বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের পেছনে মূল বিষয় হলো বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে দেশটির স্থলসীমান্ত রয়েছে। এই ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে একটি সংযোগ সেতু হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশ ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক মিত্রও বটে। কেননা, বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড ব্যবহার করেই উত্তর-পূর্ব ভারত এবং ভারতের মূল ভূখণ্ডকে বৃহত্তরভাবে একত্রীকরণ সম্ভব। শুধু তা-ই নয়, বঙ্গোপসাগরে উন্মুক্ত প্রবেশাধিকারের কারণে বাংলাদেশ চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের কাছেই তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
পূর্বে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব মূলত চীন-ভারত বৈরিতা এবং ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল; কারণ ভারত, পাকিস্তান ও চীন সবই বাংলাদেশের কাছাকাছি। কিন্তু শীতল যুদ্ধপরবর্তী যুগে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চল ও বঙ্গোপসাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাংলাদেশের ভূরাজনীতির সমীকরণ বদলে দিয়েছে। বিশ্বরাজনীতি এবং অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে চীনকে বহির্বিশ্বের সঙ্গে তার কানেক্টিভিটি আরো প্রসারিত করতে হবে। কিন্তু তার ভূরাজনৈতিক প্রতিপক্ষ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে বৈরিতার কারণেই কানেক্টিভিটির প্রসারে চীনের কাছে বাংলাদেশ ও ভারতের ভূরাজনৈতিক ও ভূকৌশলগত গুরুত্ব বেড়ে যায়।
ভারতের কাছে বাংলাদেশের ভূকৌশলগত গুরুত্ব : সামরিকভাবে ভারতের কাছে বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ চীন-ভারত সামরিক সংঘর্ষে শিলিগুড়ি করিডর সহজেই বন্ধ করে দিতে পারে চীন। যার মাধ্যমে ভারত তার পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। এ অবস্থায় ভারতের একমাত্র বিকল্প হবে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে পূর্বাঞ্চলীয় রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করা। এ কারণে ভারতের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখা খুবই জরুরি, যা তার নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয়। ভারত এখন বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে চীনের সঙ্গে তার উত্তর-পূর্ব অংশের সংযোগের প্রস্তাব করছে, যা বিসিআইএম এবং বাংলাদেশ-ভুটান-ইন্ডিয়া-নেপাল (বিবিআইএন) করিডরের পরিপূরক হয়ে আরো আঞ্চলিক একীকরণকে বাড়িয়ে তুলবে। ভারত এখন (বিবিআইএন) উপ-আঞ্চলিক হাব ব্যবহার করে উত্তর-পূর্বে সংযোগ এবং বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য ‘সীমিত চীনা বিনিয়োগের’ অনুমতি দেওয়ার লক্ষ্য রাখে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের প্রতি ভারতীয় নীতির এই দৃষ্টান্ত পরিবর্তনকে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ভারত-চীন আঞ্চলিক সহযোগিতার নতুন সূচনার সম্ভাবনা হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে, যেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশি বন্দর সংযোগ কেন্দ্র হিসাবে কাজ করবে।
ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোকে ভারতীয় মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করাও অন্যতম লক্ষ্য। এক্ষেত্রে শিলিগুড়ি করিডর ভারতের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব তৈরি করেছে। এই করিডর ভারতের জন্য অন্যতম ভৌগোলিক বাধ্যবাধকতা। এই সরু করিডর সমগ্র উত্তর-পূর্ব অঞ্চলকে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা করেছে। বাংলাদেশ ভারতের মূল ভূখণ্ড এবং উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের মধ্যে একটি বিস্তৃত সম্পর্ক তৈরি করে। কারণ আগরতলা থেকে কলকাতা ১ হাজার ৬৫০ কিলোমিটার এবং নতুন দিল্লি থেকে শিলং এবং গুয়াহাটি হয়ে ২ হাজার ৬৩৭ কিলোমিটার। অন্যদিকে বাংলাদেশ হয়ে আগরতলা ও কলকাতার মধ্যে যাত্রা মাত্র ৫৫০ কিলোমিটার। উপরন্তু, বাংলাদেশের প্রধান শহর এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের মধ্যে গড় দূরত্ব ২০ কিলোমিটার থেকে ৩০০ কিলোমিটার। ফলস্বরূপ, রেল, সড়ক ও নদীপথে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সংযোগের জন্য বাংলাদেশকে সর্বদা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। শুধু তা-ই নয়, ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল নিরাপত্তার দিক থেকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর মধ্যে একটি। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। সন্ত্রাসবাদী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ‘চিকেনস নেক’-এর সুযোগ নিয়ে এই রাজ্যগুলোতে তাদের বিদ্রোহী আন্দোলন চালায়। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ সব সময় ভারতের পাশে থেকেছে।
ভারত মহাসাগর নিয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের লড়াই :ভারত মহাসাগর হলো চীনের জ্বালানি সরবরাহ এবং রুটের জন্য একটি মূল এবং অন্যতম বাণিজ্যপথ। চীনের ১০টির জ্বালানি সরবরাহকারীর মধ্যে ৯টি সরবরাহকারীর পথ ভারত মহাসাগর অঞ্চলের মধ্য দিয়ে। এই গুরুত্বপূর্ণ সি লাইন অব কমিউনিকেশনস সুরক্ষিত করা চীনের জন্য একটি প্রধান অগ্রাধিকার। চীনের এই অর্থনৈতিক পরাশক্তি হওয়ার প্রক্রিয়াকে প্রতিহত করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভারত মহাসাগর অঞ্চলে চীনের সমপরিমাণ আগ্রহ রয়েছে। আর বঙ্গোপসাগর হলো ভারত মহাসাগর অঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।
বঙ্গোপসাগরে উন্মুক্ত প্রবেশাধিকারের কারণে বাংলাদেশ চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের কাছেই তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই বঙ্গোপসাগরমুখী ১২টি সমুদ্রবন্দর রয়েছে। যার ভেতর তিনটি বন্দরেরই অবস্থান বাংলাদেশে। সেগুলো হলো চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা বন্দর। তাই স্বাভাবিকভাবেই ভারত মহাসাগর অঞ্চলে কর্তৃত্ব স্থাপনে আগ্রহী যে কোনো রাষ্ট্রের কাছেই বাংলাদেশ ভূকৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও বাংলাদেশ ‘স্ট্রিং অব পার্লস’ কৌশল এবং ‘মেরিটাইম সিল্ক রোড’ তৈরির ক্ষেত্রে চীনের কাছে অত্যন্ত গুরুত্ব রাখে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এর সূচনার পর থেকে চীন তার বিশাল আর্থিক প্রভাব নিয়ে অবকাঠামো প্রকল্পে বিলিয়ন ডলার ঢেলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ শুরু করেছে। চীন বাংলাদেশকে মেরিটাইম সিল্ক রোডের (বিআরআই-এর একটি অংশ) প্রবেশদ্বারগুলোর মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচনা করে, যা চীনকে ভারত মহাসাগর এবং তার বাইরেও প্রবেশের অনুমতি দেয়। তাই বাংলাদেশের সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীন গভীর আগ্রহ দেখিয়েছে। অন্য পক্ষে, চীনের পশ্চিমা প্রতিদ্বন্দ্বীরা এবং আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের ক্রমবর্ধমান সম্ভাবনা সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন এবং ইতিমধ্যেই সেসব রাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে বৃহত্তর সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য পদক্ষেপ শুরু করেছে। এই সম্ভাবনাই এশিয়ার ভবিষ্যৎ গঠনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে কয়েক দশকের ভূরাজনৈতিক অপ্রাসঙ্গিকতা থেকে বাংলাদেশের অবস্থান পরিবর্তন করেছে।
চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এবং বিশ্বব্যাপী এর দ্রুত বিস্তার এই অঞ্চলে এবং এর বাইরেও চীনের উপস্থিতি বাড়িয়েছে। ফলস্বরূপ, প্রায় সব বড় শক্তির ভূরাজনৈতিক মনোযোগ দ্রুত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দিকে সরে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ইউরোপীয় মিত্ররা এই অঞ্চলে তাদের সম্পৃক্ততা বাড়াতে শুরু করে এবং এর ইন্দো-প্যাসিফিক মিত্র যেমন ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াও এই সম্পৃক্ততায় যোগ দিতে শুরু করে। ইতিমধ্যেই তারা চীনকে প্রতিহত করার জন্য বিভিন্ন চুক্তি স্বাক্ষর করে। সেসব চুক্তির ভেতর অন্যতম হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে চতুর্পক্ষীয় নিরাপত্তা সংলাপের (কোয়াড) পুনরুজ্জীবন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে অটকটঝ চুক্তি এবং ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক (আইপিইএফ)। এই উদ্যোগগুলো ছাড়াও, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য বড় শক্তিগুলোও এই বিষয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। এই ধরনের বৈচিত্র্যপূর্ণ স্বার্থ এবং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির প্রকৃতি বাংলাদেশের জন্য পরিস্থিতিকে আরো চ্যালেঞ্জিং করে তুলছে।
সামগ্রিকভাবে, বাংলাদেশের অবস্থান, জনসংখ্যা, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এটিকে দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় এবং আঞ্চলিক সংযোগ ও বাণিজ্যের একটি সম্ভাব্য কেন্দ্র করে তুলেছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক এবং ভূকৌশলগত গুরুত্ব চীন, ভারত এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশের কাছে আরো বৃদ্ধি পাবে।