপের পার্থক্য তৈরি হয়েছে। গত বছর স্প্রিনজার নেচারের থিওরেটিক্যাল অ্যান্ড অ্যাপ্লাইড ক্লাইমেটোলজি সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণায় ঢাকা শহরে তাপীয় দ্বীপের প্রভাবের এসব তথ্য উঠে এসেছে। ‘নগরায়ণে পরিবর্তন ও ঢাকা শহরে তাপীয় দ্বীপের প্রভাব’ শীর্ষক এই গবেষণায় বলা হয়, ঢাকার উষ্ণতম স্থানের সঙ্গে শহরের বাইরের শীতলতম স্থানের দিন-রাতের ভূপৃষ্ঠীয় তাপমাত্রার পার্থক্য যথাক্রমে ৭ ও ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিষয়টি অনেকটা এমন, ঢাকার অদূরে সাভার বা মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে যখন তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকছে, তখন রাজধানীর তেজগাঁও-ফার্মগেট এলাকার ভূপৃষ্ঠীয় তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত কয়েক যুগ ধরে ঢাকা শহরে তাপমাত্রা দ্রুত বাড়তে দেখা যাচ্ছে। অন্তত শহরের ফুটপাতের পাশে ও ভবনের ছাদে গাছ লাগালে এবং আবর্জনাস্থলে পরিণত হতে চলা জলাভূমিগুলো ফিরিয়ে আনা গেলে তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি কমিয়ে আনা সম্ভব। ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ফুটপাত, উন্মুক্ত স্থানে গাছ লাগাতে হবে। বাড়ির ছাদে বাগান করতে হবে।
এ ছাড়া শহরে জলাভূমি সৃষ্টি করতে হবে। গবেষণায় দেখা যায়, ২০০১ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ঢাকা শহরের ভূপৃষ্ঠ এলাকা ২৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ সম্প্রসারিত হয়েছে। একই সময়ে জনসংখ্যা বেড়েছে ৭৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ঢাকার ভূপৃষ্ঠ এলাকা সম্প্রসারণের মানে হলো, শহরের সবুজ স্থান ও জলাভূমি কমে গেছে। শহরে বেড়েছে মানুষ ও বসতি। জনসংখ্যা-জনবসতি বেড়ে যাওয়াসহ অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে মাত্র দেড় যুগের বেশি সময়ে ঢাকার কিছু এলাকার গড় তাপমাত্রা শহর সীমানার তুলনায় ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। বিশেষ করে মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে; অর্থাৎ গ্রীষ্মকালে ঢাকায় গরমের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি থাকছে। গবেষণায় বলা হয়, ঢাকা শহরের সবচেয়ে বেশি সম্প্রসারণ হয়েছে ২০০৭ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে। এই সময়ে শহর এলাকা বেড়েছে ৬ দশমিক ১ শতাংশ। ২০০১ সালে ঢাকার প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৯ হাজার ৪৮১ জন বাস করত।
২০১৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১৩ হাজারে।ইতিমধ্যে ঢাকা শহরে তাপীয় দ্বীপের প্রভাব কমাতে উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। তারা ঢাকার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য আগামী দুই বছরে ২ লাখ গাছ লাগাবে। যুক্তরাষ্ট্রের রকফেলার ফাউন্ডেশন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় তারা শহরের তাপমাত্রা কমানোর জন্য একজন কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন আশা করছে, সবার সহযোগিতায় শহরের তাপমাত্রা কমানো যাবে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ বলছে, ঢাকায় চলতি বছরের এপ্রিলের প্রথম ২৯ দিনের ২৫ দিনই দাবদাহ বয়ে গেছে। আশপাশের জেলাগুলোর তুলনায় ঢাকার তাপমাত্রা সব সময়ই ২ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি থাকতে দেখা গেছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগ ঢাকায় চলতি বছরের এপ্রিল মাসের তাপমাত্রা নিয়ে একটি গবেষণা চালিয়েছে। গবেষণার প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, শহরের বেশির ভাগ এলাকায় এপ্রিলের প্রায় পুরো সময় তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ছিল।
অর্থাৎ, এপ্রিলজুড়ে ঢাকায় প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের কারণে ঢাকার যেসব এলাকা বেশি উত্তপ্ত, সেসব এলাকায় অগ্নিঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে। ঢাকা শহরে অপরিকল্পিত নগরায়ণ হয়েছে। সবুজ-জলাভূমি প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছে। এতে প্রায় পুরো শহর তাপীয় দ্বীপে পরিণত হয়েছে। ফলে এখানে একটি অসহনীয় পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যা শহরের অধিবাসীদের জন্য খুবই অস্বস্তিকর ও অস্বাস্থ্যকর। শহরের বাতাস পর্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এই পরিস্থিতিতে সবুজায়ন না ঘটাতে পারলে ঢাকা শহরের অবস্থার আরো অবনতি হবে। আমাদের এই প্রিয় শহর কোনোভাবে পিছিয়ে থাকতে পারে না, বিশ্বের বাসের অযোগ্য শহরের কিংবা দুর্ভোগের শহরের তালিকায় ঠাঁই পেতে পারে না। দুঃস্বপ্নের বোঝা আর অনাগত বিপদের শঙ্কা বুকে বয়ে আমরা আমাদের প্রতিটি দিন পার করতে চাই না আর। অনেক সম্ভাবনা ও সুন্দরের হাতছানি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমাদের প্রিয় এই রাজধানী ঢাকা শহর দুঃস্বপ্ন কিংবা দুর্ভোগের শহর হিসেবে বিবেচিত হোক, আমরা কোনোভাবেই প্রত্যাশা করি না। আমরা মনে-প্রাণে চাই, একটি চমৎকার বাসযোগ্য স্বস্তিকর জীবনের শান্ত সুনিবিড় আন্তর্জাতিক মানের শহর হিসেবে গণ্য হোক বিশ্বজুড়ে।