এই পৃথিবীটা বড়ই জটিল ও কঠিন। জ্ঞানীরা উপলব্ধি করিতে পারেন—হিংসায় উন্মত্ত নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্বের ঘোর কুটিল ধরণীতে টিকিয়া থাকাটাই অনেক বড় ব্যাপার। সেই জন্য যাহারা টিকিয়া আছেন, মহান সৃষ্টিকর্তার নিকট তাহাদের শুকরিয়া জানানো উচিত। তবে আমরা এই চিত্রের বিপরীতে দেখিতে পাই, এই পৃথিবীতে কত ধরনের ভূরাজনৈতিক খেলা চলিতেছে! আমরা সেই ‘খেলা’র খুব সামান্যই বুঝিতে পারি। অনেকের মতে, আমরা আসলে দেখিতে পাই সাগরে ভাসমান হিমবাহের উপরের দৃশ্যমান সামান্য অংশটুকু। হিমবাহের নিচে যে সিংহভাগ অংশ রহিয়া গিয়াছে, আমরা তাহা দেখিতে পাই না। পাইবার কথাও নয়। এই জন্য শক্তিশালী রাষ্ট্রের ‘পাওয়ার’ তথা ‘শক্তি’ কী জিনিস—আমরা তাহা জানি না। একই সঙ্গে পরাশক্তির ‘সুপার পাওয়ার’ কী জিনিস—তাহা আমরা বুঝিই না।
তবে আমরা না-জানি অথবা না-বুঝি, এইটুকু জানি-বুঝি যে, উন্নয়নশীল বিশ্বের ছোটখাটো দেশগুলির আশপাশে বড় বড় শক্তিশালী দেশ রহিয়াছে, সেইখানে রহিয়াছে অনেক ধরনের হিসাবনিকাশ। এই সকল ছোটখাটো দেশ যেই সকল বিবেচনায় স্বাধীনতা অর্জন করিয়াছে, সেই বিবেচনা অনুযায়ী এই দেশগুলির প্রতি শক্তিশালী দেশের হস্তক্ষেপ করিবার কথা নহে। কিন্তু সমস্যা হইল, এই বড় দেশগুলির সহিত অন্য বড় দেশগুলির একে অন্যের সঙ্গে রহিয়াছে জটিল হিসাব। সেই হিসাবের প্যাঁচে কাহারো কাহারো মধ্যে রহিয়াছে বৈরী সম্পর্ক। এই জটিল অবস্থায় উন্নয়নশীল বিশ্বের ছোট দেশগুলির এমনিতেই অত্যন্ত সতর্ক ও সাবধান থাকা উচিত। সেই যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলিয়াছেন—‘তুমি একটু কেবল বসতে দিয়ো কাছে।’ কবির ভাষায় ‘কাছে’ বসিয়া আছি, উহাই অনেক বড় ব্যাপার। তিনি যেমন বলিয়াছেন—‘বহুদিন মনে ছিল আশা/ ধরণীর এক কোণে/ রহিব আপন-মনে;/ ধন নয়, মান নয়, একটুকু বাসা/ করেছিনু আশা।’ অর্থাৎ উন্নয়নশীল বিশ্বের ছোট দেশগুলিও যেন ধরণীর এক কোণে আপন মনে এতটুকু জায়গা লইয়াই খুশি থাকিবে। এই সকল পঙিক্তর মধ্যে আমরা যেন এমনই আভাস পাই—ছোটখাটো দেশগুলির কী করা উচিত। কিন্তু এই ছোটখাটো দেশগুলি কাজী নজরুল ইসলামের ‘দারিদ্র্য’ কবিতার মতো ‘কণ্টক-মুকুট শোভা’ লইয়া কখনো কখনো ঔদ্ধত্যপূর্ণ ‘সাহস’ দেখায়—যাহাকে নজরুল বলিয়াছেন—‘অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস’। এই দুরন্ত সাহসের যুক্তি হিসাবে উঠিয়া আসে উন্নয়নের কথা, জিডিপির কথা। আমরা ল্যাতিন আমেরিকা, আফ্রিকায় দেখিয়াছি দুরন্ত সাহসের পরিণাম কী হয়, অতি চালাকের অবস্থা কী হয়। অনেক যানবাহনের গায়ে দার্শনিক কথাবার্তা লেখা থাকে। যেমন একটি ট্রাকের গায়ে লেখা ছিল—‘এখন করিবে চালাকি, পরে বুঝিবে জ্বালা কী!’ উন্নয়নশীল বিশ্বের ছোটখাটো দেশগুলি অনেক সময় চালাকি করিতে চাহে। সেই চালাকি অনেক ক্ষেত্রে হইয়া পড়ে কাকের আচরণের মতো। কাক যেমন কোনো জিনিস লুকাইবার সময় চক্ষু মুদিয়া মনে করে পৃথিবী অন্ধকার হইয়া গিয়াছে, সুতরাং পৃথিবীর কেহই আর তাহার গোপন জিনিসটি দেখিতে পাইতেছে না। এমন চালাকির বিপদ অনেক। এই জন্য প্রবাদে বলে—অতি চালাকের গলায় দড়ি।
ইহা ঠিক যে, উন্নয়নশীল বিশ্বের উন্নয়ন প্রয়োজন, মানুষের জীবনমানের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি প্রয়োজন। কিন্তু উহা করিতে গিয়া চালাকি কিংবা দুরন্ত সাহস দেখানোটা কি বিপজ্জনক নহে? সেই যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাহার ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতায় বলিয়াছেন—‘ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়েছি/ দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়/ বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টি নীলপদ্ম/ তবু কথা রাখেনি…।’ সুতরাং যে কোনো কারণে বা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই হউক, সুনীলের কবিতার মতো কেহ যদি কথা না রাখেন, কী হইবে তখন? চালাকি তখন জ্বালা কি হইবে না?