বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন নিয়মিতই মন্দা আর দুর্ভিক্ষের কথা বলছেন। বলছেন তার প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে। প্রস্তুতি হিসেবে যেখানে যতটুকু সম্ভব শাক-সবজি উৎপাদানের তাগিদ দিচ্ছেন নাগরিকদের।
‘বিশ্বে কি মন্দা আসন্ন’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বিশ্ব ব্যাংক বলেছে, ২০২৩ সালে বিশ্ব মন্দার কবলে পড়বে। বিশ্ব অর্থনীতির তিন মূল চালিকাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপের অর্থনীতি দ্রুত গতি হারাচ্ছে। তাই আশঙ্কা, ২০২৩ সাল একটা মহাসংকটের বছর হবে।
এখন প্রশ্ন উঠেছে তার এই আগাম সতর্কতা কতটুকু কাজে আসবে? নাকি উল্টো আতঙ্ক ছাড়াবে? আর সরকারেরইবা প্রস্তুতি কী? সংকট মোকাবেলায় সরকার এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে তাদের শর্ত মেনে ঋণ নিতে রাজি হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা তারা দেখছেন না। তবে অর্থনীতি এখনই চাপের মুখে আছে। আরো চাপে পড়তে পারে। আর সেই প্রেক্ষাপটে সরকারের ব্যবস্থাগুলো পর্যাপ্ত নয়। যদি সময় মতো সঠিক ব্যবস্থা না নেয়া হয় তাহলে পরিস্থিতি বেশ খারাপ হতে পারে।
সার্বিক পরিস্থিতি যেমন
বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (এফএও)-র মতে, বিশ্বের ৪৫টি দেশে ঘাটতিজনিত মারাত্মক খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা এখন সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে এশিয়া মহাদেশভুক্ত দেশ আছে ৯টি, যার মধ্যে বাংলাদেশসহ তিনটি দেশ দক্ষিণ এশিয়ার। এফএও’র হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরেই বিশ্বব্যাপী খাদ্যশস্য উৎপাদন কমবে ১.৪ শতাংশ। শুধুমাত্র দক্ষিণ অ্যামেরিকা ছাড়া বিশ্বের আর সব মহাদেশ বা অঞ্চলেই এবার খাদ্যশস্য উৎপাদন কমবে। বাংলাদেশও এর বাইরে থাকবে না।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেইজ ক্ল্যাসিফিকেশন (আইপিসি) বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ এখন মধ্যম ও গুরুতর খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, যা মোট জনসংখ্যার ২১ শতাংশ।
ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (আইএফপিআরআই)-ও উন্নয়নশীল দেশ ও তাদের উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, খাদ্যনিরাপত্তা ও দারিদ্র্যের হারে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা করছে। বাংলাদেশেও খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টিকর খাদ্যের সমতা নষ্টের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে অভিমত তাদের।
এদিকে বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ কমোডিটি মার্কেটস আউটলুক বলছে, বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির সংকুচিত মুদ্রার মান খাদ্য ও জ্বালানির দামকে এমনভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা খাদ্য ও জ্বালানি সংকটকে আরো গভীর করতে পারে। এরই মধ্যে অনেক দেশ এই সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে।
আর ঢাকায় গত বুধবার এক সেমিনারে বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ আয়াগেগো ওয়াম্বিলে বলেন, বাংলাদেশের ৩০ শতাংশ মানুষ এখন খাদ্য সংকটের মুখোমুখি।
বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতি
খাদ্য নিরাপত্তায় চারটি বিষয়ের ওপর জোর দেয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে-খাদ্যের ভৌত লভ্যতা, ভৌত, সামাজিক ও আর্থিকভাবে খাদ্য প্রাপ্তির ক্ষমতা, খাদ্যের সদ্ব্যবহার এবং উল্লিখিত তিনটি মাত্রার স্থায়িত্ব। তাই বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়গুলোকে মূল্যায়নের জন্য এ মাত্রাগুলোর ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
আর খাদ্য নিরাপত্তা বাড়ানোর কথা বলা হলেও বাংলাদেশে খাদ্য মজুদের পরিমাণ কমে আসছে। গত ৪৫ দিনের ব্যবধানে সরকারি গুদামে চালের মজুদ কমে গেছে তিন লাখ ২২ হাজার টন। সেপ্টেম্বর মাসের ১১ তারিখে দেশে মোট খাদ্যশস্য মজু, ছিল ১৯ লাখ ১৫ হাজার টন। এর মধ্যে চালের মজুদ ছিল ১৭ লাখ ২৬ হাজার টন। ধানের মজুদ ৮৯ হাজার টন এবং গমের মজু, ছিল এক লাখ ৩১ হাজর টন।
খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, এখন দেশে মোট খাদ্যশস্যের মজুদ কমে হয়েছে ১৫ লাখ ৯৯ হাজর টন। এর মধ্য চালের মজুদ আছে ১৪ লাখ ৪ হাজার টন, গমের মজুদ এক লাখ ৮১ হাজার টন এবং ধানের মজুদ মাত্র ২১ হাজার টন।
বিবিএসের তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে ৫.১৫ শতাংশের বেশি। এই সময়ে সময় খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির হার ৪.৪ শতাংশেরও কম। দেশে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রধান দুই খাদ্যশস্য চাল ও গম উৎপাদন হয়েছে তিন কোটি ৭৩ লাখ টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিন কোটি ৮৯ লাখ ৩০ হাজার টনে।
খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরেও দেশে ৬৭ লাখ ৩০ হাজার টন চাল ও গম আমদানি করা হয়। কিন্তু বিশ্ববাজারে খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৪৯ লাখ ৯৯ হাজার টন । প্রতি বছর চালের চাহিদা তিন কোটি ৭০ লাখ টন। আর গমের চাহিদা ৭৫ লাখ টন।
চলতি অর্থবছরে এক কোটি টন চাল ও গম আমদানির প্রয়োজন বলে মনে করা হচ্ছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রায় চার মাসে (১ জুলাই থেকে ২১ অক্টোবর) চাল, ডাল ও গম আমদানি হয়েছে ১৫ লাখ ৩৪ হাজার টন। গত অর্থবছরে একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ২৪ লাখ ৪৬ হাজার টন। এক বছরের ব্যবধানে চার মাসে আমদানি ৯ লাখ ১২ হাজার টন বা ৩৭ শতাংশ কমেছে। শুধু গত অর্থবছরই নয়, গত সাত অর্থবছরে একই সময়ে এবারের আমদানি হয়েছে সবচেয়ে কম।
তাই এটা স্পষ্ট যে জনসংখ্যা বাড়ার অনুপাতে খাদ্য উৎপাদন বাড়ছে না। আর আমদানিও কমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ আসন্ন?
বাংলাদেশ সেন্টার ফর পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‘আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা বাড়ানোর প্রস্তুতি তো নিতেই হবে। কিন্তু দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা দেখছি না। আমাদের প্রধান খাদ্য চাল স্বাভাবিকভাবে ৯৫ শতাংশ উৎপাদন করি। উৎপাদন কোনো কারণে খারাপ হলে ৮ শতাংশ পর্যন্ত কম হয়। এবার বন্যার কারণে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের পর্যাপ্ত আলু, শাক-সবজি এবং অন্যান্য কৃষিপণ্য আছে। তবে আমদানি করা ভোগ্যপণ্য নিয়ে সংকট হচ্ছে। ডলারের সংকট আছে। ব্যবস্থাপনা ঠিক করলে এগুলো মোকাবেলা করা যাবে। সেই ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি আছে। আর বিশ্বের সংকট আমাদের রপ্তানি আয় কমিয়ে দেবে। তাতে অর্থনীতি সংকটে পড়বে। এখনই সংকটে আছে। কিন্তু তাতে দুর্ভিক্ষ হবে বলে মনে হয় না।’’
তার কথা, ‘‘প্রধানমন্ত্রী দুর্ভিক্ষের কথা বলার পরও বাজারে তেমন প্যানিক দেখা যাচ্ছে না। চালের দাম মোটামুটি স্থিতিশীল আছে। তবে সরকার যখন বলে তখন তো সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি প্রতিক্রিয়া হয়।’’
কিন্তু সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)-এর গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, ‘‘রাজনৈতিক দিক দিয়ে প্রধানমন্ত্রী দুর্ভিক্ষ মোকাবেলার প্রস্তুতি নিতে বলে ভালোই করেছেন। এটা দেশের মানুষকে আগাম সতর্ক করে দেয়া। একটি পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত রাখা। তবে সেই প্রস্তুতি সরকারের দিক থেকে পর্যাপ্ত বলে মনে করি না।’’
তার কথা, ‘‘এটার জন্য সার্বিক পরিকল্পনা দরকার। সেটা শুধু সরকারে থাকা লোকজনকে নিয়েই নয় দেশে যারা আরো স্টেক হোল্ডার আছেন তাদের সবাকে নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে।’’
তারা দুই জনই মনে করেন, দুর্নীতি ও অপচয় রোধ এবং ডলার পাচার বন্ধ করা জরুরি।
অর্থনীতির সাত চ্যালেঞ্জ
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গত ১১ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশের অর্থনীতির সাত চ্যালঞ্জের কথা জানিয়েছে। চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে- ডলার সংকট, জ্বালানি সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, খাদ্য সংকট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সংকট, কোভিড ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট। তারা বলছে, সংকটগুলো মোকাবিলায় সরকার যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে সেগুলো সঠিক হলেও পর্যাপ্ত নয়।
সিপিডির গবেষণা বলছে, ঢাকা শহরে যারা বসবাস করছেন তাদের খাদ্যপণ্যের তালিকার ১৯টি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য রয়েছে, যার সবই মানুষের ভোগের মধ্যে থাকে। ঢাকায় চার সদস্যের একটি পরিবারের অত্যাবশ্যকীয় সব খাদ্যসহ সার্বিক খরচ ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে ছিল ১৭ হাজার ৫৩০ টাকা, যা ২০২২ সালের ১৬ অক্টোবরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৪২১ টাকা।
সিপিডি জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৩৬.৩ বিলিয়ন ডলার। এটা দিয়ে আমদানি ব্যয় কিভাবে মেটানো হবে? কারণ, আগামীতে ডলার সংকটে খাদ্য আমদানি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। ডলার বাজারের যে অবস্থা সরকার কি খাদ্য আমদানি করবে নাকি অন্য খরচ মেটাবে, এটা নিয়ে সংশয় দেখা দিচ্ছে।
তারা বলছে, আইএমএফের হিসাবে এটা প্রকৃত রিজার্ভ নয়। কারণ, এর থেকে ৭.২ বিলিয়ন ডলার বিভিন্ন ব্যয়বাবদ বাদ দিতে হবে। এ জন্য আইএফএফ থেকে ঋণ নেওয়া হচ্ছে।
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, খাদ্য নিরাপত্তার জন্য সামনে চারটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ।
১. প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে এবার ফসলহানি হয়েছে এবং আগামীতে এটা আরো বাড়বে।
২. আমদানি করা খাদ্যের প্রাপ্যতা আগামী দিনে আরো সংকুচিত হতে পারে। যাদের কাছ থেকে আমরা খাদ্য আমদানি করি, তারা নিজেদের প্রয়োজনেই খাদ্য না-ও দিতে পারে।
৩. তখন আমাদের হাতে আমদানি করার মতো ডলার থাকলেও আমরা খাদ্য না-ও পেতে পারি।
৪. অব্যাহত মূল্যস্ফীতির কারণে বাজারে পণ্য থাকার পরও নিম্ন আয়ের মানুষের সেগুলো কেনার সামর্থ্য না-ও থাকতে পারে।
‘‘তাই সরকারের উচিত হবে খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়িয়ে দরিদ্র মানুষ যাতে খাদ্য পায় তার ব্যবস্থা করা,’’ বললেন এই অর্থনীতিবিদ।
আইএফএর ঋণ
এই সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশ আইএমফএর সব শর্ত মেনে নিয়ে ঋণ নিতে রাজি হয়েছে। তাদের একটি প্রতিনিধি দল এখন ঢাকায় রয়েছে। আইএমএফ-এর কাছে বাংলাদেশ ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে।
চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি পূরণে চাওয়া এই বাজেট সহায়তা পাওয়া নিয়ে কোনো সংশয় নেই বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আইএমএফ-এর ঋণ পাওয়ার বিষয়ে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত হবে। ডিসেম্বরের প্রথম দিকে ঋণের প্রথম কিস্তি ছাড় করা হবে বলেও জানা গেছে।
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘‘সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ কিন্তু তেমন কোনো বড় ঋণ নয়। প্রতি মাসে আমাদের এক বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ কমছে। মাস ভিত্তিতে খরচ করলে এই ঋণের অর্থ কিন্তু চার মাসেই শেষ হয়ে যাবে। তাই এই ঋণের অর্থ কৌশলগতভাবে খরচ করতে হবে।’’
তার কথা, ‘‘যার মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে পারে, যার মাধ্যমে আরো ডলার আসতে পারে, সেই ধরনের খাতে পরিকল্পনা করে এই ঋণ ব্যবহার করতে হবে।’’
এই ঋণের ফলে সরকার এখন কিছু সংস্কার করতে বাধ্য হবে। কারণ, শর্ত সাপেক্ষে এই ঋণ দেয়া হচ্ছে বলে জানান ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘‘সরকার এখন কর আদায় বাড়াতে বাধ্য হবে। খেলাপি ঋণ কমাতে হবে। সুদের হার বাড়াতে হবে। আর্থিক খাতে সংস্কার করতে হবে। আমি মনে করি, এটা অর্থনীতির জন্য ভালো। আর এই ঋণ কিছুটা হলেও রিজার্ভ সংকট সামাল দিতে কাজে দেবে।’’