সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবিতে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় দেশব্যাপী আবারও ৪৮ ঘণ্টার সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচিতে যাচ্ছে বিএনপি। আজ রোববার ভোর ৬টা থেকে মঙ্গলবার ভোর ৬টা পর্যন্ত চতুর্থ ধাপের এ অবরোধ কর্মসূচি চলবে। যুগপৎভাবে এ কর্মসূচি পালিত হবে। বিএনপির কর্মসূচির এখন মূল টার্গেট দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল। দলটি মনে করছে, দেশে নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নেই। এ অবস্থায় যদি একতরফা তপশিল ঘোষণা করা হয়, তাহলে সব দল ও মতকে সঙ্গে নিয়ে লাগাতার আন্দোলনে যাবে বিএনপি ও তার মিত্ররা।
জানা গেছে, তপশিলের পর লাগাতার হরতাল-অবরোধে যাবে বিএনপি। মানুষের চলাচল ও পণ্য পরিবহনের সুবিধা তথা জনস্বার্থে শুক্র ও শনিবার বাদ দিয়ে কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। তখন শুক্র ও শনিবার বিক্ষোভের মতো কর্মসূচিও আসতে পারে। এতেও সফলতা না এলে নির্বাচন ঠেকাতে সর্বশেষ কর্মসূচি হিসেবে হরতাল-অবরোধের সঙ্গে অসহযোগ আন্দোলনেও যেতে পারে বিএনপি ও শরিকরা।
অসহযোগের বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নিলেও বিষয়টি ভাবনায় রয়েছে।
সূত্র মতে, এখন পর্যন্ত জনস্বার্থে শুক্র ও শনি ছাড়াও সপ্তাহের আরও একটি দিন কর্মসূচির আওতামুক্ত রাখার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে বিএনপি ও শরিকদের। পালিত হওয়া তিন ধাপের অবরোধ কর্মসূচিতে সেটা অনুসরণও করা হয়েছে। রবি ও সোমবার এবং বুধ ও বৃহস্পতিবার কর্মসূচি হলেও মাঝে মঙ্গলবার বিরতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তপশিলের পরে রবি থেকে বৃহস্পতিবার টানা হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি চলতে পারে। এদিকে চতুর্থ ধাপের অবরোধ কর্মসূচি শেষে চলতি সপ্তাহের শেষ দুদিন হরতালের কর্মসূচি আসতে পারে বলে বিএনপি ও যুগপতের শরিকরা জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, এই মুহূর্তে সরকার একতরফা তপশিল ঘোষণা করলে তারা ফের এটাই প্রমাণ করবে যে, আওয়ামী লীগ সরকার গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী নয়, বরং একদলীয় স্টিমরোলার চালিয়ে দেশ শাসন করতে চায়। সরকারি দল হয়তো মনে করছে অতীতের মতো একটি একতরফা সাজানো নাটক করে এবারেও নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে যাবে। তারপর যেনতেন প্রকারে একটা গৃহপালিত বিরোধী দল সাজিয়ে নির্বিঘ্নে একটি ‘মেইক বিলিভ’ সংসদের নাটক মঞ্চস্থ করবে। তবে বিষয়টি হচ্ছে এই, এখন আর ২০১৪ বা ২০১৮ সাল নয়, ২০২৪-এ এসে এখন সরকার আর দেশে-বিদেশে কাউকে বোকা বানাতে পারছে না। কারণ, তাদের ‘অলটারনেট গণতন্ত্রের’ ফানুস এরই মধ্যে ফেটে ভেতরের গ্যাস বের হয়ে চুপসে গেছে। এখন দেশের ভেতরেই হোক বা বাইরেই হোক, সবাই প্রত্যক্ষ করেছে এবং খোলাখুলিভাবে স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, বিরোধী দলের ওপর ক্র্যাকডাউন করে এবং তাদের সংগঠনের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত সবাইকে গ্রেপ্তার করে তারপর একতরফা প্রহসনের নির্বাচনের তামাশার মাধ্যমে রাজত্ব চালানো যেতে পারে, তবে গণতন্ত্র নয়।
সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে ঢাকায় গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ-সমাবেশের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলনে নামে বিএনপি ও শরিকরা। পুলিশ হামলা চালিয়ে মহাসমাবেশ পণ্ড করে দেওয়ার প্রতিবাদে পরদিন ২৯ অক্টোবর সারা দেশে হরতালের কর্মসূচি পালন করে তারা। এরপর বিএনপির মহাসমাবেশে হামলা, নেতাকর্মীদের হত্যা, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ আন্দোলনরত বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার, বাড়ি বাড়ি তল্লাশি-হয়রানি ও নির্যাতনের প্রতিবাদে এবং একদফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে এক দিন বিরতি দিয়ে প্রথম দফায় ৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত ৭২ ঘণ্টা, ৫-৬ নভেম্বর দ্বিতীয় দফায় ৪৮ ঘণ্টা এবং তৃতীয় দফায় ৮-৯ নভেম্বর ৪৮ ঘণ্টার রাজপথ, রেলপথ ও নৌপথ অবরোধের কর্মসূচি পালন করে বিএনপিসহ মিত্ররা। অর্থাৎ গত দুই সপ্তাহে তিন দফায় ১৬৮ ঘণ্টার অবরোধ এবং ২৪ ঘণ্টা হরতালের কর্মসূচি করেছে তারা।
এদিকে ১৪ নভেম্বর কিংবা এর কাছাকাছি সময়ে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করা হতে পারে বলে নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে। দেশে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ নেই দাবি করে গণতন্ত্র মঞ্চসহ বিএনপির শরিকরা এরই মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে (সিইসি) একতরফা তপশিল ঘোষণা না করার আহ্বান জানিয়েছে। এ ছাড়া ‘দেশের স্বার্থে’ ইসিকে তপশিল ঘোষণা না করার আহ্বান জানিয়েছে পাঁচ দলীয় রাজনৈতিক মোর্চা ‘সমমনা ইসলামি দলসমূহ’। তারা বলছে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবি উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করে নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করা হলে পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক হতে পারে। গত শুক্রবার বিবৃতি দিয়ে এ অভিমত গণমাধ্যমকে জানিয়েছে তারা। পাঁচ দলীয় রাজনৈতিক মোর্চার শরিক দলগুলো হলো বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বদরুদ্দোজা আহমেদ-কাজী আবুল খায়ের) ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, আমরা এরই মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে (সিইসি) একতরফা তপশিল ঘোষণা না করার আহ্বান জানিয়েছি। দেশে এখন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নেই, কোনো গণতান্ত্রিক অবস্থা নেই। তা ছাড়া সংবিধান অনুযায়ী ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। সুতরাং ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তপশিল ঘোষণা করলেও কোনো সমস্যা নেই। তাই ইসি এই মুহূর্তে তপশিল ঘোষণা না করে নৈতিক জায়গা থেকে সরকারকে বলতে পারে, আপনারা বিএনপিসহ সব দলের সঙ্গে বসে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সৃষ্ট সংকট নিরসন করুন। অন্যথায় আমাদের পক্ষে একতরফা নির্বাচনের ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব নয়। তার পরও তারা যদি জোরজবরদস্তি করে একতরফা তপশিল ঘোষণা করেন, জনগণ এবং বিরোধী দল সাজানো একতরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে এবং শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনগণ তার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ জোরদার করবে।
বিএনপির দাবি, বর্তমান সংঘাত-সংঘর্ষময় পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোট বাদে কোনো রাজনৈতিক দলই একতরফা তপশিল চায় না। দলটির নেতারা বলছেন, দেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নেই। বিএনপির মহাসচিবসহ শীর্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ নেতারা কারাগারে। বাকি নেতারা গ্রেপ্তার এড়িয়ে চলছেন। তালাবদ্ধ দলীয় কার্যালয় পুলিশের নিয়ন্ত্রণে। নির্বাচনে অযোগ্য করতে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সাজা দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ বিএনপির জন্য নির্বাচনের কোনো পরিবেশ রাখা হয়নি। এ অবস্থায় তপশিল ঘোষণা হবে আত্মঘাতী। এর মধ্য দিয়ে সরকার যে আরেকটি একতরফা নির্বাচনের দিকে এগুচ্ছে, সেটিই প্রমাণিত হচ্ছে। তবে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন যেমন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি, তেমনি আবারও একটি একতরফা নির্বাচন হলে সেটিও গ্রহণযোগ্যতা পাবে না, বরং সংকট আরও ঘনীভূত হবে। কারণ, আগামীতে অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের ওপর পশ্চিমা বিশ্বের চাপ অব্যাহত রয়েছে। নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে ভিসা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করেছে।
নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলনে থাকা বিএনপি দাবি আদায় করেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চায়। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার অনড় অবস্থানে রয়েছে দলটি। এমন প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপির চলমান আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সফলতা না পেলে তাদের সামনে দুটি বিকল্প থাকবে। এক. দশম সংসদের মতো আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনও বর্জনের পথে হাঁটা এবং দুই. সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচনে যাওয়া। তবে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ইস্যুতে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে কোনো সমঝোতায় যাবে না বলেও এরই মধ্যে দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা এবং যুগপতের শরিকদের জানিয়ে দিয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। যুগপতের শরিকদের সঙ্গে বৈঠকগুলোতে তাদের দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার অনুরোধও জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে নির্বাচনে গেলে তারা বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হবেন বলেও সতর্ক করেছে বিএনপি। শরিকরাও বিএনপিকে ছেড়ে নির্বাচনে না যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বিএনপির প্রত্যাশা, তারা নির্বাচন বর্জন করলে যুগপতের শরিকরা ছাড়াও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলনে থাকা অন্য দল ও জোটও নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেবে।
মহাসমাবেশ ঘিরে প্রায় ২ হাজার গ্রেপ্তার: বিএনপির ডাকা মহাসমাবেশের দিন সহিংসতার ঘটনায় ২৮ অক্টোবর থেকে গত শুক্রবার পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ১৩১টি মামলায় ১ হাজার ৮১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে ডিএমপির মিরপুর বিভাগে ৩৯২ জন, লালবাগ বিভাগে ৩৩২, ওয়ারী বিভাগে ৩৩৪, মতিঝিল বিভাগে ৩০১, তেজগাঁও বিভাগে ১৩৪, গুলশান বিভাগে ৭২, রমনা বিভাগে ৯০ এবং উত্তরা বিভাগে ৭২ জন রয়েছে। গতকাল শনিবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার কেএন রায় নিয়তি এ তথ্য জানিয়েছেন।
অবরোধের আওতামুক্ত পূজার ধর্মীয় আচার: সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কালী ও শ্যামাপূজার ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান অবরোধ কর্মসূচির আওতামুক্ত থাকবে বলে জানিয়েছে বিএনপি। গতকাল শনিবার দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এ কথা জানানো হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, ৪৮ ঘণ্টার অবরোধে সনাতন ধর্মাবলম্বী কালীপূজ ও শ্যামাপূজার ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, গণমাধ্যমে ও সংবাদপত্রের বহনকারী গাড়ি, জরুরি সেবায় নিয়োজিত অ্যাম্বুলেন্স ও অক্সিজেন সিলিন্ডার বহনকারী গাড়ি অবরোধের আওতামুক্ত থাকবে।
চার বাসে আগুন, ককটেল বিস্ফোরণ: অবরোধ কর্মসূচি শুরুর আগে রাজধানীতে চারটি বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। গতকাল রাত ৮টা ২০ মিনিট থেকে ১০টার মধ্যে মতিঝিল নটর ডেম কলেজের সামনে, গাবতলী বাসস্ট্যান্ড, গুলিস্তান ও যাত্রাবাড়ীতে বাসে আগুন দেওয়া হয়। পরে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নেভায়। ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম জানান, যাত্রীবাসী বাসে আগুন দিলেও কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
এদিকে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় দুটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল সন্ধ্যা ৭টার পর এ ঘটনা ঘটে। তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অপূর্ব হাসান জানান, ফার্মগেটের ফার্মভিউ সুপার মার্কেটের সামনে হঠাৎ করে দুর্বৃত্তরা রাত ৭টা ১৫ মিনিটের দিকে দুটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এতে কেউ আহত হননি।