স্বীকৃত বাস্তবতা হলো, চীন যদি কোনোভাবে তাইওয়ান আক্রমণ করে বসে, তবে তা বিশ্বের জন্য ডেকে আনবে নতুন বিপর্যয়। এর ফলে যে সংঘাতের সৃষ্টি হবে, তাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাদ যাবে না জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেনসহ আরো কিছু দেশ। এ কথা বলার কারণ, তাইওয়ানে চীনের সম্ভাব্য আক্রমণের বিষয়ে শীর্ষ মার্কিন জেনারেল ও কর্মকর্তারা বারবার সতর্ক করছেন। তবে এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাইডেন প্রশাসন ঠিক কী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, তা নিয়ে সবাই অন্ধকারে! মার্কিন নীতির এই চিরাচরিত ‘কৌশলগত অস্পষ্টতা’ বেইজিংকে বিশেষ সুবিধা করে দিচ্ছে! ‘তাইওয়ান ইস্যু’ প্রশ্নে ওয়াশিংটন খোলাসা করে কিছু না বলার কারণে ‘ক্রস-স্ট্রেট টেনশন (মূল ভূখণ্ড চীনের সঙ্গে তাইওয়ানের উত্তেজনা)’ দিনকে দিন অনেকটা আড়ালে চলে যাচ্ছে। তাইওয়ানে ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা ততটা গুরুত্ব পাচ্ছে না, যতটা পাওয়ার কথা। আমরা দেখছি, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যতই প্রতাপশালী হয়ে উঠছেন, তাইওয়ানকে চীনের সঙ্গে একীভূত করার বিষয়ে তার দৃঢ়, কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তাইওয়ান এবং সামগ্রিকভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রতি শির আক্রমণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। স্বশাসিত দ্বীপ তাইওয়ানকে চীনের সঙ্গে সংযুক্ত করার বিষয়ে শিকে প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করতে দেখা গেছে গত মাসে। এমনকি চীনের নিজস্ব অংশ ও সম্পত্তি হিসেবে অবিহিত করে তাইওয়ানকে মূল ভূখণ্ড চীনের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে ইদানীং প্রায়ই বিবৃতি দিচ্ছেন শি! কিন্তু এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে ‘স্পষ্ট ও কড়া প্রতিক্রিয়া’ না আসায় তাইওয়ান ইস্যুর বর্তমান বাস্তবতা অনেকটা ‘আগুনে ছাইচাপা পড়া’র মতো!
জাতীয় গণ-কংগ্রেসের উদ্দেশে শিকে বলতে শোনা গেছে, ‘বহিরাগত শক্তি ও তাইওয়ানের বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপের বিরোধিতা করা উচিত আমাদের। এ ব্যাপারে সক্রিয় থাকতে হবে। জাতীয় পুনরুজ্জীবন ও পুনরেকত্রীকরণের প্রশ্নে আমাদের অটল থাকতে হবে। ঐক্যবদ্ধভাবে এই প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে হবে।’ শির কথার যে অংশকে বিশেষভাবে আমলে নেওয়া জরুরি তা হলো, ‘প্রয়োজনে বলপ্রয়োগের কথাও বলেছেন শি!’ তাইওয়ান প্রশ্নে শির অবস্থান যখন এই, তখন আমেরিকার চুপ থাকা কিংবা স্বভাবসুলভ অস্পষ্ট নীতির কারণে তাইওয়ান ইস্যু তো অমীমাংসিতই থেকে যাবে! তাইওয়ান নিয়ে বিশ্বরাজনীতিতে দানা বাঁধা সমস্যা অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলে যাবে। এর ফলে তাইওয়ান সমস্যা হয়ে উঠতে পারে ‘তাইওয়ান-সংকট’!
এ বিষয়ে দ্বিমত থাকার কথা নয়, ‘তাইওয়ান সমস্যা’ নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিভিন্ন সময়ে খাপছাড়া মন্তব্য, অস্পষ্ট বার্তা তথা ‘পেটের ভেতর কথা রেখে দেওয়া’ তাইওয়ান নিয়ে বিভ্রান্তি বাড়ায়। উদাহরণস্বরূপ, সেপ্টেম্বরে বাইডেনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ইউক্রেনের প্রতি তিনি যেভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন, তাইওয়ানকে রক্ষা করার জন্য একইভাবে এগিয়ে যাবেন কি না। বাইডেনের উত্তর ছিল, ‘অবশ্যই হ্যাঁ।’ তিনি বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ। সত্যিই যদি ইউক্রেনের মতো অন্যায্য আক্রমণের শিকারে পরিণত হয় তাইওয়ান, সেক্ষেত্রে এগিয়ে যাব।’ বাইডেনের মুখ থেকে এমন কথা প্রত্যাশিত বটে, কিন্তু এক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকে যায়—এ ধরনের কথাবার্তা মার্কিন নীতির সঙ্গে কতটা সংগতিপূর্ণ?
বলে রাখা দরকার, তাইওয়ান ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক নীতি ঠিক কেমন হবে, তার একটা রূপরেখা আছে। ‘১৯৭৯ তাইওয়ান রিলেশন অ্যাক্ট’-এর দিকে দৃষ্টি দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। এ আইন অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘তাইওয়ানকে প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্র সরবরাহ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যার উদ্দেশ্য—প্রতিরোধ।’ অর্থাৎ, আমেরিকার অস্ত্রে কোনোভাবেই তাইওয়ানের যুদ্ধ-সংগ্রাম করার কথা বলা নেই উক্ত অ্যাক্টে। সুতরাং, আগ বাড়িয়ে এ ধরনের কথা বলার কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে? বাইডেন প্রশাসনেরও এ কথা অজানা নয়। এ কারণে বাইডেনের কথার পরিপ্রেক্ষিতে চীনের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিবাদ আসার পর দ্রততার ভিত্তিতে বাইডেনের বিবৃতি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন মার্কিন প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
আমরা দেখেছি, শির যতই উত্থান ঘটছে, আমেরিকার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ক্রমবর্ধমানভাবে শীতল হচ্ছে! বিশেষ করে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের জমানায় মার্কিন-চীন সম্পর্ক বেশ স্থবির হয়ে পড়ে। সম্পর্কের এই ক্রমাবনতির উত্তাপ গিয়ে লাগছে দুই দেশের রাজনীতিবিদদের গায়ে। অনেক রাজনীতিবিদের কণ্ঠে হতাশার বাণীই বেশি করে লক্ষণীয়! গত বছর মার্কিন নিম্নকক্ষ পরিষদের হাউজ স্পিকার ডেমোক্র্যাট ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চরম উত্তেজনা দেখা দেয়। পেলোসির সফরকে ‘অপ্রয়োজনীয় ও উসকানিমূলক’ হিসেবে অবিহিত করে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে শির সরকার। অতি সম্প্রতি তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েনের আমেরিকা সফর ঘিরে উভয় পক্ষ থেকে উত্তেজনাপূর্ণ কথা চালাচালি হতে দেখা যাচ্ছে। সাইয়ের সফরকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত!
পেলোসির উত্তরসূরি হাউজ স্পিকার রিপাবলিকান কেভিন ম্যাকার্থির সঙ্গে সাইয়ের দেখা করাকে যে চীন ভালোভাবে নেবে না—এটাই স্বাভাবিক। এই সফরের প্রতিক্রিয়া হিসেবে চীনের কাছ থেকে বড় ধরনের সামরিক হুমকি আসতে পারে—এমন চিন্তাও অমূলক নয়। লাতিন আমেরিকার মিত্রদের সঙ্গে তাইওয়ানের এভাবে ‘আরো কাছে আসা’ চীনের জন্য বড় অস্বস্তি এ কারণে, সম্প্রতি হুন্ডুরাসকে বেইজিংয়ের সঙ্গে একই টেবিলে দেখা যাওয়ার পরই সাই উড়ে গেছেন আমেরিকায়। যা হোক, ম্যাকার্থি-সাইয়ের মিটিংয়ে কী কথাবার্তা হতে পারে, তার অনেকটা আন্দাজ করা সম্ভব। হতে পারে, আগামী বছরের মার্কিন নির্বাচন সামনে রেখে ‘রিপাবলিকানদের কট্টর চীনবিরোধী অবস্থান’ নিয়ে নতুন করে বিজ্ঞাপন দেওয়া! তাছাড়া এই সফরের মধ্য দিয়ে সাইয়ের ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি (ডিপিপি) ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক আরো একটু ঝালিয়ে নিল!
দেখার বিষয়, সাইয়ের সফরে কী আলোচনা হলো, তা নিয়ে মার্কিন-তাইওয়ান দুই দেশই তেমন কিছু উল্লেখ করেনি। কৌশলগত অস্পষ্টতা হিসেবে আমেরিকা কিছু বলেনি বটে, কিন্তু তাইওয়ানের মুখেও কোনো ‘রা’ নেই! এক্ষেত্রে ধরে নেওয়া যায়, পরবর্তী নির্বাচনে সাই অংশ নিতে পারবেন না বিধায় তার উত্তরাধিকারী, যিনি স্বাধীনতার পক্ষে উচ্চকণ্ঠ থাকবেন, তার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ডিপিপির প্রধান প্রতিপক্ষ কুওমিনতাং (কেএমটি) যেমনটা দাবি করেছে—‘আমেরিকায় গিয়ে ডিপিপি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করেছে, যা তাইওয়ানের জন্য ভালো সংবাদ নয়।
ভুলে গেলে চলবে না, কেএমটি দীর্ঘদিন ধরে তাইওয়ানবাসীকে এটা বোঝাতে চেষ্টা করে যাচ্ছে, তারা (কেএমটি) আদৌ ‘চীনপন্থি’ নয় (কেএমটির সঙ্গে চীনের গোপন আঁতাঁত রয়েছে বলে প্রচার আছে), বরং তাইওয়ানের শান্তি ও সমৃদ্ধিই কেএমটির মূল আদর্শ। গত নভেম্বরে স্থানীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে নজর কাড়ে কেএমটি। বর্তমানে এই দলকে বেশ সক্রিয় হিসেবে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এসবের পরেও চীনের সঙ্গে কেএমটির মিতালি নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়! নির্বাচনে জিতলে কেএমটি যে বেইজিংয়ের পক্ষে কাজ করবে, এমন সন্দেহ থেকেই যায়। এই অবস্থায় বাইডেন প্রশাসনের মনে রাখা দরকার, তাইওয়ানকে রক্ষার কথা আমেরিকার মুখ থেকে প্রকাশ্যে না বলাই ভালো। এর কারণ, তাইওয়ানের ভেতরের অনেক পক্ষই হয়তো চায় না তাইওয়ান স্থিতিশীল হোক, মুক্ত-স্বাধীন হোক!
আমার এ ধরনের দাবির পক্ষে যুক্তি আছে বইকি। সপ্তাহখানেক আগে চীন সফর করলেন তাইওয়ানের প্রথম ও সাবেক প্রেসিডেন্ট মা ইং-জিউ। মা কেএমটির সবচেয়ে সিনিয়র নেতা। তাইওয়ানের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে মার বেইজিংয়ে ছুটে যাওয়ার অর্থ কী? সাই যখন আমেরিকায়, মা তখন চীনে—কী বোঝা যায় এ থেকে? অনেকের স্মরণে থাকার কথা, একদা মার কণ্ঠে শোনা গিয়েছিল, ‘আমেরিকানদের কখনোই তাইওয়ানের জন্য লড়াই করতে ডেকে আনা ঠিক হবে না।’ মা এমনও বলেছিলেন, ‘তাইওয়ান প্রণালির দুই পাশের বাসিন্দারা চীনা জনগণ।’ মার যে কথা সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ তা হলো, ‘আমরা আন্তরিকভাবে আশা করি, দুই পক্ষ (চীন-তাইওয়ান) শান্তির জন্য যুদ্ধের পথ থেকে সরে এসে চীনের পুনরুজ্জীবনের স্বার্থে একসঙ্গে কাজ করবে।’ সত্যি বলতে, মার এ কথার প্রথম অংশকে প্রশংসা করতেই হয়—‘যুদ্ধের পথ থেকে সরে আসতে হবে’। কিন্তু মা যখন বলেন, ‘আমরা সবাই চাইনিজ’, তখন তো মহা বিপত্তির উদয় হওয়াটা অবান্তর নয়! যে দ্বীপের ৬০ শতাংশেরও বেশি মানুষ তাইওয়ানিজ, সেখানে মার এ ধরনের কথা বলার ভিত্তি ও যৌক্তিকতা কতটুকু?
তাইপে টাইমসের একটি সম্পাদকীয়তে মার চীন সফরকে ‘পশ্চাদগামী পদক্ষেপ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। উক্ত লেখায় সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে এই বলে, ‘সাবেক নেতার এই চীন সফর তাইওয়ানের বৈধতার দাবিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেবে। তাইওয়ানের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার রসদ জোগাবে।’ যা হোক, তাইওয়ান নিয়ে উত্তেজনা বাড়ছেই। এই উত্তেজনা অনেক বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠছে তাইপেকে রক্ষার প্রশ্নে মার্কিন গ্যারান্টি সম্পর্কে ক্রমাগত বিভ্রান্তির কারণে—এই দাবিকে পাশ কাটানোর সুযোগ কম। ইউএস কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড হাস এক নিবন্ধে ইতিমধ্যে সতর্ক করে বলেছেন, ‘তাইওয়ান নিয়ে আমেরিকার কৌশলগত অস্পষ্টতার কারণে ভ্লাদিমির পুতিনের মতো শিও ভুল রাস্তায় হাঁটতে পারেন! এক্ষেত্রে যুদ্ধের ঝুঁকি এড়ানোর সর্বোত্তম উপায় হবে চীনের উদ্দেশে আমেরিকার স্পষ্ট করে বলা যে, তাইওয়ানে কোনো ধরনের আক্রমণ চালানো হলে তার জবাবে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ, সামরিক শক্তি প্রয়োগসহ কঠোর অবস্থানে যেতে বাধ্য হবে যুক্তরাষ্ট্র।’ হাস নিবন্ধের শেষে লিখেছেন, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা—‘তাইওয়ানে শান্তির পতাকা ওড়ার ক্ষেত্রে কেবল আমেরিকার কঠোর অবস্থানই সমাধানের রাস্তা নয়, বরং এক্ষেত্রে অনেক বেশি জরুরি হলো সহনশীল রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, সংযম ও সমঝোতা, যা আজকের দিনে বড়ই অপ্রতুল!