ঢাকা-এ অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস সম্প্রতি একটি নিরাপত্তা সতর্কবার্তা প্রকাশ করেছে, যা দেশটির নাগরিকদের বাংলাদেশে অবস্থানকালে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছে। ২৯ মে তারিখে দেওয়া এই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশজুড়ে বিক্ষোভ ও গণজমায়েতের পরিমাণ বেড়েছে এবং সেসব সমাবেশ সহিংসতায় রূপ নিতে পারে। ফলে মার্কিন নাগরিকদের জনসমাগম এড়িয়ে চলতে এবং নিজের নিরাপত্তা নিজে নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
এই সতর্কবার্তা সাধারণভাবে একটি কনস্যুলার দায়িত্ব হিসেবে দেখা গেলেও অনেকেই এটিকে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্বেগের একটি প্রতিফলন হিসেবে দেখছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে এই ধরনের বার্তা কেবল নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য নয় বরং এটি একটি সূক্ষ্ম কূটনৈতিক বার্তা যা সরকার ও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর প্রতি নজরদারিরও ইঙ্গিত দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহফুজা রহমান বলেন এটি নিছক একটি নিরাপত্তা বার্তা নয়। এর মাধ্যমে মার্কিন কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ সরকারকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে পরিস্থিতি তারা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে সহিংসতা এড়াতে গঠনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের প্রত্যাশা রয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে এই সতর্কবার্তার অন্তর্নিহিত তিনটি প্রধান উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রথমত, মার্কিন নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে সরকারের ওপর আলোচনায় বসার কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা। এবং তৃতীয়ত, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য দেশের ঝুঁকি পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা।
বাংলাদেশ এর বর্তমান রাজনৈতিক সংকট
বাংলাদেশে চলমান আন্দোলনগুলোর পেছনে রয়েছে শ্রমিক অধিকার ইস্যু কোটাপদ্ধতির সংস্কার দাবি এবং রাজনৈতিক বিরোধ। ঢাকা এর বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষে ইতোমধ্যে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। কিছু এলাকায় সীমিত কারফিউ এবং মোবাইল ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত হওয়ার খবরও পাওয়া গেছে।
বিশ্ব ব্যাংকের সাম্প্রতিক গ্লোবাল রিস্ক আউটলুকে বলা হয়েছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রবাহে প্রায় সতেরো শতাংশ হ্রাস ঘটাতে পারে। একইসঙ্গে পর্যটন খাতও এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের এক কর্মকর্তা।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এই ধরনের সতর্কতা নতুন কিছু নয়। ২০১৯ সালে হংকংয়ে গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের সময়ও যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস এমন সতর্কতা জারি করেছিল যার পরিণতিতে পর্যটন খাতে তাৎপর্যপূর্ণ হ্রাস ঘটে। ২০২০ সালে থাইল্যান্ডে রাজতন্ত্রবিরোধী বিক্ষোভ এবং ২০২৩ সালে পাকিস্তানের নির্বাচনকালীন সহিংসতার সময়ও এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল।
এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এই বার্তাকে ঘিরে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলেছে তারা এটিকে আগাম আশঙ্কা হিসেবে বিবেচনা করছে এবং পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
বিশ্লেষকদের মতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলেও এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি এবং সরকারের উচিত হবে বিরোধী পক্ষ ও সংশ্লিষ্ট সকল মহলের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সংলাপ ও আলোচনায় বসে উত্তেজনা নিরসনের পথ খোঁজা। কারণ অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা না থাকলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং অর্থনীতি উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এই সতর্কবার্তা কি কেবল সুরক্ষা পরামর্শ নাকি ভবিষ্যতের জন্য একটি রাজনৈতিক সংকেত সেই প্রশ্ন এখন কূটনৈতিক মহলে আলোচনার কেন্দ্রে। তবে এটুকু বলা যায় যে এমন বার্তা পাঠানো হয় না যদি না প্রেরক পক্ষ পরিস্থিতিকে গুরুতর মনে করে।
তথ্যসূত্রঃ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস ঢাকা ডেমনস্ট্রেশন অ্যালার্ট ২৯ মে ২০২৫ BBC World Hong Kong Protest Coverage ২০১৯ World Bank Global Economic Risk Outlook এপ্রিল ২০২৫ Oxford Journal of International Affairs ভলিউম ৩৬ সংখ্যা ২
প্রতিবেদক মেয়র -লন্ডন বরো অব বার্কিং এন্ড ডাগেনহ্যাম