ছোটবেলা থেকেই
ছোটবেলা থেকেই তানজিম শাহ কবিরের কম্পিউটারের প্রতি আগ্রহ। নিজে থেকেই কম্পিউটারে নানা কাজ করার চেষ্টা করত। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রথম প্রগ্রামিং শুরু করে। এতটুকু বয়সেই তৃণব পাইথন, সি প্রগ্রামিংয়ের অনেকটাই শিখেছে।
তৃণব জানায়, ‘নিজে নিজে চেষ্টা করতাম। স্কুলের মিজান স্যারের কাছে সি প্রগ্রামিং শিখেছি। ’ কোনো কিছু নিয়ে অনরবত লেগে থাকা যেন তার স্বভাব। সে কথাই শোনা গেল তার বাবা হুমায়ুন কবিরের মুখে, ‘ও ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন ডিভাইস নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করে। বিভিন্ন ডিভাইস জানতে, বুঝতে চেষ্টা করে। নিজেই খুলে ফেলে আবার ঠিকঠাক সংযুক্ত করে ফেলে। ’
বাবা-মা বড় অনুপ্রেরণা
‘বাবা কম্পিউটার রুমে তালা দিয়ে রাখেন। যখন-তখন কাজ করতে পারি না। খানিকটা মন খারাপ হলেও ভালোই লাগে। তাঁরা তো আমার ভালোর জন্যই সব করছেন’, বলে তৃণব। তৃণবের বাবা হুমায়ুন কবির চাকরি করেছেন দীর্ঘদিন। এখন ব্যবসা করেন। মা নিগার সুলতানা শিক্ষকতা করছেন। ছোট ভাই তাহমিদ শাহ কবির, বাবা-মাকে নিয়ে তৃণব নোয়াখালীর মাইজদীতে থাকে।
কাজ তার ইথিক্যাল হ্যাকিং নিয়ে
তৃণব কাজ করে ইথিক্যাল হ্যাকিং বা নৈতিক হ্যাকিং নিয়ে। এককথায় এরা ভালো হ্যাকার। এরা অন্যের সিস্টেমে অনুমতি নিয়ে ঢুকে ত্রুটি খুঁজে বের করে তা ঠিক করে দেয়। হ্যাকিং দুই প্রকার—হোয়াইট হ্যাট হ্যাকার বা ইথিক্যাল হ্যাকার এবং ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকার বা ম্যালিসিয়াস হ্যাকার। ম্যালিসিয়াস হ্যাকাররা কোনো দেশ, কম্পানি কিংবা প্রতিষ্ঠানের সিস্টেমের রুল এবং সিকিউরিটি ভেঙে ফেলে এবং মূল সিস্টেমের ক্ষতিসাধন করে। এই ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রয়োজন হয় ইথিক্যাল হ্যাকারদের। মোটকথা সাইবার সিকিউরিটি নিশ্চিত করতে ইথিক্যাল হ্যাকারদের বিকল্প নেই। তৃণব জানায়, ‘দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাইবার সিকিউরিটি নিশ্চিতে ইথিক্যাল হ্যাকারদের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। অনলাইন মার্কেট প্লেসেও তাদের কাজের কোনো কমতি নেই। ’
পথ দেখাল ইশিখন ডটকম
বাবার ল্যাপটপ নিয়ে পড়ে থাকত তৃণব। নানা রকম কাজ শেখার চেষ্টা করত। একদিন সে বাবাকে বলে, কোথাও কোর্সে ভর্তি করিয়ে দিতে। ২০২১ সালের জুন মাসের ঘটনা। অবশ্য আর জে কিবরিয়ার এক অনুষ্ঠানে শাওন নামে একজন ইথিক্যাল হ্যাকারের সফলতার গল্পটা বাবা আগেই দেখেছিলেন। ফলে পেশায় ঝানু ব্যবসায়ী হুমায়ুন ইথিক্যাল হ্যাকিংয়ে ছেলের সম্ভাবনা আঁচ করতে মোটেও ভুল করেননি। তৃণবের বাবা ছেলের মতকেই প্রাধান্য দিয়ে ইথিক্যাল হ্যাকিংয়ের কোর্সে ভর্তি করিয়ে দেন ইশিখন ডটকমে। ইশিখনে সবচেয়ে কম বয়সী শিক্ষার্থী ছিল তৃণব। অল্প বয়স। ছেলে কি সত্যিই শিখতে পারছে কিছু। এমন শঙ্কা কিছুটা হলেও ছিল তাঁর বাবা-মায়ের। তাঁরা ছেলের কাছাকাছি থাকতেন। ওকে টিচার যা জিজ্ঞাসা করত, সব কিছুই জবাব দিয়ে দিত। ফলে তাঁরাও একটু আশ্বস্ত হন।
অবশেষে মিলল নিজস্ব কম্পিউটার
ইশিখনে ইথিক্যাল হ্যাকিং তো শেখা হলো। বাবার ল্যাপটপে তখন আর কাজ চলছিল না তৃণবের। এবার আবদার করল ভালো কনফিগারেশনের কম্পিউটারের। অল্প বয়সী ছেলে। কম্পিউটার কিনে দিলে সারাক্ষণ কী না কী করে। পড়াশোনা আবার গোল্লায় যাবে না তো! এমনটাই ভাবছিলেন তাঁর বাবা-মা। সে কারণে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিতে একটু দেরি করেছিলেন। এদিকে তৃণবও নাছোড়বান্দা। রীতিমতো কান্না জুড়ে দেয়। কম্পিউটার তার লাগবেই লাগবে। বাবা যেন কম্পিউটার কিনে দেন সে জন্য ১০০ রাকাত নফল নামাজও পড়েছে সে। অবশেষে ছেলের আবদার রক্ষা না করে পারেননি ব্যবসায়ী হুমায়ুন কবির।
কম্পিউটার রুমে তালা
কম্পিউটার পেয়ে তৃণব নাওয়া-খাওয়া ভুলে গেল। সারাক্ষণ কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থাকে। এমনও হয়েছে, সারা রাত কাজ করেছে সে। একটুও ঘুমায়নি। তখন তার বেডরুমে কম্পিউটার থাকত। এখন অবশ্য আলাদা রুমে থাকে। সে রুমে তালা লাগিয়ে দেন তাঁর বাবা। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আগে একাডেমিক পড়াশোনা, তারপর অন্য কিছু। তবে মাঝে মাঝে কিছুটা সময়ের জন্য রুম খুলে দেন। তখন তৃণব কাজের ভুবনে হারিয়ে যায়। ’
ঘণ্টা অনুপাতে আয়
দুই মাসে মাত্র ১২ ঘণ্টা কাজ করে তৃণবের আয় দুই লাখ টাকার ওপরে। সে প্রতি ঘণ্টা কাজের জন্য ৫০ থেকে ১০০ ডলার নেয়। অবিশ্বাস্য মনে হলেও ছোট তৃণবের এই আয়ের গল্পটা পুরোটাই সত্য। তৃণব নিজেই তার ব্যাখা করে এভাবে, আসলে ইথিক্যাল হ্যাকিংয়ের কাজ এমনই। সময় অনুপাতে টাকা আয় করা যায়। অবশ্য এই সফলতা তার এক দিনে আসেনি। দিনের পর দিন সে কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থেকেছে। চর্চা বাদ দেয়নি এক দিনও। তৃণব বলে, ‘পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত শুধু অনুশীলন করেছি। দিন-রাত লাভ-ক্ষতি কোনো কিছুর কথা ভাবিনি। শেখার মাঝে হারিয়ে গেছি। ’
কাজের ফিরিস্তি
আপওয়ার্কে ‘হুমায়ুন কবির’ নামে যে মানুষটি আছেন, প্রচুর কাজ করছেন, সে মানুষটি আসলে তৃণব। বয়স ১৮ হয়নি। সে কারণে বাবার নামে আপওয়ার্কে অ্যাকাউন্ট খুলেছে। আপওয়ার্কে সে কাজের আবেদন করে রাখে। কারো পছন্দ হলে তাকে নক দেয়। আবার তার কিছু ব্যক্তিগত ক্রেতা (পারসোনাল বায়ার) আছে। কিছু কম্পানির সঙ্গেও যোগাযোগ তার বেশ ভালো। এই কম্পানিগুলো অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, নিউজিল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের। পারসোনাল বায়ার, কম্পানি তার থেকে কাজ করিয়ে নেয়। নিজের কাজ সম্পর্কে তৃণব বলে, ‘আমার কাজের চাহিদা অনেক বলে অনেক কম সময় অনেক টাকা আয় করা সম্ভব হয়েছে। এই যেমন—১২ ঘণ্টায় দুই লাখ টাকার বেশি আয় করেছি। ওয়েবসাইট টেস্টিং করে সবচেয়ে বেশি আয় করেছি। এ ছাড়া র্যানসামওয়্যার সরানো, ফাইল ডিক্রিপ্ট, ম্যালওয়্যার ক্লিন, অ্যাকাউন্ট সিকিউরিটি, সার্ভার সিকিউরিটি ইত্যাদি কাজও করেছি। ’ যেখানে পাঁচ-দশ ডলার দিয়ে বেশির ভাগ নতুন ফ্রিল্যান্সারের আয়ের শুরু হয়, সেখানে তৃণবের প্রথম আয়ই ছিল ২১০ ডলার। এই টাকা সে বাবা-মায়ের হাতে তুলে দেয়।
নতুনদের জন্য
এ ক্ষেত্রের নতুনদের জন্য তৃণব বলে, ‘নতুনদের একটু বেশি সময় দিতে হবে, আর হতে হবে একটু পরিশ্রমী, না হলে শিখতে পারবে না। মেধা থাকলে সব সম্ভব। আমার বয়সীরা কেউ যদি ইথিক্যাল হ্যাকিং, কোডিং শেখে, তাহলে তাদের জীবন সুন্দর হবে। অনেক খারাপ অভ্যাস থেকে বেঁচে থাকবে। আমাদের দেশের কিশোর-কিশোরীরা অনেক মেধাবী। তাদের নিয়ে আমি অনেক আশাবাদী। ’
বাংলালিংক থেকে পেয়েছে অ্যাপ্রিসিয়েশন লেটার
মোবাইল সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বাংলালিংকের ওয়েবসাইট এবং অ্যাপ্লিকেশনে ছয় থেকে সাতটি বাগ খুঁজে পেয়েছে তৃণব। এ জন্য বাংলালিংক তাকে তিনটি অ্যাপ্রিসিয়েশন লেটার দেয়। বাংলালিংক থেকে তৃণব সম্পর্কে বলা হয়, ‘তোমাকে দেখে আমরা অনেক অনুপ্রাণিত আর গর্বিত যে আমাদের দেশের অনেক ছোট ছোট বাগ হান্টার আছে, যা উন্নত দেশেও নজিরবিহীন। তোমার দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে আমাদের বাগ হান্ট প্রগ্রামে কোনো বয়সের সীমা নেই। ’
স্বপ্ন দেখেন গুগলে কাজ করবার
ভালো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে গুগল বা এ রকম বড় কোনো কম্পানিতে কাজ করতে চাই। দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনতে চাই। এভাবেই নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা বেশ আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বলল তৃণব।