শ্রাবণের আকাশে মেঘ নেই, আছে সূর্যের চোখ রাঙানি। মেঘমুক্ত আকাশে বাতাসের আদ্রতা বেড়ে যাওয়ায় মাঠেঘাটে ঠাঠা রোদ। দুর্বিষহ গরমে হাঁপিয়ে উঠছে সবাই। বাংলা বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী এখন তুমুল বৃষ্টির সময়। অথচ দেশের বেশিরভাগ এলাকাজুড়ে বয়ে যাচ্ছে মৃদু ও মাঝারি তাপপ্রবাহ। অসহনীয় তাপ আগুনের হল্কা হয়ে বিঁধছে শরীরে। গরমে নাজেহাল জনজীবন। হাসপাতালে শিশু রোগীদের ভিড় বাড়ছে। বৃষ্টির পানির অভাবে আমন ধান রোপণ পিছিয়ে যাচ্ছে এবং পাট জাগ দিতে পারছেন না কৃষক। গরমে রাজধানী ঢাকা যেন হয়ে উঠছে জ্বলন্ত কড়াই। ঘর থেকে বের হলেই লু হাওয়া এসে গায়ে জ্বালা ধরাচ্ছে। সূর্য ডোবার পরও শীতল হচ্ছে না চারপাশ। রাজধানীর ফ্ল্যাটগুলোর ভেতরে ভ্যাপসা গরম। কংক্রিটের তৈরি সড়ক আর যানবাহনের গরম বাতাস তাপমাত্রা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। অন্য এলাকার চেয়ে ঢাকার তাপমাত্রা গড়ে চার থেকে ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি অনুভূত হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার। এসব যন্ত্রের ব্যবহার যতই বাড়ছে, ভবনের বাইরের এলাকার তাপমাত্রা ততই বাড়ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য টাইলস ও কাচের ভবনকেও দায়ী করা হয়। আবহাওয়া বিভাগের হিসাবে গত ২৭ বছরে দেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায় রাজধানীর তাপমাত্রা চার গুণের বেশি বেড়েছে। ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের ১০ জেলায় বয়ে যাচ্ছে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ। তীব্র গরমে রোগী বেড়েছে রাজধানীর শিশু হাসপাতালগুলোতে। তাদের বেশিরভাগই ঠান্ডা জ্বর, বমি ও পেটের সমস্যায় ভুগছে। চিকিৎসকরা বলছেন, গরমে ঘেমে গলাব্যথা, বমি ও জ্বরের রোগী আসছে বেশি। বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালে প্রতিদিন প্রায় ৫০০ রোগী ভর্তি হয়। তবে গত তিন দিন ধরে বহির্বিভাগ ও ভর্তি রোগী মিলিয়ে সেবা নিতে এসেছে ৭৫০ থেকে ৭৬০ জন। তাদের বেশিরভাগই গরমজনতি রোগে অসুস্থ। চিকিৎসকরা বলছেন, শিশুর জ্বর, বমি, ডায়রিয়া ও গলাব্যথা হলে দেরি না করে অভিভাবকদের উচিত চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা। মিরপুর কালসী এলাকার বাসিন্দা ইব্রাহিম তার ছয় বছরের মেয়ে নার্গিসকে নিয়ে মিরপুর ইসলামিক ব্যাংক হাসপাতালে আসেন। গরমের কারণে তিনদিন ধরে মেয়েটি জ্বর ও ডায়রিয়ায় অসুস্থ বলে জানান তিনি। আবহাওয়া অধিদপ্তরের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান যায়যায়দিনকে জানান, এ বছর এপ্রিল থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত চার দফা তাপপ্রবাহ দেখা দিয়েছে। পাঁচ জুলাই থেকে শুরু হওয়া তাপপ্রবাহ ১৫ জুলাই অসহনীয় পর্যায় পৌঁছেছে। শুক্রবার রাজশাহীতে তাপমাত্রা ওঠে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। ঢাকা, টাঙ্গাইল, রাঙামাটি, কুমিলস্না, চাঁদপুর, ফেনী, চুয়াডাঙ্গা, রংপুর, রাজশাহী, সিলেটে দেখা দিয়েছে তাপপ্রবাহ। সারা দেশে গড়ে তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে। কিন্তু অনুভূত হচ্ছে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। আবহাওয়া বিজ্ঞান বলে, ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে তাপমাত্রা উঠলেই তাকে মাঝারি দাবদাহ বলে। জুলাইয়ের গত ১৫ দিন রীতিমতো খরাই যাচ্ছে। শুক্রবার রাতে ঢাকায় যৎসামান্য যে বৃষ্টি হয়েছে, তা স্বস্তি দিতে পারেনি নগরবাসীদের। শনিবার দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল সৈয়দপুরে ৩৯.০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, রাজশাহীতে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, তেঁতুলিয়ায় ৩৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, দিনাজপুরে ৩৭ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, রাজারহাটে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, টাঙ্গাইলে ৩৬ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, বগুড়ায় ৩৬ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সিলেটে ৩৬ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস, চুয়াডাঙ্গায় ৩৬ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ঢাকায় সর্বোচ্চ ৩৬ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিশ্বজুড়েও বৈরী আবহাওয়া এদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বজুড়েই বৈরী আচরণ করছে আবহাওয়া। তীব্র গরম আর দাবানলে হিমশিম খাচ্ছে ইউরোপের দেশগুলো। তীব্র গরমে পুড়ছে ইউরোপ, ভারত, চীনসহ বিশ্বের শতাধিক দেশ। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাজ্যে প্রথমবার জারি করা হয়েছে রেড অ্যালার্ট। এছাড়া দাবানলের চরম ভয়াবহতায় স্পেন ও পর্তুগালে শনিবার পর্যন্ত প্রাণ গেছে ২৮১ জনের। এর মধ্যে ২৩৮ জনেরই মৃতু্য হয়েছে পর্তুগালে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২৮ বছরে দাবানল ৩০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা করছে জাতিসংঘ। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডবিস্নউএমও) বলেছে, তাপপ্রবাহে শহর ও নগরগুলোর বাতাসের মান আরও খারাপ করতে পারে। ডবিস্নউএমওর বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা লোরেনেজো লাব্রাডোর শুক্রবার জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, স্থিতিশীল এবং স্থবির বায়মুন্ডল দূষণকারী কণা ও পদার্থ ঠেকাতে ঢাকনা হিসেবে কাজ করে। এর ফলে বাতাসের মান খারাপ হয়, যা জনস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী উষ্ণায়নের প্রভাব ২০৩০ সালে পড়ার কথা বলা হলেও বরং এখনই তা অনুভূত হচ্ছে। আগামী দিরগুলোতে গরম আরও ভয়াবহ হবে। তীব্র গরমে পুড়ছে ইউরোপ। বেশ কয়েকটি দেশে দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে। উত্তর আফ্রিকায় সৃষ্ট তাপপ্রবাহে পর্তুগাল, ফ্রান্স ও স্পেনে দেখা দিয়েছে দাবানল। দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে পুরো ইউরোপে। চরম গরমে যুক্তরাজ্যে প্রথমবারের মতো জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। লন্ডন ইয়র্ক শহর ও ম্যানচেস্টারসহ বিভিন্ন এলাকায় আগামী সোম ও মঙ্গলবারের জন্য লাল সতর্কতা দিয়েছে যুক্তরাজ্যের আবহাওয়া বিভাগ। এর মানে হলো, এসব এলাকার তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছাতে পারে এবং জীবনের জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। চরম তাপ প্রবাহের কারণে দেশটির রেললাইনগুলোয় ট্রেন চলাচলের গতি সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। কিছু স্কুলে আগাম ছুটি দেওয়া হয়েছে। আবহাওয়া বিভাগের পাশাপাশি যুক্তরাজ্যের হেলথ সিকিউরিটি এজেন্সিও তাপপ্রবাহের কারণে স্বাস্থ্যজনিত সর্বোচ্চ ৪ মাত্রার সতর্কতা জারি করেছে। অর্থাৎ এ ধরনের তাপপ্রবাহের মধ্যে মানুষ শারীরিকভাবে অসুস্থ হতে পারে এবং মৃতু্যও হতে পারে। ফ্রান্সের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল গিরোনদে থেকে গত কয়েক দিনে ১০ হাজারের বেশি মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। স্পেন ও পর্তুগালে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। এই দুই দেশে দাবদাহে ২৮১ জনের মৃতু্য হয়েছে। এর মধ্যে ২৩৮ জনেরই মৃতু্য হয়েছে পর্তুগালে। পশ্চিম স্পেনের বেশ কিছু শহর জনমানবহীন হয়ে পড়েছে। এসব অঞ্চলের বাসিন্দাদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। করোনার সংকট কাটতে না কাটতেই চীনের কাছে এখন নতুন সংকট তাপপ্রবাহ। লাল সতর্কতা জারি করেছে চিনের ৮৬টি শহরে। যার মধ্যে রয়েছে বাণিজ্যিক রাজধানী সাংহাই। দিন দিন তাপমাত্রা এতটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে যে রাস্তায় ফাটল দেখা যাচ্ছে। পর্যাপ্ত বৃষ্টির অভাব, চীনে ধান চাষে ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। রেকর্ড গরমে জ্বলছে চীন, স্বস্তি পেতে নাগরিকরা আশ্রয় নিয়েছেন বস্ন্যাংকারে।