দেশে রাজনীতির উত্তাপ আকস্মিকই কমে গেছে। বিএনপির তর্জন-গর্জন আপাতত স্তিমিত। কিন্তু প্রকৃতি অকাতরে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। অসহনীয় গরম চলছে তো চলছেই। যদিও প্রকৃতিতে এখন চলছে শরৎকাল।
অতীতে শরৎ ছিল অবকাশ যাপন, তালের পিঠা ও পাগলা হাওয়ার ঢেউ খেলানো কাশবনের ঋতু। পাকা তালের মোহনীয় ঘ্রাণ যেন পূর্বাহ্নেই এর আগমনিবার্তা সগৌরবে প্রচার করে। আহ্নিক গতির প্রভাবে বাংলা-প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চের ভোরের পর্দা সরিয়ে সূর্যোদয়ের মতোই হাজির হলো বঙ্গাব্দের পঞ্চম তনয়া। লোকজ ভাষায় যার আরেক নাম ‘ভাদ্দর’।
‘তালপাকা গরম আর মোলায়েম সফেদ কাশফুল এ মাসের সমার্থক। সময়ের আবর্তে আশ্বিনের অগ্রজের কাঙ্ক্ষিত উপস্থিতি। এর চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য কালিমাখা মেঘ নীল আকাশের সীমানা থেকে পালাই পালাই করে। পানিহারা পেঁজা পেঁজা মেঘের টুকরো ইতস্তত ঘুরে বেড়ায়। অবিরাম বর্ষণের ঝমঝম শব্দ থাকে না। সূর্যরশ্মির খরতায় অসহনীয় গরম বিরাজ করে সর্বত্র। বৃক্ষমুণ্ডের তালগুলো পেকে কালচে লাল রং ধারণ করে। জর্দারঙ্গা শিউলি ফুল ফোটে দেহে স্নিগ্ধতার আমেজ মেখে। নদীর কূলে কূলে কাশবনের মায়াবী আমন্ত্রণ। দুরন্ত শিশু-কিশোরের দল সে আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে দস্যিপনায় মেতে ওঠে। তবে এবার বর্ষা পুরোমাত্রায় না হওয়ায় কাশবনও যেন অন্যরকম অভিমান করেছে!
সাধারণত বাংলা বছরের প্রথম পাঁচ মাস একত্রিশ দিনের হয়ে থাকে। পঞ্জিকা বিশারদদের হিসাব অনুযায়ী ভাদ্র পঞ্চম একত্রিশা মাস। বলা বাহুল্য, অধিবর্ষে ফাল্গুন মাস একত্রিশ দিনের হয়ে থাকে। ভাদ্রপাদ তারার নামে ভাদ্র মাসের নামকরণ করেছেন পণ্ডিতরা। এ মাসে শুক্র একাদশীতে ‘পাশ মোড়া’ নামক ধর্মীয় আচার পালন করে হিন্দু সম্প্রদায়। ধর্মানুষ্ঠানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগ থাকা সত্ত্বেও এটি প্রধানত আনন্দ উপভোগের উপলক্ষ্য হিসেবেই লোকের কাছে সমাদৃত। শুধু যে হিন্দুরাই উৎসব পালন করে, তা নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানসহ অপরাপর অমুসলমানরাও ভাদ্রের তালের পিঠা খাওয়ার খুশিতে উৎসবে মেতে ওঠে। এছাড়া পেয়ারা, আনারস, চালতা, জাম্বুরা, আমড়া, উড়িগাব ইত্যাদি এ উৎসবে নতুন মাত্রা যোগ করে।
তবে অসহনীয় ভ্যাপসা গরম ভাদ্র মাসের চরিত্রে যেন স্থায়ী কালিমা লেপন করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রতি বিএনপির যেমন অভিযোগের কোনো শেষ নেই, ভাদ্রকে নিয়ে আধুনিক মানুষেরও অভিযোগের কোনো শেষ নেই। কথায় আছে ভাদ্রের গরমে তাল পাকে। তাল নিয়ে মানুষের খুব একটা আগ্রহ নেই। তালের পিঠার বাজারদরও খুব বেশি আছে বলে মনে হয় না। তবে এই গরমে সবার বেতাল অবস্থা। ভাদ্র মাস শুরু হওয়ার পর থেকেই প্রচণ্ড গরমে জনজীবন প্রায় ওষ্ঠাগত। ভাদ্র পেরিয়ে আশ্বিন এলেও প্রখর রৌদ্রের উত্তাপ একটু কমেনি। জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্যের সঙ্গে সঙ্গে এই উত্তাপ দেশবাসীকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে লোডশেডিং।
ভাদ্র-আশ্বিন মাসের গরম প্রাচীনকাল থেকেই সুবিখ্যাত। এই গরমে মানুষ তো বটেই, কুকুর পর্যন্ত বেতাল হয়ে পড়ে। কুকুরের আচরণে বিরাট পরিবর্তন আসে। এ মাসে কুকুর সমাজের একটা বড় অংশই গরমে দিশেহারা হয়ে প্রায় পাগল হয়ে যায়। মানুষ সতর্ক হয়। গ্রামগঞ্জে এখনো কুকুর দেখে গরমের তীব্রতা অনুমান করা হয়। মাঝেমধ্যে দেখা যায় কোনো জলাশয়ে কুকুর নেমে পড়লে ছেলেমেয়েরা সেই জলাশয়ে গোসল করতে নামতে ভয় পায়। তখন দুষ্ট বালক-বালিকার দল ঢিল ছুড়ে মেরে কুকুরটাকে দূরে সরাতে চেষ্টা করে। কিন্তু কুকুর অনমনীয়। নড়াচড়ার কোনো নামই নেয় না! ভাদ্র-আশ্বিনের গরম বলে কথা!
ভাদ্র ও আশ্বিন মাস দুটো আসলে বিরক্তিকর একটা কাল। ভাদ্র মানেই বেড়াজাল শুভ কাজ নাস্তি, পায়ে পায়ে বাধা-বারণ। কবিরা পর্যন্ত এই মাসটাকে উপেক্ষা দেখানোর চেষ্টা করেছেন। তবু এর অন্য রূপও আছে। ভাদ্র বাদ দিয়ে যখন আমরা ভাদর উচ্চারণ করি তখনই ছলোছলো একাকিত্ব, টইটম্বুর বিরহ আর অব্যক্ত ছটফটানি এসে ভিড় করে। এমন ধারা কেন?
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর…। চন্দননগরে মোরান সাহেবের বাগানবাড়িতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী কাদম্বরী এক ঝড়বৃষ্টির দিনে তার অন্তরঙ্গ দেবর রবিকে বিদ্যাপতির এই লাইনটিতে সুর বসাতে অনুরোধ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাত্ক্ষণিকভাবে তাতে মিশ্র মল্লারের সুর দিয়ে গাইতে শুরু করেন। বিদ্যাপতির প্রভাবে রবি তখন হয়েছেন ভানুসিংহ, রচিত হচ্ছে অপূর্ব সুন্দর ভানুসিংহের পদাবলি। আমাদের সংস্কৃতির ইতিহাসে এ এক বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
আমরা আগে শুনতাম, ‘ধারার শ্রাবণ, পচা ভাদ্র’, অর্থাত্ শ্রাবণ মাসে বৃষ্টি হয় জোরালো, ভাদ্র মাসে টিপ টিপ, সেই জন্য ভ্যাপসা গরমও চলে। কিন্তু আবহাওয়া এখন অনেক পালটেছে, কোনো কোনো ভাদ্র মাসেও প্রবল বৃষ্টির তোড়ে নদীনালা উপচে ওঠে, কোথাও কোথাও বন্যা হয়।
খুব সম্ভবত ‘চরিত্রদোষের’ কারণেই শরৎকাল হিসেবে আশ্বিন যতটা মান্যতা পেয়েছে, ভাদ্র তেমন পায়নি। নামটাও কেমন কর্কশ। এ কারণেই কি ছোট ভাইয়ের স্ত্রীকে ভাদ্রবধূ বা ভাদ্দর-বউ বলে? কবিরাও এই মাসের উল্লেখ এড়িয়ে যান। রবীন্দ্রনাথ অজস্র বর্ষার গান লিখেছেন, আষাঢ় ও শ্রাবণের উল্লেখ অজস্র, তার পরই ভাদ্রকে টপকে চলে গেছেন আশ্বিনে। যেন তিনি এই মাসের ভাশুর! যত দূর মনে পড়ে, তার একটিমাত্র গানে এই রকম আছে, ‘আজ বারি ঝরে ঝর ঝর ভরা ভাদরে’। এখানেও তিনি বিদ্যাপতির মতন ভাদ্রকে ভেঙে ভাদর করেছেন। তিনি ঐ মাসটির প্রতি সেই প্রথম যৌবনের পর আর তেমন মন দেননি, এ কথা বলা যেতেই পারে।
আমাদের দেশের রাজনীতি ভাদ্রের প্রথমে কিছুটা তেতে উঠলেও এখন আবার নেতিয়ে পড়েছে। বিএনপি সমাবেশ-ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি দিয়ে রাজনীতিতে কিছুটা উত্তাপ ফিরিয়ে এনেছিল। এখন আবার চলছে ভাটা। নির্বাচনের আগে ‘গণ-অভ্যুত্থান’ সৃষ্টির মাধ্যমে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারকে ক্ষমতা থেকে হঠানোর আওয়াজ ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে।
ক্ষমতাসীনরা যেমন প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না, এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিরোধী দলও আপাতত আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তুলতে ব্যর্থ! রাজনীতি নিয়ে মানুষের মধ্যে কোনো সন্তোষ নেই। রাজনীতি, অর্থনীতি এমনকি খেলা, সবকিছু নিয়েই একটা হতাশা কাজ করছে। মানুষের প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তবের তেমন কোনো সংগতি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যদিও মানুষের মন কখনো কোনো কিছুতে তৃপ্ত বা সন্তুষ্ট হয় না। সবার মনের মধ্যে সারাক্ষণ একটা দীর্ঘশ্বাস—আহা! আমার যদি এটা থাকত। আহা! আমার যদি ওটা হতো। এই এটা-ওটা-সেটার চিন্তাতেই মানুষের জীবন কেটে যায়; কোনো না কোনো অভাব বা অতৃপ্তি নিয়েই মানুষকে চিতা কিংবা কবরে যেতে হয়। মানুষের চাহিদা অসীম হলেও সবার চাহিদা বা অভাব এক রকম নয়। আমাদের সমাজে মানুষ যেমন বিচিত্র, বিভিন্ন মানুষের অভাব বা চাহিদাও তেমনি বিচিত্র। তবে কেউই অল্পে তুষ্ট হয় না বা হতে চায় না। একজন নিরন্ন মানুষকে তার চাহিদার কথা জিগ্যেস করলে বলবে, দুই বেলা দুই মুঠো খাবার পেলেই সে সন্তুষ্ট। তার এই চাহিদা পূরণ করুন, এরপর সে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই চাইবে। সেটা পূরণ হলে চাইবে একটু মোটা কাপড়ের ব্যবস্থা। এই চাহিদা পূরণ হলে সে চাইবে একটু বিনোদনের ব্যবস্থা। এভাবে এক পর্যায়ে মোটা ভাত, মোটা কাপড় ও মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের দাবি ত্যাগ করে ক্রমেই সে ভালো পুষ্টিকর খাবার, আরামদায়ক থাকার ব্যবস্থা, আকর্ষণীয় পোশাকের দাবি তুলবে। তার দাবি ও চাহিদা ক্রমাগত বাড়তেই থাকবে। মানুষের চাহিদার কোনো শেষ নেই। আর যে যত বেশি পায় সে তত বেশি চায়। প্রেমবঞ্চিত কোনো যুবককে তার চাহিদার কথা বললে, সে প্রথমেই একজন প্রেয়সী চাইবে। এরপর সে চাইবে একজন স্ত্রী। স্ত্রীর অভাব পূরণ করা হলে সে হয়তো চাইবে পরকীয়া। এরপর আরো আরো কিছু!…
প্রকৃতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেও আমাদের চাহিদার কোনো শেষ নেই!
প্রবল বর্ষণের আশা আপাতত শেষ, গরমে সেদ্ধ হতে হতে সবাই এখন শীতের প্রত্যাশা করছে।
কী আর করা! মাত্র তো আর কটা দিন!