সিলেটের গোয়াইনঘাটের আলীরগাঁও ইউনিয়নের লামাকোটা পাড়া গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম। দিনমজুরের কাজ করে ৬ জনের সংসার চালান। ঘরে ৮৫ বছরের বৃদ্ধ অসুস্থ মা। বন্যায় রফিকুলের ঘরে উঠেছে কোমর সমান পানি। পরিবারের সবাইকে নিয়ে তিনি বাড়িতেই অবস্থান করছেন। নৌকা না থাকায় কোথাও যেতে পারেন না। ঘরে পানি থাকায় তার স্ত্রী চুলাও জ্বালাতে পারেন না। স্ত্রী, সন্তান আর বৃদ্ধ মাকে নিয়ে এক সপ্তাহ ধরে রান্না করা খাবার না খেয়েই আছেন। সামান্য কিছু চিড়া-মুড়ি খেয়ে বেঁচে আছেন। দু’দিন ধরে বন্যার পানি কিছুটা নেমেছে।
ঘরে চিড়া-মুড়িও শেষ। তাই বৃদ্ধ মা ও সন্তানের জন্য খাবার সংগ্রহ করতে বৃহস্পতিবার সকালে তিনি ৮ ফুট পানির উপরে দুই কিলোমিটার সাঁতার কেটে এসেছেন খাইয়া গাঙের ব্রিজে। সকাল থেকে দুপুর তিনটা পর্যন্ত ব্রিজে অপেক্ষা করে ত্রাণের দেখা পাননি। পরে এক বুক হতাশা নিয়ে আবার সাঁতার কেটে ফিরে যান বাড়িতে। শুধু রফিক নন, স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় নিঃস্ব পুরো গোয়াইনঘাট। বন্যায় ক্ষতি হয়নি এমন বাড়ি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন উপজেলার হাজার হাজার মানুষ।
গোয়াইনঘাটের অনেকেই ঘরবাড়ি, ধান-চাল, হাঁড়ি-পাতিল, কাপড়, গরু, মহিষ, ছাগলসহ মূল্যবান সম্পদ হারিয়ে দিশাহারা। ঘরে নেই খাবার। নেই বিশুদ্ধ সুপেয় পানির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। যোগাযোগ ব্যবস্থাও বন্ধ। নৌকাছাড়া যোগাযোগে আর মাধ্যম নেই। বিভিন্ন এলাকায় এখনো বিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ। যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। মানুষের ঘরে এখনো হাঁটু ও কোমর সমান পানি। দু’দিন থেকে পানি প্রবাহ কিছুটা কমছে। তবে বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে খাবারের জন্য হাহাকার চলছে। বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তি, প্রাতিষ্ঠানিক নানা উদ্যোগে সীমিতভাবে চিড়া-মুড়ি, বিস্কুট, গুড়, চিনি বিতরণ চলছে। চিড়া-মুড়ি খেয়ে সবাই এখন বিরক্ত। এসব খাদ্যের বাইরে চাল, ডাল, আলু বা অন্যকোনো খাবার কেউ দিচ্ছে না। এমনকি রান্না করা খাবারও দেয়া হচ্ছে না। তাই জীবন বাঁচাতে চিড়া-মুড়ি খেয়েই তারা জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। গোয়াইনঘাট উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ত্রাণ বা খাদ্য বিতরণে সমন্বয়হীনতা দেখা দিয়েছে। সমন্বয় না থাকায় কেউ বার বার ত্রাণ পাচ্ছে আবার কেউ এখনো একবারও পায়নি।
যারা ত্রাণ বিতরণ করছেন তারা প্রধান সড়কের আশেপাশের মানুষ ও আশ্রয়কেন্দ্রে ত্রাণ বিতরণ করছেন। এতে করে ঘুরেফিরে এসব এলাকার বাসিন্দারা একাধিকবার ত্রাণ পাচ্ছে। কিন্তু কিছু কিছু গ্রাম ও ইউনিয়নের দুর্গম, প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেকেই না খেয়ে আছেন। নৌকার অভাবে তারা কোথাও যেতে পারছেন না। তাদের কাছেও কেউ যায় না। পানির সঙ্গে যুদ্ধ করা এসব মানুষ তাদের বাড়ির আশপাশ দিয়ে কোনো নৌকা গেলে ডাকতে থাকেন। প্রকাশ করেন তাদের কষ্টের কথা। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকার মানুষেরা তাদের পরিবারের সদস্যদের তুলনায় অপ্রতুল ত্রাণ পাওয়ায় ক্ষুধার্ত থাকে। পরিবারে স্ত্রী, সন্তানের প্রয়োজন মেটাতে কোথাও ত্রাণের খবর পেলেই ছুটে যায়। পায়ে হেঁটে নৌকা কিংবা সাঁতরেও ত্রাণ বিতরণে আসা মানুষজনের দ্বারস্থ হচ্ছে। উপজেলা সদর থেকে শুরু করে সূদুর প্রত্যন্ত অঞ্চলেও একই চিত্র দেখা যায়। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় গোয়াইনঘাট উপজেলা শহীদ মিনার চত্বরে ছুটে আসে শত শত মানুষ। ১০ নং পশ্চিম আলীরগাঁও ইউনিয়নের পুকাশ এলাকার সুমিতা রানী দাস বলেন, সাতদিনে এখনো কোনো ত্রাণ পাইনি। পানির জন্য ঘর থেকে বের হতে পারি নাই।
ঘরে থাকা ছোট ছোট সন্তানের কথা চিন্তা করে পানিতে ভিজে চলে এসেছি। জানি না পাবো কিনা। লেঙ্গুড়া ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্যা অর্পনা রানী দাস বলেন, গুরুকচি পশ্চিমপাড়ায় মানুষজন চরম অসহায়ত্বের মধ্যদিয়ে দিন পার করছে। বিশেষ করে এ গ্রামে নিম্ন আয়ের ৫০টি হিন্দু পরিবার ত্রাণ সংকটে ভুগছে। সরকারি-বেসরকারিভাবে ত্রাণ তৎপরতা চলমান আছে। কিন্তু এমনও লোকজন আছে যাদের কাছে এখনো কোনো সহায়তা পৌঁছেনি। আলীরগাঁও ইউনিয়নের নোয়ামাটি এলাকার বাসিন্দা আব্দুল হান্নান বলেন, ১০ জনের পরিবার সাতদিন ধরে পানিবন্দি। পানিতে ঘরের লেপ তোষক, আসবাবপত্র সব নষ্ট হয়ে গেছে। কয়েকটা হাঁড়ি-পাতিল ছাড়া আর কিছুই নাই। হাঁড়ি- পাতিল থাকলেও রান্না করার মতো চাল ডাল নাই। ঘরের ভেতরে এখনো পানি। চুলা ধরানো যাবে না। আজ এতটা দিন হয়ে গেল, কোনো ত্রাণ সহযোগিতা পেলাম না। শুধু একদিন আধা কেজি মুড়ি আর এক পোয়া চিড়া পেয়েছি। দশজনের পরিবার এটা দিয়ে কী চলে। একই বাড়ির বাবুল মিয়া বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। মানুষ সাহায্য করলে খেয়ে-পরে বাঁচি। কিন্তু এই বন্যায় ঘরবন্দি ঘরের সাতজনই। নৌকা নাই, কোথাও যেতে পারি না। ঘরে এক ফোঁটা খাবার পানিও নাই।
লামাকোটা পাড়ার সাত সন্তানের জননী নাসিমা বেগম বলেন, স্বামী দিনমজুর, মাটির কাজ করেন। প্রতিদিন যা পান তা দিয়ে সাত সন্তানসহ পরিবারের ১২ জনের খাবার জুটে। এর মধ্যে কিছু টাকা সঞ্চয় করতে হয়। কারণ আমাদের ঘরের পাশে হাওর। প্রতিবছরই ছোট ছোট বন্যার কবলে পড়তে হয়। তাই সঞ্চয়ের টাকা ওই সময় খরচ করতে হয়। এবার কোনো সঞ্চয় ছিল না। তার ওপর এত বড়ো বন্যা। সাতটা সন্তান আমার। সবাই ছোট ছোট। তাদের জন্য কোনো শিশুখাদ্য নাই। বড়দের চিড়া-মুড়ি খেয়ে বাচ্চারাও বেঁচে আছে। তাদের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। বুকটা ফেটে যায়। নিজেরাও ক্ষুধার্ত। এদিকে লামাকোটা পাড়া, নোয়ামাটি গ্রামসহ আশেপাশের আরও গ্রামের বাসিন্দাদের বাড়িঘর বন্যার পানিতে ভাসছে। হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি তাদের ঘরে। তাই এসব গ্রামের বাসিন্দারা আশ্রয় নিয়েছেন গ্রামের খাইয়া গাঙের ব্রিজে। এখানে অন্তত শতাধিক শিশুও রয়েছে। বড়দের মতো এসব শিশুরাও পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছে। সাতদিন ধরে তারা ভাত খেতে পারেনি। ব্রিজের মধ্যে কেউ যদি ত্রাণ নিয়ে আসে তবেই পরিবারের সঙ্গে ত্রাণের চিড়া-মুড়ি খেয়ে বেঁচে আছে।
কেউ ত্রাণ নিয়ে আসলে বড়দের সঙ্গে তারাও যুদ্ধ করে ত্রাণ সংগ্রহ করে। গোয়াইনঘাটে বন্যার ভয়াবহতার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকায় রয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ, এমপি। তিনি ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে অবহিতকরণ সভায় বানভাসি মানুষজনের বাড়িঘর সহ সম্পূর্ণ ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করতে প্রশাসনের প্রতি নির্দেশ দেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসনে সরকারের তরফে দ্রুত উদ্যোগ নেয়া হবে বলে আশ্বস্ত করেন। গোয়াইনঘাটের উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাহমিলুর রহমান জানান, ভয়াবহ এই বন্যায় প্রশাসনের সঙ্গে সচেতন অগণিত মানুষজন সহযোগিতা করেছেন। গোয়াইনঘাটে প্রশাসন গঠিত ২০টি রেসকিউ টিম উদ্ধার তৎপরতা চালিয়ে পানিবন্দি মানুষজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে এসেছিল। প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ এবং সেনাবাহিনীর উদ্ধার তৎপরতা থাকায় গোয়াইনঘাটে কোনো প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটেনি। গোয়াইনঘাটের মানুষের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারিভাবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। ত্রাণ ও পুনর্বাসনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে।