জাতিসংঘে পুলিশপ্রধানদের সম্মেলনে সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের অংশগ্রহণ স্বাভাবিক হলেও তাঁর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা থাকায় বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তর স্থাপন সংক্রান্ত চুক্তি অনুযায়ী,জাতিসংঘের আমন্ত্রণ পাওয়া ব্যক্তিদের ভিসা দিতে যুক্তরাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা আছে।২০১৯ সালে ইরানের কর্মকর্তাদেরও ভিসা দেওয়া হয়েছে।তবে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চলাফেরা সীমিত করে দেওয়া হয়েছিল।
আবার ২০১৪ সালে ওবামা প্রশাসন জাতিসংঘে ইরানের মনোনীত রাষ্ট্রদূত হামিদ আবুতালেবিকে ভিসা দেয়নি। কারণ তাঁর বিরুদ্ধে ১৯৭৯ সালে ইরানে মার্কিন দূতাবাস দখল ও জিম্মি সংকটে ভূমিকা রাখার অভিযোগ ছিল।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে গত বছরের ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর আইজিপি বেনজীর আহমেদকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষণা করেন। এই ব্যবস্থা ‘ভিসা নিষেধাজ্ঞা’ হিসেবেই পরিচিত।
১৯৪৭ সালে স্বাক্ষরিত জাতিসংঘের ‘হেডকোয়ার্টার্স অ্যাগ্রিমেন্ট’ অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘে আমন্ত্রিত বিদেশি কূটনীতিক অথবা কর্মকর্তাদের জন্য কোনো ধরনের ফি ছাড়াই যত দ্রুত সম্ভব ভিসা দেবে।বেনজীর আহমেদ জাতিসংঘ থেকে আমন্ত্রণ পেয়েছেন এবং তিনি সরকারের জ্যেষ্ঠ সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ পুলিশপ্রধানদের সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান,আইজিপি বেনজীর আহমেদসহ ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদল গঠন করা হয়।গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ এসংক্রান্ত আদেশ জারি করে।প্রতিনিধিদলটি ৩০ আগস্ট বা তার কাছাকাছি সময়ে নিউ ইয়র্কের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়বে এবং ৩ সেপ্টেম্বর বা তার কাছাকাছি সময়ে নিউ ইয়র্ক থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ সরকার ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছিল।ভুল,বিভ্রান্তিকর ও অতিরঞ্জিত তথ্যের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছে,এমন যুক্তিও মার্কিন কর্মকর্তাদের কাছে তুলে ধরেছে বাংলাদেশ।সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছে সরকার।
এমন প্রেক্ষাপটে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সম্মেলনে সরকারি প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে বেনজীর আহমেদকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রেক্ষাপট জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল শুক্রবার বলেন,জাতিসংঘ থেকে আমাদের দাওয়াতপত্র দেওয়া হয়েছে।আমরা তা গ্রহণ করেছি।তার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যাওয়ার পরিকল্পনা করেছি।
ভিসাপ্রাপ্তির বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন,আমরা দাওয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে আবেদন করব।ভিসা দেওয়া দূতাবাসের বিষয়।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও জাতিসংঘের সম্মেলনে অংশ নিতে বিদেশি কর্মকর্তাদের নিউ ইয়র্ক সফরের নজির আছে।বিশেষ করে ইরানের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পরও জাতিসংঘ সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন তাঁরা।
২০১৯ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের প্রাক্কালে ইরানের কূটনীতিকদের ভিসা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ অভিযোগ করেছিলেন, তাঁদের ভিসা দেওয়া হয়েছে একদম শেষ মুহূর্তে। তবে এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের অধিবেশনে অংশগ্রহণকারীদের ভিসা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা পূরণ করেছে।ভিসা দিতে দেরি করার মাধ্যমে প্রকারান্তরে তাঁদের যুক্তরাষ্ট্রে আসতে নিরুৎসাহিত করা হয়।
জাতিসংঘ সদর দপ্তর নিউ ইয়র্ক সিটির যে ডিস্ট্রিক্টে অবস্থিত তার নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব জাতিসংঘের।তবে যুক্তরাষ্ট্র তথা নিউ ইয়র্ক সিটিতে যেতে হলে অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা থাকতে হবে।
লন্ডনভিত্তিক গণমাধ্যম মিডল ইস্ট আইয়ের এসংক্রান্ত এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে।জাতিসংঘের আমন্ত্রণে সম্মেলন বা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য বিদেশি কূটনীতিকদের ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতা আছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের অন্য আইনের সঙ্গে এটি কিছুটা সাংঘর্ষিক।
১৯৪৭ সালে স্বাক্ষরিত জাতিসংঘের ‘হেডকোয়ার্টার্স অ্যাগ্রিমেন্ট’ অনুযায়ী, জাতিসংঘ সদর দপ্তরে যাওয়ার জন্য বিদেশি কূটনীতিক,বিশেষ করে সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধানদের জন্য ভিসা খুব সহজ হওয়ার কথা।কিন্তু এখানেও জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস তার ‘পাবলিক ল ৮০-৩৫৭’ আইনে জাতিসংঘের চুক্তিকে অনুমোদন করেছে।ওই আইনে বলা হয়েছে,জাতিসংঘ সদর দপ্তর ও তার খুব কাছের এলাকা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের অন্যত্র বিদেশিদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষার উদ্যোগকে ওই চুক্তি (হেডকোয়ার্টার্স অ্যাগ্রিমেন্ট) দুর্বল করতে পারবে না।
যুক্তরাষ্ট্র মনে করে,ওই আইনে নিরাপত্তা,সন্ত্রাস ও পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত কারণে যে কারও যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশ ঠেকানোর সুযোগ রয়েছে।তবে এর সঙ্গে একমত নয় জাতিসংঘ।এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের বিদেশিদের চলাফেরা জাতিসংঘের মধ্যেই সীমিত করে দিতে পারে।যেমন-২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জারিফের চলাচল নিউ ইয়র্ক সিটির ছয়টি ব্লকের (জাতিসংঘ সদর দপ্তর,জাতিসংঘে ইরানের মিশন ও রাষ্ট্রদূতের বাসভবন) মধ্যে সীমিত করে দিয়েছিল।জারিফের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ছিল।
অতীতে বিভিন্ন সময় যুক্তরাষ্ট্রের আইন ও জাতিসংঘের ব্যাখ্যার মধ্যে পার্থক্য দেখা গেছে।১৯৮৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র তৎকালীন প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) চেয়ারম্যানকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেওয়ার সুযোগ দিতে অস্বীকৃতি জানায়।এর প্রতিক্রিয়ায় জাতিসংঘ গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়েছিল,যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৭ সালের চুক্তি লঙ্ঘন করেছে।১৯৮৮ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন নিউ ইয়র্কের বদলে জেনেভায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল শুধু পিএলও নেতার যোগ দেওয়ার সুবিধার্থে।