পঞ্চমী থেকে পাঁচদিনের পার্বণ বিলেতে।
বছরের শুরুতে নেওয়া হয়ে গিয়েছে ছুটি। কলকাতা থেকে এসে গিয়েছে ঢাক, বাদ্য বাজানোর জন্য রয়েছে কম্পিটিশন। বাঁধা হয়েছে মেরাপ। তাতে খাটানো হবে প্যান্ডেল। সাগরপারে বিলেত না একটুকরো বাংলা– বোঝার উপায় নেই।
বিদেশে সাধারণত হল ভাড়া করে সপ্তাহান্তে পুজো হত। কিন্তু এবছর ব্রিটেনে ট্রেন্ডটা অন্যরকম। উইক এন্ডে তো বটেই প্রথা ভেঙে উইক ডেতেও পুজোর আমেজ থাকবে লন্ডন এবং ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের বিভিন্ন পুজোতে। এবছর নয় নয় করে প্রায় শ’খানেক পুজো হচ্ছে গোটা ব্রিটেন জুড়ে। স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো–এডিনবরা বা উত্তর আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্ট–লেটারকেনি বা ইংল্যান্ডের লিডস–লিভারপুল, পশ্চিমে ব্রিস্টল, পূর্বে এসেক্স বা দক্ষিণের হ্যাম্পশায়ার। অধিকাংশ পুজোতেই পাঁচদিনের আয়োজন করেছেন কর্মকর্তারা।
এখানেই শেষ নয়। হিটার বিশিষ্ট হলঘরে নয়, রীতিমতো মাঠে নেমে প্যান্ডেল বানাচ্ছে লন্ডনের হ্যারো অঞ্চলের পুরোনো পুজো পঞ্চমুখী। এতদিন নির্দিষ্ট একটি হলে পুজো হলেও এবারে হেডস্টোন লেনের মাঠে হচ্ছে পুজো। মাঠেই থাকছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চ। সাধারণ সম্পাদক সৈকত বর্মন জানান, ‘এর জন্য অনুমতি পেতে কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। এই হাজার স্কোয়ার ফিটের প্যান্ডেলের ভিতরের কাজ আমাদের নিজেদেরই করে নিতে হচ্ছে। পুজোর ক’দিন চলবে ঢাক আর কাসর বাদ্য। আমাদের পুজোতে এলে পুরো ঘরোয়া এবং কলকাতার স্বাদ পাবেন।’
একই বক্তব্য লন্ডনের অন্যপান্তে স্লাও অঞ্চলের জনপ্রিয় পুজো আড্ডার কর্মকর্তা নীলোৎপল মণ্ডলের। ৩রা অক্টোবর দশমী পুজো আড্ডায় সেদিন দুপুরে সেখানে চলবে ঢাক এবং শঙ্খ বাজানোর প্রতিযোগিতা। এছাড়া পুজোর নিয়ম মেনে দেবীর পায়ের কাছে থাকবে ১০৮ পদ্মফুল। আড্ডার পুজো এবারে এক দশক পূর্ণ করল। সেই কারণে হাওড়া থেকে শিল্পী গৌরব পালের তৈরি মূর্তি আনানো হয়েছে। মণ্ডপের বাইরে তৈরি হচ্ছে বিশাল গেট অফ জয়। তাতে থাকে ছৌ নাচের মুখোশ, পিংলা নয়াগ্রামের পটচিত্র, ইত্যাদির মতো বাংলার হস্তশিল্পের সম্ভার।
এবছর ৪২ বর্ষে পড়ল স্কটল্যান্ডের সব থেকে আদি পুজো বঙ্গীয় সাংস্কৃতিক পরিষদ গ্লাসগো। পুরোহিত বাবুলায়েব মুখোপাধ্যায় জানালেন, ‘৮০–র দশক থেকে মহালয়ার দিন এই গ্লাসগোতে লাইভ মহিষাসুরমর্দিনী পাঠ হয়। প্রতিবছরের মতো এবছরও সাবেকি স্টাইলে পুজো হবে, থাকবে ভোগ বিতরণ, হোম, চণ্ডীপুজো এবং সন্ধিপূজো। পুজোর পাঁচদিন সদস্যরা অফিস ছুটি নিয়ে পুজোয় যোগ দেন, দু’জন পুরোহিত আমাদের। আমি ও অরুণাভ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাঙালিদের উৎসাহ তো বটেই স্থানীয় স্কটিশ লোকজনের এই পুজো নিয়ে যা উত্তেজনা তা এলেই দেখতে পাবেন।’
উত্তেজনা তো বটেই। আবেগের উন্মাদনাও বলতে পারেন। কারণ বিভিন্ন পুজো প্যান্ডেলের সঙ্গে কথা বলে জানা যাচ্ছে সদস্যরা তো বটেই সাধারণ অনেক মানুষ এ বছর অফিস ছুটি নিয়েছেন সোমবার অষ্টমীর দিন। পঞ্চমুখীর সৈকতবাবুর কথায়, ‘আমরা তিথি মেনে সোমবার সকাল ১১টায় সন্ধিপূজো করব। আমাদের ৯০ শতাংশ সদস্য সদস্যরা আমাদের সঙ্গে থাকবে সেদিন। অষ্টমীর অঞ্জলি সবাই একসঙ্গে দেব। তবে যারা সকালে পারবেন না তাদের জন্য বিকেলে নবমীর অঞ্জলীর ব্যবস্থা থাকছে।’
উপাচার রীতি–নীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পুজোর ক’দিনের খাওয়া দাওয়া। তিনদিন অগণিত মানুষকে ভোগ খাওয়াচ্ছে হ্যারো অঞ্চলের আরেকটি পুজো বিলেতে বাঙালি। প্রতিদিন ৮০০/১০০০ লোকের ভোগের ব্যবস্থা করেছে তাঁরা। সেই সঙ্গে নস্টালজিক বাঙালির পাতে নবমীতে তুলে দেওয়া হবে পাঁঠার মাংস। সেরা রাঁধুনি, ফ্যাশন শো ও শারদ সুন্দরী প্রতিযেগিতাও থাকছে বিলেতে বাঙালির পুজোতে। তাদের ফেসবুক পেজে পুজো লাইভ দেখানোর ব্যাবস্থাও থাকছে।
তবে পাঁচদিনের এই পুজোর ট্রেন্ড মোটেই নতুন নয় বলে দাবি করেছেন লন্ডনের বেলসাইজ পার্কের পুজোর সম্পাদক চন্দনা সান্যাল। প্রায় চার দশকেরও বেশী সময় ধরে চলা এই পুজোর অধিকাংশ সদস্যের জন্ম ও বেড়ে ওঠা কিন্তু ব্রিটেনে। চন্দনা দেবীর কথায় ‘ব্রিটিশ এশীয় বংশোদ্ভুতের তৃতীয় প্রজন্ম।’ কলকাতা বা বাংলার পুজো নয়, বিদেশের মাটিতে বাবা মাকে পুজো করতে দেখে শারদোৎসবের সঙ্গে পরিচয় এদের। চন্দনাদেবী বলেন, ‘আমরা বরাবরই তিথি অনুযায়ী পুজো করেছি, সপ্তাহান্তের দু’দিনের পুজোয় বিশ্বাসী নই। আমাদের ছেলে মেয়েরাও তাই করছে। তবে পুজোর জন্য কাজের দিন ছুটি পাওয়াটা চ্যালেঞ্জ মানছি। পরবর্তী প্রজন্ম এটা কত সহজে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে জানি না। তবে আমাদের ছেলে মেয়েরা, তাদের অবাঙালি বা অভারতীয় স্বামী–স্ত্রীরা আমাদের দুর্গোৎসবের সংস্কৃতির সঙ্গে ভীষণভাবে যুক্ত এবং অত্যন্ত উৎসাহী। আমাদের পুজোয় কোনও সাহেবকে প্রসাদ বিতরণ, বা মেমকে পুজোর ফুল গোছাতে দেখেন, তো অবাক হবেন না।’