১লা সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯ জার্মানি পোল্যান্ড আগ্রাসন শুরু করে, যার প্রতিক্রিয়ায় দুইদিন পর বৃটেন এবং ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এখন পর্যন্ত কাগজে-কলমে এই দিনটিকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর দিন হিসেবে ধরে নেয়া হয়। কিন্তু এই তারিখটি নিয়ে বিতর্ক আছে ঐতিহাসিকদের মধ্যে। অনেকেই বলেন- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯৩৭ সালের দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধের মধ্যদিয়ে। কেউ কেউ তারও আগে ১৯৩৫ সালে ইথিওপিয়ায় ইতালির আগ্রাসনকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর সময় হিসেবে বলেন। এমনকি কেউ কেউ ১৯৩১ সালে জাপানের মাঞ্চুরিয়া দখলকেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অংশ হিসেবে দাবি করেন। এমন আরও কয়েকটি ঘটনাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অংশ বলে বিশ্বাস করেন অনেকেই।
রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসন কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের অংশ?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই প্রসঙ্গটি আসলো কারণ ইউক্রেনের ওপরে রাশিয়ার সর্বাত্মক আগ্রাসন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের অংশ কিনা সেই প্রশ্ন নানাদিকেই উঠছে। এই আলোচনা যৌক্তিক।
অনেকেই এটাকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবশ্য মনে না করলেও এটা যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করতে পারে- এমন বক্তব্য দিতে শুরু করেছেন। রাজনৈতিক এবং সমর বিশ্লেষকরা তো বটেই রাশিয়ার পক্ষ থেকেও পশ্চিমের প্রতি স্পষ্ট বিশ্বযুদ্ধের হুমকি দেয়া হয়েছে।
২৭শে এপ্রিল সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে রাশিয়ার আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে কথা বলার সময় পুতিন বলেন, ‘বাইরের কেউ ইউক্রেনে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করলে এবং রাশিয়ার জন্য কৌশলগত হুমকি সৃষ্টি করলে, আমাদের প্রতিক্রিয়া হবে বিদ্যুৎগতির। যে কারও গর্ব থামিয়ে দেয়ার মতো সব সরঞ্জাম আমাদের আছে।আর আমরা এগুলো নিয়ে বড়াই করবো না, প্রয়োজন হলে ব্যবহার করবো।’ যৌক্তিক কারণেই বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এসব মন্তব্যের মাধ্যমে পুতিন ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা হতে পারে, এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন।
এরপরই যুক্তরাষ্ট্রের আয়োজনে ইউক্রেনকে সামরিক সাহায্য দেয়ার বিষয়ে ৪০টি দেশের একটি বৈঠকের প্রেক্ষাপটেই রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই ল্যাভরভ বলেছিলেন, ন্যাটো রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটি ছায়া যুদ্ধ (প্রক্সি ওয়ার) চালিয়ে যাচ্ছে যা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে রূপ নিতে পারে।
অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন ইউক্রেন যুদ্ধে পুতিন যদি ন্যূনতম মুখরক্ষা করতে না পারেন তাহলে তিনি এই যুদ্ধকে অন্য দেশে ছড়িয়ে দিয়ে কিংবা ইউক্রেনে তুলনামূলক স্বল্প ক্ষমতার একটি ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক বোমা হামলা করতে পারেন। আবার পুতিন যদি ইউক্রেনে তার লক্ষ্য অর্জন করতে পারে তাহলে সেটা তাকে আরও আগ্রাসী করে তুলবে, এটা নিশ্চিত। এর কোনোটা যদি ঘটে সেটা অনিবার্যভাবেই একটা বৃহত্তর যুদ্ধ, এমনকি বিশ্বযুদ্ধে গড়াতে পারে। রাশিয়া ইউক্রেন সংকট যদি বিশ্বযুদ্ধে শেষ পর্যন্ত নাও গড়ায়, এমনকি এই যুদ্ধটা যদি একেবারে নাই হতো তাহলেও চীন তাইওয়ান সংকটকে ঘিরে একটা বিশ্বযুদ্ধ হওয়ার ঝুঁকি বেশ কিছুদিন থেকেই তৈরি হচ্ছিল। এবং সত্যি বলতে সেটাই প্রধান ঝুঁকি।
চীন-তাইওয়ান সংকটের উৎস
তাইওয়ান ভূখণ্ডের অফিশিয়াল নাম রিপাবলিক অব চায়না, যেটা একসময় পুরো চীনের (মেইনল্যান্ড চায়নাসহ) নাম ছিল। এমনকি ১৯৪৯ সালে মাও সে তুং-এর বিপ্লবের পর ২০ বছরেরও বেশি সময় মেইনল্যান্ড চায়না নয়, তাইওয়ানে থাকা সরকারই ছিল পুরো চীনের প্রতিনিধিত্বকারী। বর্তমানে তাইওয়ান স্বশাসিত হলেও পৃথিবীতে স্বাধীন দেশ হিসেবে খুব কমই স্বীকৃত। পৃথিবীতে ক্ষুদ্র এবং খুব কম গুরুত্বপূর্ণ মাত্র ১৫টি দেশ (২০১৬ সালে ছিল ২৩টি) তাইওয়ানকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের প্রধান শর্ত হচ্ছে ‘এক চীন নীতি’কে স্বীকৃতি দিয়ে মেনে নিতেই হচ্ছে তাইওয়ান চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সে কারণেই তাইওয়ানের সবচেয়ে বড় মিত্রদেশগুলো, এমনকি যারা তাইওয়ান আক্রান্ত হলে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে, তারাও তাইওয়ানকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না।
চীনে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর তখনকার পুরো চীনের ক্ষমতাসীন দল কুওমিনটাং প্রধান চিয়াং কাই শেক অনুসারীদের নিয়ে তাইওয়ান দ্বীপে পালিয়ে যান। ইচ্ছে থাকলেও কোরীয় যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়া, যুক্তরাষ্ট্রের বাধা এবং আরও কিছু কারণে মাও-এর পক্ষে তখন তাইওয়ানে গিয়ে তার প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করে তাইওয়ানকে মেইনল্যান্ড চায়নার সঙ্গে একত্রীকরণ সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
এরপর একের পর এক দেশ মেইনল্যান্ড চায়নাকে মূল চীন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রেক্ষাপটে তাইওয়ান পুরো চীনের দাবি থেকে সরে এসে তাইওয়ানকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে পেলেই সন্তুষ্ট থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। বিশেষ করে তাইওয়ানে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রতিষ্ঠিত ডেমোক্রেটিক প্রোগ্রেসিভ পার্টি (ডিপিপি) স্বাধীন তাইওয়ান নিয়ে তাদের অবস্থানকে তাইওয়ানের জনগণের কাছে জনপ্রিয় করতে পেরেছে।
বলা বাহুল্য, চীন তাইওয়ানের স্বাধীনতা মেনে নেয়নি; নেবেও না। কয়েক বছর আগে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ঘোষণা দিয়েছেন, তাইওয়ান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করলেই তিনি সামরিক অভিযানের মাধ্যমে তাইওয়ানকে চীনের সঙ্গে একীভূত করবেন|সানফ্লাওয়ার মুভমেন্ট এবং চীনের সাম্প্রতিক হতাশা
বর্তমানে তাইওয়ানের অন্যতম রাজনৈতিক দল কুওমিনটাং (কেএমটি)- এর সঙ্গে চীনের শত্রুতা থাকলেও বর্তমানে ক্ষমতাসীন স্বাধীনতাকামী নতুন দল ডেমোক্রেটিক প্রোগ্রেসিভ পার্টির (ডিপিপি) জন্মের পর কেএমটি’র সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ভালো হতে শুরু করে। এখন চীনের সরকার কেএমটিকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেয়, কারণ তারা স্বাধীনতার কথা বলে না।
সাম্প্রতিক অতীতে পরপর দু’বার (২০০৮ এবং ২০১২) কেএমটি সরকারের সময়ে চীনের সঙ্গে তাইওয়ানের সম্পর্ক অত্যন্ত অন্তরঙ্গ হয়। সেই পরিস্থিতিতে চীন এবং তাইওয়ানের মধ্যে ২০১৩ সালে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (ক্রস স্ট্রেইট সার্ভিস ট্রেইড অ্যাগ্রিমেন্ট) স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু এর বিরুদ্ধে তরুণ শিক্ষার্থীরা একটি অরাজনৈতিক, স্বতঃস্ফূর্ত (অরগানিক) আন্দোলনে রাস্তায় নেমে পড়ে। একপর্যায়ে তারা দেশের প্রশাসনিক ভবন এবং নজিরবিহীনভাবে পার্লামেন্ট দখলে নেয়; তিন সপ্তাহের মতো সংসদ অবরোধ করে রাখে। সেই বাণিজ্যচুক্তি আর কখনো সংসদে পাস হয়নি। এটাই ‘সানফ্লাওয়ার মুভমেন্ট’ নামে বিখ্যাত।
তাইওয়ানের তরুণদের প্রতি চীনের ভীতি আরও বাড়ে সেখান থেকেই। সাম্প্রতিক প্রতিটি জরিপ দেখাচ্ছে, তরুণদের খুব বড় একটি অংশ চীনের সঙ্গে একত্রীকরণ দূরে থাকুক, বর্তমান স্থিতাবস্থাও চায় না। তারা চায় তাইওয়ান স্বাধীনতা ঘোষণা করুক স্পষ্টভাবে। ওদিকে সাম্প্রতিক সময় হংকংয়ে চীনের ভয়ঙ্কর ক্র্যাকডাউনের কারণে তথাকথিত ‘এক চীন দুই নীতি’ এখন একেবারেই অর্থহীন হয়ে গেছে। এই ক্র্যাকডাউন পুনরেকত্রীকরণের পক্ষে থাকা বহু তাইওয়ানিকেও সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরিয়ে এনেছে।ভবিষ্যতে তরুণদের স্বাধীনতা পাওয়ার মনোভাবের কারণে কেএমটি সহসা আর কোনো দিন ক্ষমতায় আসবে কিনা, খুবই বড় প্রশ্নের ব্যাপার। সবশেষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কেএমটি প্রার্থী বর্তমান প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েন-এর চাইতে ২০ শতাংশ ভোট কম পেয়েছেন। শান্তিপূর্ণভাবে তাইওয়ানের পুনরেকত্রীকরণ একেবারেই অসম্ভব মনে হচ্ছে এখন।
এমনকি শান্তিপূর্ণ পুনরেকত্রীকরণও মার্কিন এবং পশ্চিমা স্বার্থের পরিপন্থি। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত পণ্য সেমিকন্ডাক্টর চিপ তৈরিতে একচ্ছত্র সক্ষমতা তাইওয়ানের। সর্বোচ্চ মানের অর্থাৎ ৭ ন্যানোমিটার বা তারচেয়ে কম আর্কিটেকচারের চিপ তৈরির প্রধান মার্কেট শেয়ার আছে তাইওয়ানের দুই কোম্পানি তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি (টিএসএমসি) আর ইউনাইটেড মাইক্রো ইলেকট্রনিকস কোম্পানি (ইউএমসি)-এর। চীনের কোম্পানি সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশন (এসএমআইসি) চিপ উৎপাদক কোম্পানি হিসেবে পৃথিবীতে পঞ্চম হলেও সর্বোচ্চ মানের চিপ উৎপাদনের আশপাশেও নেই। একটি শান্তিপূর্ণ পুনরেকত্রীকরণের মাধ্যমে চীনের হাতে সেমিকন্ডাক্টর চিপের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ চলে যেতে দেয়া হবে কিনা, সেই ভাবনা যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দুনিয়ার থাকবেই। এ ছাড়াও তাইওয়ান চীনের হাতে চলে গেলে চীনের পক্ষে বৃহত্তর প্রশান্ত মহাসাগর একেবারে সহজে উন্মুক্ত হয়ে পড়বে।
তাইওয়ান আক্রান্ত হলে জাপানের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ
ঐতিহ্যগতভাবেই চীন জাপানকে শত্রু দেশ মনে করে তার এক তিক্ত অতীত অভিজ্ঞতা ‘হান্ড্রেড ইয়ার্স অব হিউমিলিয়েশন’-এর সময় বৃটেনের সঙ্গে জাপানের ভূমিকার জন্য (তাইওয়ান, মাঞ্চুরিয়া দখল; নানকিং হত্যাযজ্ঞ ইত্যাদি)। আছে সাম্প্রতিক সমুদ্রসীমা বিরোধও। জাপানের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থান মনুষ্য-বসতিহীন সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জের। জাপানের নিয়ন্ত্রণাধীন এসব দ্বীপের মালিকানায় অবশ্য চীনেরও জোর দাবি আছে (চীনের ভাষায় ডাউইউ দ্বীপপুঞ্জ)। মনুষ্যবসতি না থাকলেও এই দ্বীপপুঞ্জ যে দেশের অধিকারে যাবে, সে দেশ যে সমুদ্রসীমার অধিকারী হবে, সেটা মৎস্য এবং খনিজ সম্পদে খুবই সমৃদ্ধ।
সার্বিক পরিস্থিতিতে গত বছরের জুলাই মাসে জাপান তার একটি সামরিক কৌশলপত্রে খুব স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে, একটি মুক্ত এবং নিরাপদ এশিয়া প্যাসিফিকের জন্য তাইওয়ানের স্বাধীনতা অত্যন্ত জরুরি। চীন যদি তাইওয়ানকে আক্রমণ করে, তবে জাপানকে অবশ্যই তাইওয়ানের পক্ষে সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হবে।
তাইওয়ান আক্রান্ত হলে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা
বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমছে নিশ্চিত, কিন্তু এটা আদৌ আর থাকবে কিনা, সেটা নির্ধারিত হবে তাইওয়ান আক্রান্ত হলে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে সামরিক পদক্ষেপ নেয় কিনা সেটার ওপর। শুধু সেটাই না, তাইওয়ান আক্রান্ত হলে জাপান সরাসরি যুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়লে যুক্তরাষ্ট্রকে সেই যুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়তে সম্ভবত হবেই। ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত ‘ইউএস-জাপান সিকিউরিটি ট্রিটি’ অনুযায়ী দুই দেশের কোনোটি বহিঃশত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে অপর দেশকে তার সাহায্যে সামরিক শক্তি নিয়ে হাজির হতে হবে।
আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। মেইনল্যান্ড চায়নাকে মূল চায়না স্বীকৃতি দেয়ার সময় যুক্তরাষ্ট্র স্বীকার করেছিল তাইওয়ান চীনের অংশ এবং যুক্ত করেছিল, তাইওয়ানের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র কোনো অবস্থান নেবে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল তাইওয়ানের ‘শান্তিপূর্ণ পুনরেকত্রীকরণের’ পক্ষে থাকবে তারা। তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায়, পুনরেকত্রীকরণ যদি শান্তিপূর্ণ না হয়?
বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তাইওয়ানের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ‘কৌশলগত অস্পষ্টতা’ থেকে সরে এসে একাধিকবার বলেছেন, তাইওয়ান চীন কর্তৃক আক্রান্ত হলে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে রক্ষা করতে সামরিক পদক্ষেপ নেবে।
চীন নিয়ন্ত্রিত একটি বিশ্বব্যবস্থা তৈরির চেষ্টাই সংকটের কারণ
আমেরিকা আর চীনের সম্পর্কের টানাপড়েন নিয়ে বেশ কিছুদিন থেকে ‘থুসিডিডিস’স ট্র্যাপ’ শব্দযুগল বেশ শোনা যায়। গ্রাহাম এলিসন এর ‘ডেস্টিনড ফর ওয়র: ক্যান আমেরিকা অ্যান্ড চায়না এস্কেইপ থুসিডিডিস’স ট্র্যাপ?’ বইটি এই আলোচনাকে সামনে নিয়ে এসেছে।
এথেন্সবাসী থুসিডিডিস-এর জন্ম ৪৬০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের দিকে; তাঁকে বৈজ্ঞানিক ইতিহাস’-এর জনক বলা হয়। থুসিডিডিস স্পার্টা আর এথেন্স-এর নেতৃত্বাধীন দুইটি দলের মধ্যে সংঘটিত পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধ নিয়ে লিখেছিলেন। এই যুদ্ধের কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন তখন সম্পদে এবং রাজনৈতিক শক্তিতে বেশি শক্তিশালী স্পার্টার সামনে যখন এথেন্স মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছিল তখন উভয়ের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়। উত্তেজনার কারণ প্রতিষ্ঠিত শক্তিটা তার অবস্থান ছাড়তে চায় না, কিন্তু উঠতি শক্তিটা শ্রেষ্ঠত্বের আসন যেকোনো মূল্যে দখলে নিতে চায়। তার ফল হিসেবেই উভয়ের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা তৈরি হয়। তিনি এই পরিস্থিতির নাম দিয়েছেন ‘থুসিডিডিস’স ট্র্যাপ’। তার বইয়ে অ্যালিসন মধ্যযুগ থেকে সাম্প্রতিক ইতিহাস পর্যন্ত ১৬টি ‘থুসিডিডিস’স ট্র্যাপ’ দেখিয়েছেন, যার মধ্যে ১২টিতে উভয় পক্ষ যুদ্ধে জড়িয়েছিল।
চীন সামরিক এবং অর্থনৈতিক দুইদিক দিয়েই আমেরিকার জন্য প্রচণ্ড চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এই চ্যালেঞ্জ সোভিয়েত ইউনিয়নের চ্যালেঞ্জের চাইতে অনেক বড়। কারণ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপুল সামরিক শক্তি থাকলেও অর্থনৈতিক দিক থেকে তারা ছিল আমেরিকার তুলনায় একেবারে দুর্বল। চীন বর্তমানে পিপিপি ডলারে আমেরিকার চাইতে বড় অর্থনীতি আর বছর দশেক পর ডলারের হিসাবেই আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাবার পূর্বাভাস আছে।
অ্যালিসন-এর হিসেবে চীন আর আমেরিকার বর্তমান সংকট ১৭তম ‘থুসিডিডিস’স ট্র্যাপ’। এটা কি যুদ্ধে গড়াবে? বিশ্বযুদ্ধ ছাড়া কোনো নতুন শক্তি বিশ্বব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি। সার্বিক বিশ্লেষণে মনে হয় চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। আর চীন-আমেরিকা যদি সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, সেটা নিশ্চিতভাবেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে, সেটা বলাই বাহুল্য।