বিশ্বের পোশাকবাজারে বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসার বিষয়টা এখন ধরতে গেলে পুরোনোই, আর থেমে থাকতে হচ্ছে সেখানেই। চীনকে হটিয়ে এক নম্বরে উঠে আসার সম্ভাবনা রয়েছে অফুরন্ত; কিন্তু বাস্তবে আর তা ঘটছে না। সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে বর্তমান অবস্থান নিয়েই। উপরন্তু এ স্থানটি হারানোর শঙ্কাও যে একেবারেই নেই, এমন কিন্তু নয়। ভারী শিল্পের দিকে চীনের বেশি মনোযোগী হওয়ার পাশাপাশি চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বের ফলে অনেক দেশের রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ ছিল।
অথচ তা কাজে লাগানো যায়নি যথাযথভাবে। মার্কিন তৈরি পোশাকের বাজারের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক চীনের হিস্যা আস্তে আস্তে কমতে থাকার সুযোগ লুফে নিচ্ছে ভিয়েতনাম। পোশাক রপ্তানিকারী দ্বিতীয় স্থানটি নিয়ে এই দেশটির সঙ্গেই বাংলাদেশের চলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। ২০২০ সালের বিভিন্ন প্রান্তিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অবস্থানের রদবদল ঘটেছিল খুবই দ্রুত এবং স্বল্পসময়ের জন্য। তবে সুখবর হলো, ২০২১ সাল শেষে পোশাক রপ্তানিতে প্রধান প্রতিযোগী ভিয়েতনামের চেয়ে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৪৭ দশমিক ২ কোটি ডলার মূল্যের। এর ফলে ভিয়েতনামকে হটিয়ে ফের পোশাক রপ্তানিতে দুই নম্বর স্থান পুনর্দখল করে বাংলাদেশ।
আগের অনুচ্ছেদে কিঞ্চিত হলেও যে ইঙ্গিতটা দেওয়া হয়েছিল, সেটি হচ্ছে স্বেচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়ই হোক, যুক্তরাষ্ট্রের পোশাকের বাজারে চীনের হিস্যা ৩ শতাংশ পয়েন্ট কমে ২৩ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে আসে। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সেস অফিস অ্যান্ড টেক্সটাইলস অ্যান্ড অ্যাপারেল (অটেক্স)-এর তথ্যানুযায়ী সেই শূন্যস্থান পূরণ করেছে ভিয়েতনামসহ অন্য কয়েকটি দেশ। তবে ভিয়েতনামের অবদানই সিংহ ভাগ। অথচ আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকলে ওদের বদলে এ সুযোগ লুফে নিতে পারত বাংলাদেশ। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ৬৪ বিলিয়ন ডলারের পোশাক বাজারে চীনের হিস্যা আগের বছরের চেয়ে কমে গেলেও তা ছিল ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ। আগের বছর সেখানে পোশাক রপ্তানি করে বিশ্বের শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক দেশটির আয় ছিল ১৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে চীনের হারানো বাজারের প্রায় পুরোটাই দখলে নেয় ভিয়েতনাম। সে সুবাদে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশটির পোশাকের বাজারে ২০১৯ সালে ভিয়েতনামের হিস্যা ১৬ দশমিক ২ শতাংশ থাকলেও পরের বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১৯ দশমিক ২ শতাংশ।
এবার তাকানো যাক বাংলাদেশের দিকে। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক বাজারে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ মাত্র ১ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। ৫ দশমিক ৩ থেকে ইন্দোনেশিয়ার হয়েছিল ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। তুলনামূলকভাবে কম্বোডিয়ার অবস্থা ছিল বাংলাদেশের চেয়ে ভালো; ৩ দশমিক ২ থেকে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। ভারতের অবস্থাটাও ছিল নেতিবাচক। ২০১৯ সালে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ থাকলেও পরের বছর তা হয়েছিল ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। ওটেক্সার তথ্যানুসারে, এককভাবে বাংলাদেশের রপ্তানিপণ্যের সবচেয়ে বড় গন্তব্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের হিসাবে ২০২০ সালে আগের বছরের চেয়ে ১১ দশমিক ৭৩ শতাংশ কমে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রপ্তানি বাবদ আয়ের অঙ্কটা ছিল ৫ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক বাজার থেকে ভিয়েতনামের আয়ও কমেছিল এবং সেটি ৭ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে পার্থক্যটা হচ্ছে, ঐ বছর মার্কিন বাজারে মোট পোশাক রপ্তানি মূল্য ৫ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার হলেও ভিয়েতনামের ছিল ১২ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
অটেক্সার মতে, বিশ্বের পোশাকবাজারে প্রায় স্বেচ্ছায় ছাড়তে থাকা চীনের হিস্যা আয়ত্তে নিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশটি একপ্রকার মরিয়া। এক্ষেত্রে তাদের কিছু সুবিধাও রয়েছে। ভালো সম্পর্ক এবং দূরত্ব কম থাকায় খুবই কম সময়ে চীন থেকে কাঁচামাল আনতে পারে বলে অর্ডার পাওয়ার পর স্বল্পসময়ে পণ্য পৌঁছে দিতে পারে গন্তব্যে। কিন্তু তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের সময় লাগে বেশি। স্বল্পমূল্যের কথা ভেবেই ক্রেতারা মূলত বাংলাদেশকে বেছে নেয়। এসবের পাশাপাশি ভিয়েতনামের বিনিয়োগ-সক্ষমতা বেশি। উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতাতেও শ্রমিকরা এগিয়ে। তবে সাম্প্রতিক তথ্যাদি কিন্তু ভিন্ন কথা বলছে। করোনার ধকল সামলে নিয়ে গত দেড় বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে খুবই ভালো করছে বাংলাদেশ।
চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে (জানুয়ারি-জুলাই) যুক্তরাষ্ট্রের ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ৫৭১ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করা হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। এখন নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, এ অঙ্ক ৬ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে। প্রথম সাত মাসে ২০২১ সালের একই সময়ের তুলনায় দেশটিতে এ বছর পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৫৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ। অটেক্সার হালনাগাদ পরিসংখ্যান থেকে এমন তথ্য মিলেছে, যা কিনা স্বপ্ন দেখার সাহস জোগায় এ খাতে বিশ্বের এক নম্বর হওয়ার।