৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। ১৯৮৭ সাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিবসটি উদযাপন করা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২৩ সালে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘‘We need food : not tobacco’’ বাংলা ভাবানুবাদ করা হয়েছে ‘তামাক নয়, খাদ্য ফলান’।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১ লাখ ৮ হাজার হেক্টর কৃষিজমিতে তামাক চাষ হচ্ছে, যা দেশের খাদ্য উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে এবং এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে খাদ্যসংকট তৈরি করতে পারে। তামাক চাষ মাটির উর্ব্বরশক্তি হ্রাস করে, যেটা সর্বজনস্বীকৃত। এমনকি কৃষকও সেটা জানে। তামাক চাষের কারণে খাদ্যশস্য চাষের জমি কমে যাচ্ছে। দেখা যায়, দেশের যেসব জেলায় তামাক চাষ হয়, সেখানে পুষ্টিকর খাদ্যের সংকট রয়েছে। পরিবেশ, প্রাণিকুলেও তামাক চাষের বিরূপ প্রভাব দেখা যাচ্ছে। তামাক পোড়ানোর ফলে বাংলাদেশে ৩০ শতাংশ বন উজাড় হচ্ছে। পার্বত্য এলাকায় তামাক চাষ ও প্রক্রিয়াজাতের কারণে বনভূমি উজাড় হচ্ছে। শুধু তামাক প্রক্রিয়াজাত করতে প্রতি বছর ২৯ লাখ ৩২ হাজার গাছ পোড়ানো হয়। এক একর জমিতে যে পরিমাণ তামাক উৎপন্ন হয়, এটি শুকানোর জন্য প্রয়োজন প্রায় পাঁচ টন কাঠ। উপরন্তু, তামাক চাষে ব্যবহৃত কীটনাশক ও রাসায়নিক জীববৈচিত্র্য, প্রাণিচক্রের ক্ষতিসাধন করেছে। তামাক চাষপ্রবণ এলাকায় মানুষের মধ্যে বিশেষত, গর্ভবতীদের নানাবিধ স্বাস্থ্যগত সমস্যা, প্রতিবন্ধী, বিকলাঙ্গ সন্তান জন্ম দেয়। ঐ সমস্ত এলাকায় প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী বেশি হয়ে থাকে। কারণ তামাক চাষ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে নারী-শিশুরা জড়িত থাকে।
বৈশ্বিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, তামাক চাষ সারা পৃথিবীর ২-৪ শতাংশ বন উজাড়ের জন্য দায়ী। ২০১৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল কোস্টাল ক্লিন -আপ বাংলাদেশসহ ৯২টি দেশের সাগর থেকে যে বর্জ্য সংগ্রহ করে, তার মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে সিগারেট ফিল্টার। তামাক চাষের পরিমাণ জমি তৈরিতে প্রচুর বনাঞ্চল ধ্বংস করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, ১৯৭০ সাল থেকে তামাকের কারণে বিশ্বব্যাপী (গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে) আনুমানিক ১.৫ বিলিয়ন হেক্টর বন বিলুপ্ত হয়ে গেছে, যা ২০ শতাংশ বার্ষিক গ্রিনহাউজ গ্যাস বৃদ্ধির প্রধান কারণ!
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, জলবায়ু পরিবর্তন, দ্রুত নগরায়ণ, রাশিয়া -ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিভিন্ন কারণে এ বছরের প্রতিপাদ্যটি যথার্থ। কারণ, ‘খাদ্য দ্রব্য’ যে কোনো সময়ে জীবন বাঁচাতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে যেন এটি দুষ্প্রাপ্য হতে চলেছে। টাকা, ডলার, পাউন্ড পকেটে নিয়ে ঘুরতে হবে, খাদ্য মিলবে না! হতে পারে এমন দিন আসন্ন। তাই কৃষকদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত এবং বিকল্প ফসল উৎপাদনে উৎসাহিত করার মাধ্যমে তামাক চাষ থেকে ফিরিয়ে আনতে আশু পদক্ষেপ নিতে হবে। তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে ইতিমধ্যে আপিল বিভাগ থেকে নির্দেশনা রয়েছে, সেটা অনুসরণ জরুরি। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারা-১২তে তামাক উৎপাদন নিয়ন্ত্রণে, বিশেষত তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করতে একটি নীতি প্রণয়নের নির্দেশনা রয়েছে। যত দূর জানা যায়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে একটি খসড়া নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। সময়ের প্রয়োজনে নীতিটি চূড়ান্ত করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেশে তামাক চাষ নির্মূল অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে ‘সাউথ এশিয়ান স্পিকার্স সামিট’ ঘোষণায় বলেন, ‘আমরা ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাকের ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করতে চাই।’ তামাক নিয়ন্ত্রণ শুধু এককভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়, এক্ষেত্রে সবাইকে নিজ নিজ অধিক্ষেত্র থেকে কাজ করতে হবে। তবেই এই সমন্বিত কাজগুলো ফলপ্রসূ হতে পারে। এই লক্ষ্যে কিছু বিষয়ে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। যেমন—দেশে তামাক ব্যবহার নির্মূল তথা ০৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে বিদ্যমান ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন’ প্রণয়নসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে আইনটি যুগোপযোগী করা প্রয়োজন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এফসিটিসির আলোকে আইন সংশোধনে ইতিমধ্যে নির্দেশনা দিয়েছেন। আইনের দুর্বলতা এবং আইন বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূরীকরণে কয়েকটি বিষয়ে সংশোধনী উল্লেখযোগ্য : ১. আইনে উল্লেখিত পাবলিক প্লেস, পরিবহনের আওতা বৃদ্ধি ও সব তামাকজাত দ্রব্য সেবন নিষিদ্ধ, আইন অমান্যে জরিমানা বৃদ্ধি এবং এসব স্থানে আলাদাভাবে ‘ধূমপানের স্থান’ না রাখা। ২. খোলা ও খুচরা এবং ভ্রাম্যমাণ তামাক বিক্রি নিষিদ্ধ করা। ৩. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের দোকান না রাখা। ৪. তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ে লাইসেন্স গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা। ৫. ই-সিগারেট বা ভেপিংয়ের আমদানি, উৎপাদন, বিক্রয়, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা ইত্যাদি।
আইনটি শক্তিশালী করা হলে দেশের মধ্যবয়সী ও তরুণদের মধ্যে তামাক ব্যবহার বহুলাংশে কমে আসবে, যাতে তামাকজনিত রোগ ও অকালমৃত্যু হ্রাস পাবে। পুরোনো যেসব আইন, নীতি, অধ্যাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণের সমস্যা সৃষ্টি করে এমন বিষয় সন্নিবেশিত রয়েছে, সেগুলো সংস্কারের মাধ্যমে যুগোপযোগী করতে হবে। ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে তামাকজাত দ্রব্যে ১ শতাংশ হারে স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ আরোপ ও ২০১৭ সালে এসংক্রান্ত নীতি প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু দেশে ‘জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি’ প্রণয়ন করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর তামাকমুক্ত বাংলাদেশ ঘোষণা বাস্তবায়নে ‘রোডম্যাপ’ প্রণয়ন এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি অধিকতর গতিশীল ও সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে ‘জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।