তিন দিনব্যাপী ‘জয়েন্ট সোর্ড’ মহড়া শেষ করেছে চীন। যুদ্ধজাহাজ ও যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে কীভাবে তাইওয়ানকে ঘিরে ফেলা হবে, চীনের সামরিক বাহিনীকে সে ধরনের অনুশীলনে দেখা গেল এই মহড়ায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের মহড়া উদ্বেগজনক। এর ফলে ‘সামরিক ঝুঁকি’ বেড়ে যায় স্বাভাবিকভাবেই। বাস্তব চিত্রও বলছে সে কথাই। বেইজিং-তাইপে উত্তেজনা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশি। উভয় পক্ষের পালটাপালটি বিবৃতি পরিস্থিতিকে বেশ উত্তপ্ত করে তুলেছে। মনে থাকার কথা, এর আগেও একই ধরনের বড় মহড়ার আয়োজন করে চীন। অর্থাৎ, এক বছরেরও কম সময়ের ব্যবধানে তাইওয়ানের চারপাশে দ্বিতীয় বারের মতো সামরিক মহড়া চালাতে দেখা গেল চীনের সামরিক বাহিনীকে। বলা বাহুল্য, এভাবে সামরিক শক্তি প্রদর্শন এই অঞ্চল তো বটেই, বিশ্বের জন্যও উদ্বেগের বড় কারণ হয়ে উঠছে।
এবারের মহড়ায় তাইওয়ান প্রণালি ঘিরে গর্জে ওঠে কয়েক ডজন চীনা সামরিক বিমান। চীনা ফাইটার জেট ও নৌজাহাজগুলো তাইওয়ান দ্বীপ ও এর আশপাশে চষে বেড়ায়। এমনকি মহড়া শেষ হওয়ার পরও চীনের সেনাবাহিনীকে তাইওয়ান দ্বীপ ঘিরে রাখতে দেখা যায়। দ্বীপের চারপাশে টহল দিতে থাকে চীনের ৯টি যুদ্ধজাহাজ ও জে-১৬ এবং এসইউ-৩০ যুদ্ধবিমানসহ ২৬টির মতো ফাইটার জেট। স্বভাবতই চীনের এই মহড়ার পর তীব্র প্রতিক্রিয়া এসেছে তাইওয়ান থেকে। তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন একে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ড’ হিসেবে অবিহিত করে একাধিক বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতি এসেছে চীনের তরফ থেকেও। চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) প্রকৃত যুদ্ধ পরিস্থিতিতে দ্বীপটিকে ঘেরাও করার মহড়ার অনুশীলন করেছে মাত্র।’ এ ঘটনার পর মন্তব্য এসেছে বিশ্লেষক মহল থেকেও। তারা বলছেন, ‘চীনের সামরিক বাহিনী তাইওয়ান ঘিরে বড় পরিসরে যে ধরনের মহড়া প্রদর্শন করল, তাতে করে এই দ্বীপের ওপর আক্রমণের আশঙ্কা আরো বেড়ে গেল। এর মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে শাসিত তাইওয়ান বড় ধরনের হুমকির মুখে উপনীত।’ বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এই অবস্থায় বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত তাইওয়ানের।
সামরিক বিশেষজ্ঞদের দাবি, তাইওয়ান প্রণালির বিভিন্ন অংশ জুড়ে ‘লাইভ-ফায়ার ড্রিল’-এর মাধ্যমে প্রধানত নিজের ‘ফায়ার পাওয়ার’ দেখাতে চায় চীন। সেই উপলক্ষ্য এনে দেয় প্রেসিডেন্ট সাইয়ের সাম্প্রতিক লাতিন আমেরিকা সফর। তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ স্পিকার কেভিন ম্যাকার্থির মধ্যকার সাম্প্রতিক বৈঠকের প্রতিক্রিয়া জানাতে একটুও দেরি করেন না চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং। শুরু করেন ‘জয়েন্ট সোর্ড’ নামে তিন দিনব্যাপী ‘লাইভ-ফায়ার ড্রিল’।
উল্লেখ করা দরকার, চীনের সামরিক বাহিনীকে গত বছরও (আগস্ট মাসে) বড় ধরনের সামরিক মহড়া চালাতে দেখা যায় তাইওয়ান প্রণালি ঘিরে। সেবারকার কারণ ছিল সাবেক মার্কিন হাউজ স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর। এখন প্রশ্ন হলো, কোনো অজুহাত খুঁজে পেলেই এই অঞ্চলে চীন সামরিক মহড়া চালাতে মরিয়া হয়ে উঠছে কেন? এর স্পষ্ট উত্তর হলো, এই অঞ্চলে তাইওয়ান কিংবা বাইরের শক্তির সামরিক শক্তিমত্তা দুর্বল, খর্ব করাই চীনের আসল উদ্দেশ্য। তাইওয়ানের ‘ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি রিসার্চ (আইএনডিআর)’-এর বিশ্লেষক জু-ইয়ুন সু যেমনটা বলেছেন, ‘এই অঞ্চলে বিপরীত পক্ষের সামরিক প্রভাব কমানোর চিন্তা থেকেই মূলত গত বছরের আগস্টের মতো সামরিক মহড়ার পরিকল্পনা করে বেইজিং।’ বিশ্লেষক জু-ইয়ুন সুর কথার সঙ্গে সহমত পোষণ করেন ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’-এর জ্যেষ্ঠ চীন বিশ্লেষক আমান্ডা সিয়াও। সিয়াও মনে করেন, ‘বেইজিংয়ের বিশ্বাস, যুক্তরাষ্ট্র ও তাইওয়ানকে ভবিষ্যতে আরো উচ্চপর্যায়ের বিনিময় ও সহযোগিতা থেকে নিবৃত্ত করতে সামরিক শক্তি প্রদর্শনের পথে হাঁটাই সবচেয়ে ফলপ্রসূ হবে।’ অর্থাৎ, ধরে নিতে হবে, চীন ভেবেচিন্তেই মহড়ায় নেমেছে।
চীনের এই মহড়ার পর বেইজিং-তাইপে উত্তেজনার ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা চলছে। তাইওয়ান ইস্যুর ভবিষ্যৎ নিয়েও চলছে হিসাব কষাকষি। তবে এ বিষয়ে কিছু বলার আগে আমলে নিতে হবে উভয় পক্ষের মহড়া-পরবর্তী প্রতিক্রিয়া, বিবৃতি, মন্তব্য। তাইওয়ান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বড় আকারের এই সামরিক মহড়ার নিন্দা করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর সব পক্ষকে সংযম থাকার আহ্বান জানিয়েছে। প্রেসিডেন্ট শির কর্তৃত্ববাদী সম্প্রসারণের মুখেও ওয়াশিংটনসহ অন্যান্য সমমনা দেশের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই। অন্যদিকে, এক বিবৃতিতে পিএলএ বলেছে, ‘চীনের সেনারা লড়াইয়ের জন্য সব সময় প্রস্তুত। বিচ্ছিন্নতাবাদ বা বিদেশি হস্তক্ষেপ—যেভাবেই তাইওয়ানের স্বাধীনতার চেষ্টা করা হোক না কেন, তা তারা রুখে দেবেন।’ অর্থাৎ, সব মিলিয়ে বলা যায়, তাইওয়ান ইস্যুর উত্তাপ সহজেই কাটছে না!
কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, তাইপে ও ওয়াশিংটন যেন ভবিষ্যতে আরো বড় পরিসরে দ্বিপক্ষীয় আদান-প্রদান করতে না পারে—এমন চিন্তা থেকে তো বটেই, পাশাপাশি তাইওয়ান ঘিরে মহড়া চালানোর মাধ্যমে চীন এই বার্তা দিতে চায় যে, তাইওয়ানকে দখলে নিতে চীনের সামরিক বাহিনীকে একদমই বেগ পেতে হবে না। মার্কিন নিরাপত্তা বিশ্লেষক বেন লুইসের মতে, ‘তাইওয়ান প্রণালিতে প্রথম দিকে যুদ্ধজাহাজ পরিদর্শনের মতো তুলনামূলক কম উসকানিমূলক পদক্ষেপ নিলেও ক্রমশ বৃহত্তর সামরিক মহড়া শুরু করে বেইজিং। একে হালকা করে দেখার কোনো কারণ নেই। লক্ষণীয়, সাই-ম্যাকার্থি বৈঠকের প্রতিক্রিয়া হিসেবে চীন মহড়া শুরু করে। এর মধ্যেই ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ও ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেইন বেইজিং সফর করেন। মূলত এর পরপরই বড় আকারে মহড়ার আয়োজন করে বেইজিং, যা বেশ উদ্বেগজনক বটে! তাইওয়ানকে চাপে রাখার জন্যই এই মহড়া, নাকি অন্য কিছু?’
পিএলএর মুখপাত্র শি ইয়িন তিন দিনের এই সামরিক মহড়াকে বর্ণনা করেছেন ‘তাইওয়ানের স্বাধীনতা লাভের চেষ্টা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী ও বহিরাগত শক্তির মধ্যকার যোগসাজশ ও উসকানিমূলক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবার্তা’ হিসেবে। পিএলএর মুখপাত্রের এ ধরনের চিন্তাকেও কি ছোট করে দেখার অবকাশ আছে? ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’-এর জ্যেষ্ঠ চীন বিশ্লেষক আমান্ডা সিয়াও বলছেন একই কথা। তিনি মনে করেন, ‘তাইওয়ান প্রণালিতে এভাবে বিপুলসংখ্যক চীনা সামরিক বিমানের উপস্থিতি—যেমনটা দেখা গেছে এবারের মহড়ায়—এই অঞ্চলে সংঘাতের আশঙ্কাকে বহুগুণে বাড়িয়ে তুলছে। এই অবস্থায় কোনো একটি পক্ষের ভুলে চীন-তাইওয়ান সংঘর্ষ বৃহৎ আকার ধারণ করার বিষয়কে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’
যা হোক, এখন দেখার বিষয়, এই অঞ্চলে ভবিষ্যতে আরো কী কী ঘটতে পারে। উভয় পক্ষের কৌশলগত ব্যবস্থাই বা কী হতে চলেছে আগামী দিনে। যেহেতু তাইওয়ান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ, সম্পৃক্ততার বিষয়ে ঘোর আপত্তি জানিয়ে আসছে বেইজিং, সেক্ষেত্রে কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই অঞ্চলে চীনের সামরিক সক্ষমতা প্রদর্শনের আয়োজন বাড়তেই থাকবে। এর ফলে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক লুইস বলেছেন, ‘শি জিনপিং তাইওয়ান ইস্যুকে খুব সাদামাটাভাবে উপস্থাপন করে চলেছেন—এটা চীনের ভূখণ্ডের অংশ। শির সোজাসাপটা চাওয়া হলো, চীনের সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে একীভূত হোক তাইওয়ান, তা না হলে আক্রমণ করে এই দ্বীপ নিজের দখলে নেবে বেইজিং।’
একটি বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি। যখনই তাইপের ওয়াশিংটনের কাছাকাছি হওয়া দৃশ্যমান হচ্ছে, তখনই তাইওয়ান প্রণালির জলরাশিতে চক্কর কাটতে দেখা যাচ্ছে চীনের সামরিক জাহাজকে। অর্থাৎ, তাইওয়ান-যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি হওয়াকে একদমই ভালোভাবে গ্রহণ করছে না চীন। এ দুই মিত্রের নেতাদের এক টেবিলে দেখলেই বিগড়ে যাচ্ছেন শি! আক্রমণাত্মক প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেইজিংয়ের ‘নেকড়ে যোদ্ধা’ মনোভাব প্রকাশ্য হতে দেখা যাচ্ছে! এ প্রসঙ্গে ইউএস হাউজ ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির চেয়ারপারসন মাইকেল ম্যাককাল বলেছেন, ‘চীনের এভাবে তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে ওয়াশিংটনের নেতিবাচক চিন্তাকে প্রগাঢ় করবে।
এই যখন অবস্থা, তখন তাইওয়ান সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে কী করা যেতে পারে? বস্তুত, এটাই আজকের দিনে কোটি টাকার প্রশ্ন। নিরাপত্তা বিশ্লেষক লুইস মনে করেন, এক্ষেত্রে তাইওয়ানের পক্ষে আরো সরব হতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। তাইওয়ানের জন্য জনসমর্থন গড়ে তুলতে এবং তাইওয়ানের বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বৈঠক ফলপ্রসূ করতে সাহায্য করতে পারে মার্কিন কংগ্রেস। কংগ্রেসের উচিত হবে তাইওয়ানের প্রয়োজনীয়তাগুলোর দিকে বিশেষভাবে নজর দেওয়া; ২০২৩ সালের জাতীয় প্রতিরক্ষা অনুমোদন আইনে ইতিমধ্যে যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে তাইওয়ানের জন্য, তা ব্যবহার করা।’ বাস্তবতা হলো, ‘তাইওয়ান সমস্যা’ নিয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাবার সময় এসেছে তাইওয়ান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের জন্যই।