তুরস্কের অতি সাম্প্রতিক ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে এবং বিভীষিকাময় এই খবরগুলো দেশি-বিদেশি টেলিভিশন ও মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা দ্রুতই জানতে পারছি। এই ভূমিকম্পের প্রভাব সরাসরি আমাদের দেশে না পড়লেও পৃথিবীর যেখানেই মানবতা কষ্ট পায়, মানুষ হিসেবে তা আমাদের মনকে করে ব্যথাতুর, শোকাভিভূত। এখানেও আমরা সহমর্মিতা প্রকাশ করছি। সেই সঙ্গে ভূমিকম্পের ভীতিকর ছবিগুলো আমাদের আতঙ্কিতও করছে, তবে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতনতা দরকার।
পৃথিবীর অন্যতম একটি সক্রিয় টেকটোনিক অঞ্চলে অবস্থান হওয়ায় বাংলাদেশে প্রায়শই ভূকম্পন অনুভূত হয়—উত্তরে ভারতীয় ও ইউরেশীয় প্লেট এবং পূর্ব ও পূর্ব-দক্ষিণে ভারতীয় ও বার্মিজ প্লেটের চলমান টেকটোনিক প্রক্রিয়া এসব ভূমিকম্পের উৎপত্তি ঘটায়। গত আড়াই শ বছরে বাংলাদেশ ও আশপাশে ৭.০ বা তার বেশি মাত্রার ৯টি ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে, ১৮৮৫ ও ১৯১৮ ভূমিকম্পগুলোর উৎপত্তিস্থল ছিল দেশের মধ্যে। কোনো অঞ্চলের ভূ-অভ্যন্তরে টেকটোনিক কারণে ক্রমান্বয়ে শক্তি সঞ্চিত হতে থাকে, একটা সময় পরে সঞ্চিত শক্তি কোনো দুর্বল অংশ, ভূতত্ত্বের ভাষায় ফল্ট বা চ্যুতি দিয়ে ভূমিকম্প আকারে বিমুক্ত হয়। সময়ের সঙ্গে এই অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটে। অর্থাৎ, ঐ এলাকায় আবার ভূমিকম্প সংঘটিত হয়, যা শত শত এমনকি হাজার বছর পরও হতে পারে। দেশের ভূমিকম্পবিদগণ বড় মাত্রার ভূমিকম্প উৎপাদনে সক্ষম এমন কয়েকটি চ্যুতি যেমন—উত্তর দিকের ডাউকি ও পূর্ব দিকের প্লেট বাউন্ডারি চিহ্নিত করেছেন। প্রথমটিতে গত প্রায় ১ হাজার বছরে তিনটি বড় ভূমিকম্প উৎপন্ন হয়েছিল, যার শেষেরটি হয় ১৮৯৭ ও দ্বিতীয়টি ১৭৬২ সালে বড় মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছিল, এতে ভূমিরূপে বেশ পরিবর্তন এসেছিল। তবে সে সময় এ দেশের জনসংখ্যা ও অবকাঠামোর স্বল্পতা থাকায় প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হয়েছে। বিগত ৫০ বছরে আমাদের দেশের জনসংখ্যা সাড়ে ৭ কোটি থেকে বেড়ে ১৬ কোটি ৯৮ লাখের বেশি হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নতি ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় নগর জনসংখ্যা বেড়েছে এবং প্রক্ষেপণ অনুযায়ী বৃদ্ধির এই প্রবণতা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। বড় শহরগুলো ছাড়িয়ে উপজেলা পর্যায়ে বড় বড় অবকাঠামো গড়ে উঠছে, যার সঙ্গে জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তার ব্যাপারটি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। যা হোক, ২০১১ সালের সিকিম (৬.৯) এবং ২০১৫ সালের নেপাল (৭.৮) ভূমিকম্প আমাদের দেশকেও কাঁপিয়েছে, মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করেছে, হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। নিকট অতীতের ভূমিকম্পকালে হুড়োহুড়ি করে ভবন থেকে বেরোতে গিয়ে হতাহতের ঘটনা, কোথাও ভূমি দেবে গিয়ে ভবনের ক্ষতি হতে আমরা দেখেছি।
ভূতাত্ত্বিক দিক থেকে এ দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকা হলোসিন উপযুগের নরম ও অসংহত পলি দিয়ে গঠিত, ৮ শতাংশ প্লেইসটোসিন উপযুগের কাদাসমৃদ্ধ মৃত্তিকা এবং অবশিষ্ট ১২ শতাংশ টারসিয়ারি যুগের পাললিক শিলা দিয়ে গঠিত। এসব পলি-মাটি-শিলা ভিন্ন ভৌত ও ভূপ্রাযুক্তিক গুণাগুণসম্পন্ন হওয়ায় ভূকম্পনে ভিন্ন ধাঁচে প্রভাবিত হয়, আবার ভিন্ন মাত্রার কম্পনে দৃশ্যপটে ভিন্নতা আসে। ভূকম্পনে পানিসিঞ্চিত ও বালুসমৃদ্ধ নরম ও অসংহত পলিমাটি শক্তি হারিয়ে তরল পদার্থের মতো আচরণ করে, যাকে ‘লিক্যুফ্যাকশন’ বলে। এই অবস্থা মাটির ওপর নির্মিত ভবন বা অবকাঠামোকে ধরে রাখার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলায় মাটিতে দেবে গিয়ে ঝুঁকির কারণ হয়। ভূমিকম্প নিজে কাউকে না মারলেও অবকাঠামো ধ্বংস করে জানমালের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, বাংলাদেশের ৭০ ভাগ এলাকা ও জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ ভূমিকম্প ঝুঁকিতে আছে। তাহলে এই ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাওয়া বা ঝুঁকি হ্রাসের উপায় কী? ভূমিকম্প সংঘটনে ভূগাঠনিক-ভূতাত্ত্বিক-ভূপদার্থিক প্রক্রিয়ার দুর্বোধ্যতার কারণে ভূমিকম্পের আগাম সতর্কবার্তা প্রদানে কার্যকর কোনো পন্থা এখনো বের হয়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্রে সেলফোনে সতর্কবার্তা প্রদানের খবর জানা গেছে, এতে সময় পাওয়া যায় মাত্র ৮০ সেকেন্ড। যা হোক, আমাদের দেশে এই পদ্ধতি গ্যাস-বিদ্যুত্ সরবরাহ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ, ট্রেনের গতি কমানো ও লিফট বন্ধের ক্ষেত্রে প্রয়োগের ব্যাপারে ভাবা যেতে পারে। ভূমিকম্পে আমাদের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতাগুলো বলে যে, আতঙ্কিত হয়ে শিক্ষা বা শিল্পপ্রতিষ্ঠান অথবা আবাসিক বা ব্যাবসায়িক ভবন থেকে হুড়োহুড়ি করে বের হতে বা নামতে গিয়ে অনেকে হতাহত হয়েছে, কাউকে হাসপাতালেও যেতে হয়েছে। কিন্তু ভূমিকম্পকালীন করণীয় সম্বন্ধে সচেতনতা এমন হতাহতের পরিমাণ কমাতে পারে। তদুপরি যেহেতু ভূমিকম্প দুর্যোগের কার্যকর আগাম বার্তা প্রদান এখনো সম্ভব হয়নি বলে এ দুর্যোগ অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে ভিন্ন। এজন্য বিদ্যালয়ে অবস্থানকারী শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীকেও তার করণীয় সম্বন্ধে জানানো দরকার।
পরিশেষে বলা যায় যে, ভূমিকম্পের পর্যায়ভিত্তিক, অর্থাৎ ভূমিকম্প-পূর্বকালীন ও পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞানসম্মত ও ব্যাপকভিত্তিক স্বীকৃত করণীয় রয়েছে, এখানে বিস্তারিত বর্ণনার সুযোগ নেই। সার্বিক পরিকল্পনার মাধ্যমে জনসচেতনতা ও প্রস্তুতিই হলো ভূমিকম্প ঝুঁকি হ্রাসে সফল ব্যবস্থা। জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট, সমাজবিজ্ঞানী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ ভূমিকা রাখতে পারেন। ভূমিকম্প-পূর্ব স্বাভাবিক সময়ে ভবন ও অবকাঠামো নির্মাণকালে নির্মাণ বিধিমালার কঠোর অনুসরণ ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসে প্রধানতম করণীয়, যা টেকসই ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয়, সঙ্গে দরকার নিবিড় তদারকি। উল্লেখ্য, আঞ্চলিক ও স্থানীয় ভূগাঠনিক, ভূতাত্ত্বিক ও ভূপ্রাকৃতিক অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারণে আমাদের নিজস্ব বহুবিষয়ক গবেষণা অব্যাহত রাখা দরকার এবং গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রস্তুতিই হতে পারে ভূমিকম্প ঝুঁকি হ্রাসে টেকসই কৌশল।