গত ১০ মার্চ সারা দেশে পালিত হলো জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস ২০২৩। ‘স্মার্ট বাংলাদেশের প্রত্যয়, দুর্যোগ প্রস্তুতি সব সময়’ ছিল দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এ দিনেই অর্থাৎ ১৯৭০ সালের ১০ মার্চ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হেনেছিল ভয়াবহ উপকূলীয় ঘূর্ণিঝড়। এ সময় ১০ লাখ বাঙালি ভাই ও বোনকে হারিয়েছি আমরা। এই ঘূর্ণিঝড় ছিল এযাবৎ রেকর্ডকৃত ও আধুনিক বিশ্ব ইতিহাসে সবচেয়ে প্রলয়ঙ্করী প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সে সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সঙ্গে সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত এলাকায় চলে আসেন। এই ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী ত্রাণতত্পরতা ও পুনর্বাসন কার্যক্রমে তৎকালীন পাকিস্তানি সরকারের ব্যর্থতার কারণে এর প্রভাব পড়ে ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভূমিধ্বস বিজয় লাভ করে এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা ত্বরান্বিত হয়।
দেশ-বিদেশের সাহায্য-সহযোগিতায় সেই সময় আমরা ঘুরে দাঁড়াই। বর্তমানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কল্যাণে বাংলাদেশ এক্ষেত্রে বিশ্বে একটি মডেল রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও প্রস্তুতির কথা এলেই ভোলা সাইক্লোনের কথা সবার মনে পড়ে। বিশেষ করে, ঝড়বৃষ্টির মৌসুম এলেই আমরা তা ভুলতে পারি না। কেননা ভোলা সাইক্লোন আমাদের মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে। আমি এখানকারই অন্যতম একজন জনপ্রতিনিধি। অবশ্য সেই সময়কার কোনো স্মৃতি আমার মনে পড়ে না। কেননা তখন আমার বয়স ছিল মাত্র এক বছরের কিছু বেশি। তবে আমার পিতা-মাতার কাছ থেকে এই ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানতে পেরেছি। সেই ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহ স্মৃতি বুকে ধারণ করে বেঁচে রয়েছেন, এমন লোকের সংখ্যা এখন হাতেগোনা।
ভোলা সাইক্লোনে অধিকাংশই জলোচ্ছ্বাসের কারণে মারা গেছেন। তার মধ্যে আমার সংসদীয় এলাকা তজুমদ্দিন উপজেলায় মারা গেছেন সবচেয়ে বেশি মানুষ। এমনও পরিবার রয়েছে যেখানকার ১০-১৫ জনের সবাই মারা গেছেন। গাছের ডালে, ঘরের চালে ঝুলে ছিল মানুষের লাশ। এ সময় শুধু লাখ লাখ মানুষই মারা যায়নি, অগণিত গবাদি পশু ও পাখিও মারা যায়। বিধ্বস্ত হয় ঘরবাড়ি, গাছপালা ও রাস্তাঘাট। উপকূল জুড়ে ছিল ধ্বংসলীলা। ভয়াবহ এই সাইক্লোনের খবর সঠিক সময়ে পৌঁছেনি। যে কারণে উদ্ধার ও ত্রাণ সহযোগিতা সঠিক সময়ে আসেনি। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের উদাসীনতার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। যার প্রভাব নির্বাচনে পড়েছে। ভোলা সাইক্লোন হয়েছিল ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর। তার এক মাস পর ৭ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৮টি আসনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জয় লাভ করে।
সমুদ্র উপকূলবর্তী হওয়ায় ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস বেশি হয়ে থাকে। এর মোকাবিলায় বর্তমানে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কমিটি কাজ করছে। কাজ করছেন স্বেচ্ছাসেবকরাও। এনজিওদের ভূমিকাও প্রশংসনীয়। বিশেষত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার এই এলাকায় বনায়ন কর্মসূচিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এই ব্যাপারে নিরলস কাজ করে চলেছে। কাজ করছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ও। তারা টেকসই বাঁধ নির্মাণে অনন্য ভূমিকা পালন করছেন। আগে মাটির বাঁধ অল্পতেই ভেঙে যেত। এখন টেকসই ও স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। ব্লক দিয়ে মজবুতভাবে বাঁধ তৈরির কারণে মানুষ অনেকটা স্বস্তিতে আছেন।
জানা মতে, তজুমুদ্দিনে ৭৬টি, লালমোহনে ১২৪টি মোট ২০০টি আশ্রয় কেন্দ্র আছে। অবশ্য তা প্রয়োজনের তুলনায় এখনো অনেক কম। ব্যাপক পরিমাণে মুজিব কেল্লা ও আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে, যাতে মানুষ ও গবাদি পশু নিরাপদে আশ্রয় নিতে পারে। এছাড়া উপকূল জুড়ে বেশি পরিমাণে স্কুলকাম আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা প্রয়োজন। আশার কথা হলো, অতীতে উপকূল জুড়ে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সম্পদ ও ব্যাপক প্রাণহানি ঘটত। বর্তমানে সরকারের আন্তরিকতা, সচেতনতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক কমে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে আমাদের নদী-সমুদ্র উপকূলবর্তী এই দ্বীপ জেলা ভোলার মধ্যে মেঘনায় জেগে ওঠা চরাঞ্চলের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। শুধু ভোলা জেলায় রয়েছেন ১৩ হাজার ৫০০ ভলান্টিয়ার বা স্বেচ্ছাসেবক। তারা সদাসর্বদা প্রস্তুত রয়েছেন। এখন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাঁচ দিন পূর্বে বন্যা এবং ১০ দিন পূর্বে ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে। এমনকি মোবাইলে এলার্ট দেওয়া হচ্ছে।
তার পরও আমরা মনে করি, উপকূল জুড়ে ম্যানগ্রোভ তৈরির লক্ষ্যে বেশি বেশি গাছ লাগানো প্রয়োজন। আশ্রয়কেন্দ্র সম্পর্কে সবাইকে ধারণা দিতে হবে, জনগণ যেন দ্রুত নিরাপদে আশ্রয় নিতে পারে। আবহাওয়া বার্তা শোনার অভ্যাস তৈরি করতে হবে। উঁচু জায়গায় নলকূপ স্থাপন করতে হবে, যাতে লোনা ও ময়লা পানি টিউবলে ঢুকতে না পারে। দুর্যোগকালীন ডায়রিয়া ও মহামারি প্রতিরোধে সচেতনতা যাতে বৃদ্ধি পায়, সেদিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে। হাতের কাছে প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জাম রাখতে হবে। সার্টিফিকেট ও দলিলপত্র সংরক্ষণ করতে হবে। দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় দ্রুত ত্রাণ সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে। আবার শুধু রিলিফের জন্য বসে না থেকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে জনগণকে উত্সাহিত করতে হবে। এভাবেই আমরা ভবিষ্যতে যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে পারি। এ ব্যাপারে আমাদের সচেতনতার বিকল্প নেই।